আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহবাগের পাশে, মুক্তচিন্তার পাশে কোলকাতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কোলকাতা

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি বাংলাদেশে আছড়ে পড়ছে গণ আন্দোলনের ঢেউ। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা লাখে লাখে জমায়েত হয়েছেন ঢাকার শাহবাগে, জমায়েত হয়েছেন সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, যশোর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া সহ দেশের সর্বত্র। দাবী মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক গণহত্যাকারীদের ন্যায় বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, দাবী মৌলবাদকে শিকড় শুদ্ধ বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎপাটন করা হোক। প্রবাসী বাংলাদেশীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের সহমর্মিতায় জারী রেখেছেন বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে আন্দোলন কে কেন্দ্র করে এসেছে কবিতা, গান, ছবি, তথ্যচিত্রসহ বিভিন্ন সৃজনধর্মী কাজের এক জোয়ার।

মূলত তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ, দেশের বিশিষ্ট জনেরা। পাশাপাশি এই আন্দোলন আবার মুখোমুখি হয়েছে জামাতে ইসলামি সহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের তীব্র বিরোধিতার। ভাঙচুর, বন্‌ধ, হত্যার মধ্য দিয়ে তারা রুখতে চাইছেন আন্দোলনের গতি, স্থিমিত করে দিতে চাইছেন এর দাবী গুলিকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক গণতান্ত্রিক এক দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন আর মৌলবাদকে টিকিয়ে রেখে কায়েমী স্বার্থসিদ্ধির অভিলাষ এক মুখোমুখি সংঘর্ষে সামিল আজকের বাংলাদেশে। ১৯৫২ র ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের সেই ফেব্রুয়ারী মাসেই আত্মপ্রকাশ করল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত এবারের এই আন্দোলন।

৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ একটি রায় বেরোয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধগুলির বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালের। সেই রায়ে ’৭১ এর ঘৃণ্য ঘাতক আব্দুল কাদের মোল্লাকে প্রত্যাশিত মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার নামে অভিযোগ ছিল কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুন্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষের হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকা, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধের। এইসব মারাত্মক অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হবার পরও ঘাতককে সর্বোচ্চ শাস্তি না দেবার এই রায়কে বাংলাদেশের জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। ট্রাইবুনালের রায় প্রকাশের পরেই বিক্ষুব্ধরা প্রতিবাদ জানাতে জমা হন ঢাকার শাহবাগ চত্বরে।

প্রথমে বিভিন্ন ব্লগ ও সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমেই ডাক দেওয়া হয় প্রতিবাদের। পরে সংগঠিত গণমাধ্যমগুলিও এর সমর্থনে দাঁড়ায়। দ্রুতই বাড়তে থাকে প্রতিবাদ ও তার অভিঘাত। ঢাকার শাহবাগ চত্বর সহ গোটা দেশ সমস্ত স্তরের মানুষের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভে প্লাবিত হয়ে যায়। শাহবাগেই জমায়েত সংখ্যা পাঁচলক্ষ ছাপিয়ে যায়, জনপ্লাবনে ভেসে যায় সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, যশোর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া সহ গোটা বাংলাদেশের বিক্ষোভ কেন্দ্রগুলি।

পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির প্রক্রিয়া ও চলমান আন্দোলনকে রুখতে সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়েতে ইসলামি সহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন, বাংলাদেশে যাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিপত্তি যথেষ্ট। এতদ সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ বর্তমানে বাংলাদেশকে এক যুগসন্ধিক্ষণে এনে দিয়েছে। বিচারের একটি রায়কে উপলক্ষ্য করে যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তা নিয়ে আন্দোলন সংঘর্ষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেহারাকে নতুন করে নির্মাণ করতে আজ উদ্যত হয়েছে। ’৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিল অজস্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার করুণ ঘটনা, শত সহস্র নারীর লাঞ্ছনার বেদনাদায়ক ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্থানের একদল মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্থানের পক্ষ নিয়ে এই অপরাধ সংগঠিত করেছিল।

দেশদ্রোহী এই মানুষগুলিই, যারা মূলত ছিল জামায়েতে ইসলামি ও তার বিভিন্ন গণ সংগঠনের সদস্য, সমর্থক; বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ নামে কুখ্যাত। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেবার জন্য স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে একটি আইন তৈরি হয়। কিন্তু অচিরেই রাজনৈতিক পালাবদলের সূত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াটি স্থগিত হয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর বাড়িতে কয়েকজন সেনাকর্তার ষড়যন্ত্র ও আক্রমণে সপরিবার খুন হন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব জামায়েতে ইসলামিকে পুনরায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈধতা দেন এবং তাদের সঙ্গে জোট সরকারও গঠন করেন।

স্বাধীনতার পরে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রর জায়গা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেন সামরিক শাসক এরশাদ। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতির একটা ভালো অংশের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে জামায়েতে ইসলামির মত মৌলবাদী সংগঠন। এই পরিস্থিতিতে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটিকে ১৯৯২ সালে কিছুদিনের জন্য হলেও সামনে নিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। এই শাহবাগের পাশেই বসেছিল তাঁর প্রতীকী গণ আদালত। কিছুদিন আলোড়নের পর বিচার নিয়ে আবার স্থিতাবস্থার পর্ব চলে প্রায় দু দশক।

শেষপর্যন্ত বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতার মসনদে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আসীন হবার পর ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল। চোরা স্রোতের মত বহমান মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘাতকদের উপযুক্ত শাস্তির দাবী আবার স্ফীত হয়। অবশ্য বাংলাদেশের বর্তমান গণ জাগরণ শুধু মুক্তিযুদ্ধের অতীত কলঙ্কগুলির ক্ষত মোচনের পরিসরেই সীমাবদ্ধ নয়। বস্তুতপক্ষে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনকারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হয়ে ডাক দিয়েছে জামায়েতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করার, বাংলাদেশের সমাজ রাজনীতি থেকে মৌলবাদি আস্ফালনকে উৎপাটন করার। ডাক দিয়েছে এক আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার।

তরুণ প্রজন্মের এই আহ্বান, তাঁদের দৃঢ় মতাদর্শ ও শাণিত উপস্থাপণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলিকেও বাধ্য করেছে স্পষ্ট অবস্থান নিতে। শাসক আওয়ামী লিগের গরিষ্ঠ অংশ জামায়েতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করা সহ একাত্তরের ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাপারে মত প্রকাশ করেছেন। তাদের নেতৃত্ব শাহবাগ চত্বরে হাজির হয়ে আন্দোলনের প্রতি সংহতিও ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের বামপন্থী, প্রগতিশীল শিবির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী এই আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে সামনের সারিতে আছে। অন্যদিকে স্বাভাবিক ভাবেই জামায়েতে ইসলামি ও তাদের সমর্থক দলগুলি দাঁতে নখে আন্দোলনের বিরোধিতা করছে।

আন্দোলন ভাঙতে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে তারা সক্রিয় হয়েছে। বন্‌ধ, হামলা, আন্দোলনকারীদের খুন জখমের মধ্য দিয়ে তারা বার্তা দিতে চাইছে। একাত্তরের স্মৃতিকে উসকে দিয়ে তারা হত্যা করেছে আন্দোলন সমর্থকদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনের শিবির গুলিতে চলছে তাদের সশস্ত্র হামলার চেষ্টাও। প্রধান বিরোধী দল বি এন পি প্রথম দিকে আন্দোলনকে সমর্থন করলেও দ্রুতই তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে এবং নিজের নির্বাচনী জোটসঙ্গী জামায়েতে ইসলামির সদস্য সমর্থকদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ইত্যাদির বিরোধিতাতেই নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে।

সমর্থন করেছে জামায়েতে ইসলামির সমর্থক দলগুলির ডাকা ধর্মঘট। কোলকাতাতে জামায়েতে ইসলামির সমর্থকরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে। অন্যত্রও তারা তাদের শক্তি সমর্থনকে সংহত করে নিজেদের মৌলবাদী আস্ফালনকে বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগ আন্দোলনের বিষয়টি তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপার হিসেবেই আর সীমায়িত থাকছে না, দাবী করছে বাংলাদেশের বাইরেও মৌলবাদ বিরোধি মানুষের সমর্থন সংহতি। কোলকাতার নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে এখনো যথেষ্ট সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেন নি।

কিন্তু বাংলাদেশের সমস্ত স্তরের মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম বিভিন্ন আক্রমণ ও প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে যে দৃঢ়তা ও আবেগের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, তা আশা জাগায় মৌলবাদী আস্ফালনকে পরাস্ত করে মুক্তবুদ্ধি ও গণতন্ত্র এই উপমহাদেশে আরো প্রসারিত হবে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।