জীবনের এই গতিপথ...পূর্ব-পশ্চিমে যেন এক নিছক অন্বেষণ
১।
কনফারেন্সের কাজে সিংগাপুরে যাচ্ছি।
চেক ইন কাউন্টারে আমার রিপোর্ট করার কথা সন্ধ্যা সাতটায়। আমি সাড়ে সাতটার সময় সবে কে.এল সেন্ট্রালে এসে পৌছালাম। এখনো এয়ারপোর্ট প্রায় চল্লিশ কি.মি. দূরে।
বেশ গদাই লস্কর চালে, হেলে দুলে, আয়েশ করে L.C.C টার্মিনাল এয়ারপোর্টের বাসে উঠতে ছিলাম । আমাকে দেখে ড্রাইভারের মনে কি জানি সন্দেহ হল। সে আমাকে বলল, “ফ্লাইট কয়টায় তোমার?“ বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলাম, “নয়টায়”। ড্রাইভার বলল, “তা কয়টা বাজে এখন বাপধন?”
কোনমতে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে বললাম, “সাড়ে সাতটা। কেন রে বাপ এত প্রশ্ন করে ত্যাক্ত করছিস?
ড্রাইভার এরপর যেটা বলল সেটা এইরকম “এই বাস ছাড়বে আটটায়।
এয়ারপোর্ট পৌছাবে নয়টা পনেরোতে। তো বাপধন তোমার কি এই ফ্লাইটে যাবার ইচ্ছা আছে?”
“হ, ইচ্ছা তো আছে, তাইলে এখন উপায়?” এই কথা বলেই আমি বাস থেকে নেমে দিলাম দৌড়। এই সহজ জিনিসটা আমার মাথায় এতক্ষণ আসেনি কেন, সেটা আমার কাছে এক বিরাট রহস্য এখনো।
২।
একটা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল।
এয়ারপোর্টের কথা বলতেই, “নো প্রবলেম। উঠে পড়। তোমার ফ্লাইট তো নয়টায়। তাই না? কয়টা বাজে এখন দেখো তো। ”
না দেখেই বললাম, “সাতটা ত্রিশ।
”
ড্রাইভার বলল, “আমি মালয়শিয়ান। আমার এক কথা এক কাজ। ম্যাক্সিমাম আটটা পনেরো বাজবে এয়ারপোর্ট পৌছাতে। গাড়ী আজকে উড়াইয়া নিয়া যাবো। হুহ”
“তা বাবা আমার কাছে রিঙ্গিটের একটু ঘাটতি আছে।
” বিনীত ভাবে ট্যাক্সিওয়ালাকে অনুরোধ করি। “ট্যাক্সিতে যাবার মত অত টাকা পকেটে নাই। তুমি বাবা কোন পেট্রোল পাম্পে একটু থেমো। আমি এ.টি.এম মেশিন থেকে কিছু টাকা তুলব। ”
সে বলে, “নো প্রবলেম।
ডলার দিও তাও চলবে। ”
“হে হে হে। ” বিখ্যাত ছাগল হাসিটি দিলাম “আসলে আমি আমার ক্যামেরার দুইটা ব্যাটারিও কিনতে চাই। একটু না হয় থেমো বাবা। তোমরা মালয়শিয়ানরা তো দয়ার শরীর।
আবার আমাকে কিন্তু আটটা পনেরোর মধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌছে দিতে হবে। হে হে। ”
ট্যাক্সিওয়ালা বুকে হাত দিয়ে বলল, “আমিও বাবা মালয়শিয়ান। আমার এক কথা এক কাজ। ”
বাপরে বাপ।
সে ওইদিন ট্যাক্সি চালাল বটে, পুরা ইংলিশ মুভির মত। মাঝপথে একটা পেট্রোল পাম্পে গাড়ি থামাল। আমি টাকা তুললাম, আর ব্যাটারি কিনলাম। তারপর দৌড়ে আবার ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সিতে উঠেই ক্যামেরা থেকে পুরানো ব্যাটারি দুটো খুলে নতুন গুলো লাগালাম।
পুরানো ব্যাটারি গুলা হাতেই রাখলাম, কোথাও ডাস্টবিন পেলে ফেলে দিব বলে।
এয়ারপোর্টে পৌছে যখন ট্যাক্সিওয়ালাকে টাকা দিতে যাবো, তখন সে বলে, “আগে বল কয়টা বাজে। ” পকেট থেকে মোবাইল বের করে বললাম, “আটটা এগারো। ”
“হুম। তাহলে দাও টাকা।
” ভাবখানা এমন যে আটটা ষোল বাজলে সে আর টাকা নিতনা।
লাগেজ নিয়ে ট্যাক্সি থেকে বের হতেই একটা ডাস্টবিন পেলাম। ব্যাটারি দুটো সেখানে ফেলে দিলাম।
৩।
চেক ইন কাউন্টার খুঁজে বের করে যখন ওখানে পৌছালাম, তখন বাজে প্রায় আটটা বিশ।
কাউন্টারের মেয়েটা চোখ পাকিয়ে আমার দিকে বলল, “কয়টা বাজে এখন ছেলে? এত দেরী কেন?”
মোলায়েম একটা হাসি দিলাম। তারপর হাতের মোবাইলের দিকে সময় দেখার জন্য চামে তাকালাম। কিন্তু এ কি! আমার হাতে কোন মোবাইল নাই। তার বদলে আছে দুইটা পেন্সিল ব্যাটারি। তাহলে মোবাইল গেল কই? আমি কি ব্যাটারির বদলে মোবাইল ডাস্টবিনে ফেলে দিছি?
চেক ইন কাউন্টার থেকে বোর্ডিং পাস নিয়ে আবার সেই ডাস্টবিনের কাছে দৌড়ে এলাম।
কিন্তু ততক্ষনে ওই বিন পরিস্কার করা হয়ে গেছে। তাও শেষ ভরসা হিসাবে এক বাংলাদেশী ক্লিনারকে পেলাম। নাম রফিক, ফরিদপুরের ছেলে। আমার সমস্যার কথা বলতেই, সে আর তার এক দোস্ত মহা উতসাহে ডাস্টবিন ঘেটে দেখা শুরু করল। কিন্তু মোবাইল আর পাওয়া গেলনা।
মোবাইলের সেটটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ না, কিন্তু এর ভিতরের ইনফরমেশন গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমি সিংগাপুরে কোথায় থাকব, কি করব সব ইনফরমেশান ওই মোবাইলেই আছে।
মোবাইল না পেলে কি হবে। এবার কিন্তু শুরু হল, রফিক বাবার গল্প। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নাই।
গল্পের বিষয়, তার এক অস্ট্রোলিয়ার মামাকে নিয়ে। যাক কোন মতে রক্ষা পেয়ে যখন আমি ইমিগ্রেশানে পৌছালাম, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।
৪।
ইমিগ্রেশান অফিসার আমার দেরী দেখে, অত্যন্ত সরু চোখে আমাকে অবলোকন করল। তারপরে পাসপোর্টটার ছবির সাথে আমার চেহারা ডানে-বামে, উপর-নীচ সবদিক দিয়ে মিলিয়ে দেখল।
জানি আমার চেহারা সুবিধার না। তবে সেই ইমিগ্রেশান অফিসারের চেহারা আবার দেখার মত। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, মাথার সব চুল ফেলে দিয়ে ব্যাটা আবার টাক্কু সাজছে, আর থ্যাবড়া নাক। তার উপর ধবধবে সাদা শার্ট পরার কারণে সাদা-কালোর “কনট্রাস্ট” বলে যে একটা টার্ম বিজ্ঞানে আছে, তা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।
তাও ভালো।
সবকিছু মিলিয়ে যখন ইমিগ্রেশান পার হলাম, ততক্ষণে আমার নাম এনাউন্স করা শুরু হয়ে গেছে, “আরাফাত, তুমি যেখানেই থাকো ফ্লাইট AK-717 তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি তাড়াতাড়ি গেইট F-71-এ চলে এসো। ”
দৌড়ের উপর যখন লাস্ট রিশিপশানে পৌছালাম, তখন কাউন্টারের মেয়েটা আমাকে দেখেই বলল, “তুমি নিশ্চই আরাফাত। তুমি ১৪ মিনিট লেট করছ ছেলে। সোজা গেইট F-71-এ যাও।
” এই বলে সে আমার বোর্ডিং পাসের একটা অংশ ছিড়ে নিল।
তারপরে যখন গেইট F-71-এ পৌছালাম, তখন দেখি এক মহা সুন্দরী বিমান বালা নমস্কারের ভংগীতে বিরক্ত মুখে দাড়িয়ে আছে। বেচারা প্রায় ২০ মিনিট ধরে শুধু কর্তব্যের খাতিরে দাঁড়িয়ে আছে। আহা বেচারা। আমাকে দেখেই হাসি মুখে এক সাদর সম্ভাষণ জানাল।
কিন্তু স্পষ্ট টের পেলাম সে মনে মনে বলল, “শালা বজ্জাত পোলা”। আর আমিও এমন মধুর একটা হাসি দিলাম, যে ওই বিমান বালার পিত্তি হয়ত জ্বলে গেল। চোখের আগুনে কাউকে ভস্ম করা গেলে আমি তখনই ভস্ম হয়ে যেতাম।
ফ্লাইটে ঘোষণা দিল, “ফ্লাইট AK-717 ইজ ডিলেইট টুয়েনটি মিনিটস ডিউ টু আন এভয়েডেবল সারকামাস্টেন্স। ”
হায়।
আমাকে কেউ কোনদিন এভয়েড করতে পারলনা।
৫।
সিংগাপুরে আমার এক আপু আছে। যখন তার বাসাতে পৌছালাম, তখন রাত প্রায় একটা বাজে। আমার দেরী দেখে আপু বাসার নীচে এসে দাঁড়িয়ে ছিল।
বাসাতে এসেই গোসল করলাম। আপু খাবার বেড়ে দিল। আপু না খেয়ে ছিল। একসাথে খেতে বসলাম।
কেন জানি না, অনেকদিন পরে আবার বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে গেল।
Clementi Avenue 5, BLK 340, যেখানে আমি ছিলাম
Clementi Avenue 5, BLK 340, থেকে তোলা আরো একটি ছবি
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিংগাপুর (NUS)
NUS-এর পথে পথে
অরচার্ড রোড
রাতের অরচার্ড
সিংগাপুর ফ্লায়ার, পুরো শহর দেখা যায় ফ্লায়ারে উঠলে
সিংগাপুর শহর ফ্লায়ার থেকে
সেন্টোসা বীচ
সেন্টোসা বীচ, আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ বীচ, প্রচন্ড ছোট, পুরোটাই কৃত্রিম থিম পার্ক
ভিভো সিটির পথে আমি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।