দুরের বস্তুকে কাছে দেখার যন্ত্রকে এক কখায় দূরবীন বলা হয়,তবে বর্তমানে দূরবীন শুধু দেখার কাজেই লাগে না দূরবীন এখন শুনতেও পায়,আমাদের চোখে যা অদৃশ্য বর্তমানের দূরবীন তাকে দেখতে পায় তবে এগুলি আলোকীয় দূরবীন না এগুলি হলো রেডিও,এস্ক-রে, গামা-রে দূরবীন। মহাকাশের খ-বস্তু থেকে আসা বর্নালীর যে অশংটুকু আমাদের চোখে দৃশ্যমান হয় তার মধ্যেই আলোকীয় দূরবীনের কারসাজি (এর মধ্যে বাইনোকুলারও পড়ে)।
আলোকীয় দূরবীন আবিস্কারঃ হ্যান্স লিপারশে নামের এক ব্যাক্তি চশমার লেন্স তৈরি করতেন। তিনি একদিন দু’টো লেন্সকে খানিকটা দূরতে একই সরলরেখায় ধরে একদিক থেকে তাকিয়ে দেখতে পান যে দুরের জিনিস কাছে দেখা যাচ্ছে। তবে এর পরে তিনি আর এই বিষয়ে এগোননি, তবে তার কাজটির কথা বিখ্যাত বিন্জানী গ্যালিলিওর কানে পৌছায়,এবং তিনি সাথে সাথে একটি চোঙার মধ্যে একটি উওল ও একটি অবতল লেন্স বসিয়ে তৈরী করে ফেললেন পৃথিবীর প্রথম দূরবীন,এটি 1610 সালের ঘটনা।
তিনিই প্রথম এই দূরবীন দিয়ে দেখেন যে চাঁদের পৃ্স্ঠ অমসৃ্ন,বহস্পতি গ্রহের বড় চারটি উপগ্রহ,রাতের আকাশে যে মিল্কিওয়ে দেখা যায় তা আসলে অসংখ্য তারা মেঘ,সূর্যে রয়েছে কালো কালো দাগ এই রকম আরো আনেক কিছু। তিনি এই সকল পর্যবেক্ষন থেকে ভূ-কেন্দ্রিক মতবাদ থেকে সরে সৌ্রকেন্দ্রিক মতবাদে এসে উপস্তিত হন।
আলোর প্রতিসরন ধর্মের উপর ভিত্তি করে গ্যালিলিওর দুরবীন তৈরী বলে একে প্রতিসরন (Refractor) দূরবীন বলে।
এরপর বিখ্যাত বিঞ্জানী নিউটন 1660 সালে অবতল আয়না ব্যাবহার করে প্রথম প্রতিফলন (Reflector) দূরবীন তৈরী করেন।
নীচে আমি এই দুই ধরনের দূরবীন নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথমে প্রতিসরন দূরবীনঃ এই ধরনের দূরবীনে দু’টি লেন্স ব্যাবহার করা হয়,অভিলক্ষ্য থাকে দীর্ঘ ফোকাস দূরত্বের একটি দ্বি-উওল লেন্স এবং অভিনেত্রে থাকে অল্প ফোকাস দূরত্বের আর একটি লেন্স এই লেন্সদুটি একটি টিউবের মধ্যে বসানো থাকে। তবে সেই সময় এই লেন্স ব্যাবহারের ফলে বস্তুর প্রতিবিম্বে অনেক ত্রুটি থাকতো যা সেই সময় সম্পূর্নভাবে দূর করা সম্ভব হতো না। জন জোলান্তে নামের একজন 1758 সালে অ্যাক্রোমাটিক লেন্স উদ্ভাবন করেন,তখন এই লেন্স ব্যাবহার করে এই ত্রুটি কিছুটা দূর করতে সক্ষম হন। তাছাড়া সেই সময় বড় আকারের লেন্স তৈরী করা কঠিন ছিল। পরবর্তীতে জোসেফ ফ্রনহুকার নামের একজন 1800 সালে 24 সেঃমিঃ ব্যাসের একটি অভিলক্ষ্য লেন্স তৈরী করে।
এর পরে তার একজন সহকর্মী 32.4 সেঃমিঃ ব্যাসের একটি প্রতিসরন দূরবীন তৈরী করেন গ্রীনউইচ মানমন্দিরের জন্য,এরই ধারাবাহিকতায় কেমব্রিজে স্হাপন করা হয় 38 সেঃমিঃ ব্যাসের আর একটি প্রতিসরন দূরবীন। ডিয়ারবোর্ন মানমন্দিরের জন্য আলভান ক্লার্ক নামের একজন তৈরী করেন 47 সেঃমিঃ ব্যাসের আর একটি প্রতিসরন দূরবীন,তিনি লিক মানমন্দিরের জন্য তৈরী করেন 91 সেঃমিঃ,এবং ইয়র্কস মানমন্দিরের জন্য তৈরী করেন 102 সেঃমিঃ ব্যাসের প্রতিসরন দূরবীন। এই সকল দূরবীনের সবকটিই তৈরী হয় 19 শতকের শেষের দিকে। এর চেয়ে বড় প্রতিসরন দূরবীন তৈরী না হবার কারন হলো প্রযুক্তিগত সমস্যা,যেমন লেন্স তৈরী করলে তা নিখঁত হয় না এবং প্রতিবিম্ব কিছুটা বিকৃত হয়ে যায়। এর ফলে পরবর্তীতে প্রতিসরন দূরবীনের জায়গায় প্রতিফলন দূরবীনগুলো প্রাধান্য বিস্তার করে,অবশ্য পরে লেন্স তৈরীর প্রযূক্তি আরো উন্নত হবার ফলে প্রতিসরন দূরবীনেরও ব্যাপক উন্নয়ন হয়।
বর্তমানে প্রতিসরন দূরবীনগুলো জ্যোতির্বিদ্যার কাজে ব্যাবহার করা হচ্ছে যেমন-তারাদের অবস্হান,প্যারালাক্স ইত্যাদি নির্ণয়ে।
প্রতিফলন দূরবীনঃ নিউটনের প্রতিফলন দূরবীন আবিস্কারের পর প্রতিসরন দূরবীনের বেশকিছু সীমাবদ্বতা দেখে বিঞ্জানীরা প্রতিফলন দূরবীনের প্রতি বিশেষভাবে আকৃস্ট হন। এবং 1783 ও 1789 সালে উইলিয়াম হার্সেল 122 সেঃমিঃ ও 48 সেঃমিঃ ব্যাসের দু’টি প্রতিফলন দূরবীন তৈরী করেন। সেই সময় দূরবীনের আয়নায় প্রতিফলক হিসাবে ব্যাবহার করা হতো স্পেকুলার ধাতু (কপার ও টিনের একটি সংকর)। 1842 ও 1845 সালে উলিয়াম পারসন্স তৈরী করেন 183 সেঃমিঃ ব্যাসের দূরবীন।
তবে তখন পর্যন্ত এই দূরবীনে প্রতিবিম্বের উজ্জলতা খুব কম ছিল। এরপরে উদ্ভাবন করা হয় রুপার প্রলেপ যুক্ত অবতল আয়না,এতে করে প্রতিবিম্বের উজ্জলতা বহুগুন বেড়ে যায়। এবং আবার পুনরায় বড় বড় প্রতিফলন দূরবীন বিভিন্ন মানমন্দিরে বসানো শুরু হয়। পালোমার মানমন্দিরে বসানো হল 200 ইঞ্চি ব্যাসের হেল দূরবীন,এবং এডুইন হাবল এই দূরবীন দিয়ে দেখেন গ্যালাস্কী গুলো দূরে সরে যাচ্ছে এবং এর থেকেই পরবর্তীতে বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রতিস্টিত হয়। বর্তমানে বিশ্বের অনেক মানমন্দিরে বড় বড় প্রতিফলন দূরবীন বসানো হয়েছে।
হাওয়াই দ্বীপের মউনা কিয়া পর্বতে মউনা কিয়া মানমন্দিরে কেক-1 ও কেক-2 নামের 8 মিটার ব্যাসের দুটি দূরবীন রয়েছে।
প্রতিফলন দূরবীনে প্রতিবিম্বকে যে কোন স্থানে বসানো যায় বলে,এই দূরবীনকে অনেক আধূনিক করা হয়েছে যার ফলে এখন এই দূরবীন দিয়ে অনেক আধুনিক গবেষনাও এর মাধ্যমে করা হয়। আধুনিক সব প্রতিফলন দূরবীনই নিউটনের উদ্ভাবিত দূরবীনের মতো,পার্থক্য শুধু এই যে আধুনিক দূরবীনগুলিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যাবহার করা হচ্ছে,এখন দেখি কত রকমের প্রতিফলন দুরবীন আছে।
নিউটোনিয়ানঃ এটি নিউটনের উদ্ভাবিত দূরবীনের মতো। একটি অবতল আয়না আলোকরশ্নিকে একটি বিন্দুতে মিলিত করে,এবং এই ফোকাস বিন্দুতে বসানো থাকে আর একটি সমতল আয়না এই আয়না আলোকরশ্নিকে বাইরে বসানো একটি অভিনেএতে (আই পিস)পাঠায়।
শৌখিন জ্যোতির্বিদদের কাছে এই দূরবীন বেশ জনপ্রিয়। এই নিউটোনিয়ান দূরবীনকে পরবর্তীতে আরো উন্নত করা হয়েছে। বিশ্বের আধুনিক দূরবীন তৈরীর বড় কারখানা হলো মিডি এই কারখানা উন্নত মানের নিউটনিয়ান প্রতিফলক দূরবীন তৈরী করে। যেমণ-4.5 ইঞ্চির f/8, 5 ইঞ্চি f/8, 10 ইঞ্চি f/4.5, 16 ইঞ্চি f/4.8 এই দূরবীনের কিছু আছে কম্পিউটার কন্ট্রোল গাইডেড সিস্টেম।
গ্রেগরিয়ান দূরবীনঃ 1663 সালে স্কটল্যান্ডের গনিতবিদ জেমস গ্রেগরী এই দূরবীন উদ্ভাবন করেন।
এবং 1673 সালে রবার্ট হুক এই দূরবীনের একটি মডেল তৈরী করেন। নিউটন প্রথম প্রতিফলন দূরবীন তৈরী করার 5 বছর পর এই দূরবীন তৈরী হয়। গ্রেগরী নিজে এই দূরবীন তৈরী করার অনেক চেস্টা করেন, কিন্ত তিনি ব্যার্থ হন। কারন তার কোন ব্যাবহারিক দক্ষতা ছিল না, তিনি এই দুরবীনের আয়না তৈরী করার জন্য কোন চশমার লেন্স তৈরী করতে পারে এমন কোন লোক খুজে পাননি। পরবর্তীতে হুক কাজ করার মতো এই রকম একটি দূরবীন তৈরী করেন।
এই দূরবীন দুইটি অবতল আয়না দিয়ে গঠিত। এর অভিলক্ষ্য (প্রাইমারী মিরর)আয়নায় আলোকরশ্নি এসে একটি ফোকাস বিন্দুতে মিলিত হয়। এই অভিলক্ষ্য আয়নার মাঝে একটি ছিদ্র থাকে এই ছিদ্র দিয়ে আলো দ্বিতীয় বা সেকেন্ডারী আয়নায় আসে এখানে একটি অবতল আয়না যা অভিলক্ষ্য আয়নার ফোকাস দূরত্ত্বের বাইরে বসানো থাকে। এবং এখান থেকে আলোকরশ্নি অভিলক্ষ্যের ছিদ্র দিয়ে বাইরে বেরিয়ে অভিনেএ (আইপিস) চলে আসে।
ক্যাসেগ্রাইনঃ 1672 সালে ফ্রান্সের গুইলাম ক্যাসেগ্রাইন এ ধরনের দূরবীন উদ্ভাবন করেন।
এটা গ্রেগরিয়ান দূরবীনের মতো,তবে এখানে সেকেন্ডারী হিসেবে ব্যাবহার করা হয় উওল আয়না যা পরাবৃত্তাকার আকৃ্তির এবং এটি বসানো থাকে অভিলক্ষ্য আয়নার প্রধান ফোকাসের ভিতরে। এই দূরবীন আকারে ছোট বলে বেশ জনপ্রিয়।
স্মিডট-ক্যাসেগ্রাইনঃ 1930 সালে বার্নহার্ড স্মিডট এই দূরবীনের নকশা প্রনয়ন করেন। দূরবীনের ক্ষেত্রে এই দূরবীন বিপ্লব সৃস্টিকারী,এ ধরনের দূরবীনের দৃস্টিক্ষেএ বেশ বড়। এই দূরবীনের বিশেষত্য হলো এতে প্রাইমারী আয়নার বক্রতার ব্যাসার্ধে একটি সংশোধনী লেন্স বসানো থাকে,এর ফলে প্রতিবিম্ব ক্রটিমুক্ত থাকে।
আকাশ পর্যবেক্ষনের কাজে এই দূরবীন বেশ উপকারী,এই দূরবীনের ফোকাস অনুপাতও বেশ ছোট হয়। যুক্তরাস্ট্রের জেমস গিলবার্ট 1950 সালে তৈরী করেন সুপার স্মিডট দূরবীন,এই দূরবীনে তিনি একাধিক সংশোধনী লেন্স ব্যাবহার করেন। স্মিডট দূরবীনে সেকেন্ডারীতে যদি ফটোগ্রাফিক প্লেট বসানো থাকে তখন তাকে বলা হয় স্মিডট ক্যামেরা। পালোমার মানমন্দিরে একটি 48 ইঞ্চির স্মিডট দূরবীন আছে। এই দূরবীনের সাহায্যে বিখ্যাত ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফী পালোমার অবজারভেটরী স্কাই সার্ভে’সম্পন্ন করা হয়েছিল।
মিডি দূরবীন কোম্পানীর 8,7,10,12 ইঞ্চির অত্যাধুনিক কম্পিউটার গাইডেড দূরবীন আছে।
কুড দূরবীনঃ আকাশ পর্যবেক্ষনের যে সব ভারী যন্রপাতি যেমন-স্পেক্ট্রোগ্রাফ প্রভৃতি ব্যবহার করার দরকার হলে মানমন্দিরগুলোতে এই ধরনের দূরবীন ব্যবহার করা হয়। এই দূরবীনের প্রতিবিম্ব সৃস্টি করা হয় দূরবীনের মেরুঅক্ষ বরাবর,ফলে পৃথিবীর ঘূর্ননের ফলে আকাশের তারাদের অবস্হান পরিবর্তন হলেও দূরবীনের সামনে তারাদের অবস্হান স্হির থাকে। এবং পর্যবেক্ষক একই জায়গায় বসে দূরবীনকে না ঘুড়িয়ে পর্যবেক্ষন করতে পারে। প্রায় প্রতিটি মানমন্দিরের দূরবীনে এই ধরনের ব্যবস্হা রাখা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে একই দূরবীনকে কখনো ক্যাসেগ্রাইন হিসেবে আবার কখনো কুড হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
এইতো গেলো আলোকীয় দূরবীন এছাড়াও আছে রেডিও,সৌ্র,অবলোহিত,গামা,এক্স-রে দূরবীন। এ সর্ম্পকে পরবর্তীতে আলোচনা করবো।
ছবি সৌজ্যন্যে গুগল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।