আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্লগিং ও ব্লগারঃ বর্তমান বাংলার তীব্রতম কৌতুক

ইকার এর নিঃসঙ্গ বচন "পাবলিক খায়" বলে আমাদের দেশে একটি থিওরি আছে । শিল্প-সাহিত্য থেকে শুরু করে খাবার-দাবার , যেকোনও বিষয়ে এই থিওরি প্রযোজ্য । তাই কোন একটা কাজ/প্রকল্প/উদ্যোগ শুরু করার আগে, কাজটি ভাল হবে কি না তার সাথে সাথে আমাদের ভাবতে হয় পাবলিক খাবে কি না । তো পাবলিক নামক বস্তুর রুচি আবার অনেক প্রগতিশীল । সেটি একেক সময় একেক জিনিস খায় ।

খুব ছোটবেলায় - যখন কেবল স্কুলে ভর্তি হয়েছি - তখন দেখতাম আমার কলেজ পড়ুয়া মামা তার বন্ধুদের নিয়ে ডেকসেটে গান শুনতে শুনতে সিগারেট খেত , আর পরিকল্পনা করত কিভাবে বিভিন্ন উপায়ে টাকা জমিয়ে একটা গিটার কেনা যায় । তাদের এই "জমানো" পরিকল্পনার একটা বড় অংশ জুড়ে থাকত বাজারের টাকা মারা । তখন আমার বয়স একদমই কম , গিটার দিয়ে গান গাওয়া যায় মামা মারফত এইটুকু জানি কিন্তু "গিটার" নামটির মধ্যে যে "টারমিনেটর" সুলভ যান্ত্রিক ভাব আছে - তা একটি শিশুর মনস্তত্ত্বকে দোলা দেয়ার জন্য যথেস্ট ছিল । সুতরাং বাজারের টাকা মেরে মেরে আর অন্য যেভাবেই হোক , মামা যখন গিটার কিনে ফেললেন - তখন আমার উত্তেজনার অন্ত থাকল না । সেই গিটার নিয়ে কত কাহিনী ! নানা-নানীর ভয়ে সেটা বাসার কোথায় লুকিয়ে রাখা হবে সেটা নিয়ে চলতো আমার সাথে গোপন শলা পরামর্শ ।

ফান্টা আর স্লাইস এর বোতল খাইয়ে খাইয়ে মামা আমাকে ততদিনে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে গিটারের ব্যাপারটা গোপন , কাওকে বলা যাবে না । আমিও খুশি । প্রতিদিন ফান্টা-স্লাইস-মিরিন্ডার ডোজ পড়লে গিটার কেন , আমি আমার নামও ভুলে যাব । আমি ছোট হলেও মামা কেন যেন আমার কথা খুব মন দিয়ে শুনত । তাই আমি যখন বুদ্ধি দিলাম সারাদিন কাজ শেষে গিটারটা মামার খাটের নিচে রাখতে , মামা তখন সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলো ।

অবশ্য পরেরদিন সকালে ঘর পরিস্কার করতে এসে নানী গিটারটা দেখার পরে যে ঘটনা ঘটেছিল - সেটি বলতে চাচ্ছি না । এরপরে খানিক বড় হলাম । বেশ ক'ক্লাস পার করে তখন আমি শিশু থেকে বালক বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি । আমার মামাও তার তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে পা রেখেছেন । প্রথম যৌবনেই একজন প্রেমিকা জুটিয়ে ফেলেছেন ।

তো একদিন মামা ক্যামেরাওয়ালা একটি মোবাইল সেট কিনে গ্রামীনফোনের সংযোগ লাগিয়ে বাসায় নিয়ে আসলেন - তার ভাব দেখে কে ! মাটিতে পা ই পড়ে না । বলা দরকার , আমাদের বাসায় তখনো কোনও মাল্টিমিডিয়া সেট আসেনাই । তাই বাসার মোবাইল সেক্টরে প্রথম মাল্টিমিডিয়া যুগের সুচনাকারী হিসেবে মামা গর্ববোধ করতেই পারেন । সেই গর্ববোধ টাটকা থাকতে থাকতেই তিনি আরেকটি সেট কিনে বসলেন । সেটার আবার ক্যামেরা তো আছেই সাথে আবার ছবি এডিটও করা যায় ।

কি বিকট ব্যাপার ! সবকিছু এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল । গন্ডগোলটা তখন বাধল যখন মামা মোবাইলে ওয়ালপেপার ব্যাবহার করা শুরু করলেন । তিনি ওয়ালপেপার হিসেবে কি ধরনের ছবি ব্যাবহার করতেন তা আমি জানতাম না , কারন তিনি আমাকে তার মোবাইল ধরতেই দিতেন না - নষ্ট করে ফেলব এই ভয়ে । কিন্তু পরে বুঝে ছিলাম ওয়ালপেপার গুলো মনে হয় বিশেষ সুবিধার কিছু ছিল না - কারন নানা একদিন কোনও একটা দরকারে ওই মোবাইল দিয়ে কারও সাথে কথা বলে আর ফোন কাটার পরপরেই বজ্রপাত শুরু হয়ে যায় ঘরের মধ্যে । এরপরে আরও বছর দশেক পার হয়েছে ।

বহুদিন ধরে বহুরকম হুজুগ আর "পাবলিকের খানা" দেখছি । কিন্তু ২০১৩ এর গনজাগরনের পর "ব্লগিং" নামক ব্যাপারটি নিয়ে যেরকম শুরু হয়েছে তার কোনও তুলনা নাই । আমি ২০১১ থেকে আমারব্লগ এর রেগুলার পাঠক । কোনও একাউন্ট নাই , কিন্তু পাঠক । বিভিন্ন ব্লগপোস্ট পড়ি , বোঝার চেষ্টা করি , মাঝে মাঝে মনে দ্বিধা জাগে , পরক্ষনেই তা পরিষ্কার হয় ।

আস্তে আস্তে আমি বাংলা ব্লগস্ফিয়ারকে ভালবাসতে শুরু করলাম । নিজের লেখার সীমাবদ্ধতার কারনেই হোক আর পড়াশোনার চাপেই হোক , নিজে ব্লগিং এর কথা ভাবিনি কখনো । কিন্তু পরবর্তীতে ২০১২ সালে এসে Maruf ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে তারই অনুপ্রেরনায় সাহস করে একটা একাউন্ট খুললাম আমারব্লগে । এরপরে টুকটাক লেখার চেষ্টা করি , অন্যদের লেখায় মন্তব্য করি । ভাল লাগে ।

সময় কেটে যায় । চিন্তাধারা বিকশিত হয় । একটা সময় এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হল । পড়াশোনার চাপে অনলাইন থেকে নিজেকে বেশ গুটিয়ে নিলাম (যদিও কোথাও চান্স পাইনাই ) । তারপর ভর্তিপরিক্ষার পর আবার টুকটাক শুরু করলাম ।

২০১৩ আসল । যুদ্ধাপরাধীদের রায় দেয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে । ফেব্রুয়ারিতে কাদের মোল্লাকে যখন ফাসির বদলে যাবজ্জীবন দেয়া হল , তখনই BOAN এর পক্ষ থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবাদ ডাকা হয় , পরবর্তীতে যা গণজাগরণ নামে ইতিহাসের পাতায় ঠাই করে নেয় । এর পরে শুরু হল "পাবলিক খায়" খেলা । গণজাগরণ এবং ব্লগার - দুটি বিষয় যেহেতু ওতপ্রোতভাবে জড়িত - সেহেতু নিজেকে ব্লগার প্রমাণের জন্য আপামর জনগন উঠে পড়ে ব্যাস্ত হয়ে গেল ।

"Emo BOY Arko" নামের যে ছেলেকে কোনোদিন চাইনিজ ফন্টে ইংলিশ ছাড়া লিখতেই দেখা যায়নি - সেও রাতারাতি অভ্র নামিয়ে বাংলা লেখা শুরু করে নিজেকে ব্লগার দাবি করে বসলো । নিজের Work Tab টিতে শো করতে লাগলো "ব্লগার এন্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট" । "ছাগু" টার্মটির সাথে কোনও পুর্বপরিচয় না থাকলেও তার ওয়ার্কপ্রজেক্ট এ শো করে "ছাগু পুন্দানো" ! প্রজন্ম ব্লগ , আমার ব্লগ - প্রতিটা ব্লগের নতুন আইডীর সংখ্যা বাংলালিঙ্ক দরে বাড়তে লাগল । ব্লগ যেহেতু খুলেছি - কিছু না লিখলে চলে ? এদের ব্লগপোস্টের নমুনা, " হাই ব্লগারজ ! আম নিউ ইন ব্লগ ! গুড মর্নিং ! " এরকম অবস্থার মাঝে ব্লগে আজকাল রীতিমত "পোস্ট জ্যাম" লেগে থাকা স্টার্ট হল । প্রিয় ব্লগারদের লেখা পড়া যায়না ভিড়ের মধ্যে ।

কোনও লেখা প্রকাশিত হওয়ার ৩ মিনিটের মাথাতেই প্রথম পাতা থেকে হাওয়া । তারপরেও জিনিসটা ভাল ছিল । গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে চে গুয়েভারার টি শার্ট পড়ে সিসা বারে গিয়ে হুক্কা টানার চেয়ে ব্লগিং করা অনেক ভাল । মুক্তচিন্তার প্লাটফর্ম হল ব্লগ । তাই ব্লগে লোক বাড়লে দেশেরই লাভ ।

কিন্তু মাননীয় সরকার কি করলেন এর মধ্যে ? নিরীহ ব্লগারদের বিরুদ্ধে ধর্মবিদ্দেসের অভিযোগ তুলে তাদের ধরে রিমান্ডে নেয়া স্টার্ট করলো । চমৎকার ভাবে তৈরি হওয়া একটি প্ল্যাটফর্মকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিলেন তারা । প্রোফাইল ইনফো চেইঞ্জ করা তরুনদের নাম আবারো " emO bOy" হয়ে গেলো । তাদের স্ট্যাটাসে বাংলার পরিবর্তে আবারও চাইনিজ ফন্টে ইংলিশ দেখা যেতে লাগলো । সত্যি সেলুকাস ! কি বিচিত্র এই দেশ , কি বিচিত্র এই দেশের মানুষ ! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.