গত শুক্রবার ৩ বারের মতো গেলাম মাধবকুন্ড আর জাফলং এ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার মাধ্যমে নিজের মন প্রান আর আত্মটাকে সতেজ করা আর সঙ্গীদের সময় দেয়া দুটোই চলে একসাথে।
জাফলং এ প্রথম গিয়েছিলাম ২০০৩ সাথে এরপর ২০০৭ সাথে। আর মাধবকুন্ডে প্রথম গেলাম ২০০৬ সাথে এরপর ২০০৭ সাথে। এরপর সিলেটে বিভিন্ন কাজে গেলেও এই দুই জায়গায় আর যাওয়া হয় নাই।
কিছু বন্ধু বান্ধব আর ছোট ভাইয়েরা তাদের সাথে স্টাডী ট্যুরে যাওয়ার জন্য ধরলো । কিছুটা ব্যস্ততা থাকলেও মিস করতে ইচ্ছে করলো এই সুন্দর দুটি জায়গা। তাই আর মিস না করে সিন্ধান্ত নিয়ে ফেললাম ।
রাত ১২ টায় রওয়ানা হয়ে ভোর ৫.৩০ টায় চলে গেলাম মাধবকুন্ড। ফ্রেস হয়ে নামাজ পড়ে হালকা নাস্তা সেড়ে মাধবকুন্ড ইকোপার্কে ঢুকার তোরজোড় শুরু হলো।
চা বাগান:
আমরা প্রায় ৫৫ জন। মাধবকুন্ড নেমেই মনকে কেমন খারাপ হয়ে গেল। আশে পাশের চা বাগানের আগের সেই সৌন্দর্য্য চোখে পড়লো ন। চারিদিকের সবুজতায় শীতল হলো না চোখযুগল। শীতের শেষ দিকে এসে চা বাগানের সবুজ পাতাগুলো পরবর্তি বছরের জন্য কেটে ফেলার কারণে আগের সবুজের মায়াময়তা চোখে পড়লো না বলে কিছুটা কষ্ট লাগলো।
সবকিছু কেমন যেন মলিন মলিন লাগছিলো।
আগে যেমন চোখ শুধু চেয়ে থাকতে চাইতো কিন্তু এবার সে চোখ যেন বারবার ফিরে আসছে। পাহাড় ঘেরা সবুজ সৌন্দর্য্য না পেয়ে মনটা ব্যথিত হচ্ছিল।
অগোছালো মাধবকুন্ড ইকোপার্ক:
সবাই মিলে ভিতরে ঢুকলাম। দু একটি ফটোসেশন সেড়ে সবাই মুল আকর্ষন ঝর্না দেখতে ছুটছিলো।
আমাদের সাথের আরো কয়েকজন মিলে আশপাশটা দেখে অগ্রসর হচ্ছিলাম ধীরে ধীরে। যেহেতু আগেও দুইবার এসেছি তাই আগ্রহটা আগের তুলনায় কম। পূর্বের তুলনায় পরিবর্তন বা যেসব অসংগতি চোখে লাগার মতো তা হলো ..............
* রাস্তাটা পাকা হয়েছে
* রাস্তার সাইডে রেলিং দেয়ার কাজ চলছে
* পাহাড়ের উপরে উঠার রাস্তাগুলো অধিকাংশই বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
* চারপাশে সবুজের মায়াময়তা হারিয়ে যাচ্ছে
* নিরাপত্তার কোন বালাই নেই, নিরাপত্তার দেয়ার কোন লোকই চোখে পড়লো না।
* ঝর্নার পানিতে নামা বা নেমে গোসল করা সম্পর্ন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে
* ঝর্নার পানির স্থানের বড় বড় পাথরগুলো সড়িয়ে ফেলে অর্ধেক সৌন্দর্য্য ম্লান করে দেয়া হয়েছে।
* জরিমানা করা হবে লেখা আছে কিন্তু জরিমানা করার বা আদায়ের কোন লোক নাই।
* সব কিছু অপরিস্কার - অপরিচ্ছন্ন, বহুদন মনে হয় পরিস্কার হয় না।
* কেউ বিপদের পড়লে উদ্ধার করার কোন লোক পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
* ঝর্নার গতি কমে গেছে , পানি ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে কিন্তু পানিগুলো খুব অপরিস্কার , ময়লা আবর্জনায় পরিপূর্ন।
* ছাত্রদের জন্য নামমাত্র মূল্য রাখার জন্য সুস্পষ্টভাবে বোর্ডে লিখা রয়েছে কিন্তু কোন কর্মকর্তা পাওয়া আকাশের চাদের মতো যার নিকট থেকে অনুমোদন পাওয়া যাবে
এতোসব কিছুর মাঝেও একটু পরিচর্যা , তত্ত্ববধায়ন আর চেষ্টা থাকলেই এই স্থানকে বিশ্বের যে কোন স্থান থেকে আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিনত করা সম্ভব।
পাশাপাশি পর্যটন শিল্প থেকেই অর্জন করা সম্ভব অনেক অর্থ। যা দেশের মূল অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলবে নিসন্দেহে।
যা করা সম্ভব এবং দরকার:
ঐ জায়গায় আটকা পড়লে উদ্ধারের কোন লোক নেই...........
১. পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার। এজন্য অন্তত ১০ জনের টুরিস্ট পুলিশ বা আনসার রাখা যেতে পারে
২. পাহাড় থেকে পাহাড়ে ছুটে চলার জন্য আর উপর থেকে সৌন্দর্য্য দেখার জন্য ক্যাবল কার করতে পারলে উপভোগ্য হতো
৩. পাহাড়ের উপরের ওয়াচ টাওয়ারকে আরো উচু করা এবং উপরের উঠার সুব্যবস্থা করা যেতে পারে।
৪. বাধা থাকালেও সবাই ঝর্নায় উঠতে চায় তাই সেখানে পৌছার জন্য পাহাড়ের গায়ে সিড়ি করলে রিস্ক অনেক কমে যাবে এবং এডভেঞ্চার পিয়াসীরা তুপ্ত হবে
৫. নিয়মিত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা অব্যহত রাখলে আকর্ষন আরো বৃদ্ধি পাবে
৬. আধুনিকতার ছোয়া দিতে গিয়ে প্রকৃতিকে নষ্ট করা নয় প্রকৃতির সৌন্দর্য্যকে রক্ষা করার জন্য আন্তরিক হতে হবে বণ বিভাগ আর পর্যটন বিভাগকে।
৭. উপরে উঠা নামার জন্য সুব্যস্থা রাখা পাশাপাশি উঠা নামায় কারো বিপদের উদ্ধার টিম রাখা
৮. আশেপাশে হোটেল মোটেল বা রেস্ট হাউজ তৈরী এবং রাতে অবস্থানের থাকার উপযোগীতা তৈরী করলে পাহাড়ের গায়ে অবস্থানের রোমাঞ্চ নেয়া অনেকেরই সম্ভব।
এজাতীয় উদ্যোগ নিতে পারলে পর্যটন শিল্পকে যেভাবে ভালো করা সম্ভব তেমনি ভ্রমনপিয়াসুদের মন ভরবে ............ রোমাঞ্চ আর এ্যাডভেঞ্চার পাওয়া যাবে ভ্রমন করে।
আমাদের ভ্রমন বাহিনীর অধিকাংশই উঠে গেল সুউচ্চ পাহাড়ে। যদিও শুরুতে পাহারের চূড়ায় উঠবে কিনা তা নিয়ে দ্বিধা দ্বন্ধে ভুগছিলো সবাই । কিন্তু আমার কয়েকজন কিছুটা উঠা শুরু করলে বাকীরা পিছুপিছু উঠে গেল ।
আর আমরা কয়েকজন কিছুদূর উঠে ফিরে আসলাম নিচে। ....... যেহেতু আমি এবার ৩য় বার আসলাম তাই উপরে যাওয়ার শখটা তেমন কাজ করছিলো না। তবে বুক ধকধক করার কথা নাই বললাম। আবার কয়েকজন কিছুদূর থেকেই এ্যাডভেঞ্চারকে ভয়ে রূপান্তরিত হয়ে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে থাকা গাছ গাছরার সহায়তায় নিচে নেমে আসলো।
যারা কষ্ট করে উপরের উঠলো তারা ঝর্নার উৎপত্তির স্থলের কাছাকাছি গিয়ে উপর থেকে আনন্দ প্রকাশ করছিলো।
আর নিচে দাড়িয়ে দাড়িয়ে আমারা গল্প মারছিলাম আর মাঝে মাঝে ফটোসেশনে পোজ দিচ্ছিলাম। কাউকে আবার নিচ থেকেই নিচে নামার রাস্তা নির্দেশনা দেয়ার কাজ করছিলাম ।
কত সুন্দর .................
একে একে অনেকেই নেমে আসলো কিন্তু বিপদে পড়লো ৫/৬ জন। তারা নামার সহজ রাস্তাটা ব্যবহার না করে ঝর্নার একটু পাশের খাড়া পথটা দিয়ে নামার চেষ্টা করলো কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু কিছুদুর নেমে আর উপায় ছিলো না উপরে যাওয়ার ....... বাধ্য হয়ে নামতে হচ্ছিল নিচেই কিন্তু প্রায় ৩০ মিনিট চেষ্টার ফলে অল্প কিছুদূর নামতে পারলো তারা।
একজনতো পড়েই যাচ্ছিল কিন্তু কলাগাছের সাথে বাধা পাওয়ায় বড় ধরণের কোন বিপদ থেকে রক্ষা পেলো সে সহ আমরা সবাই...........
সবাই নিচে নামার পর ফিরার পথ ধরলাম। বাহিরে এসে সাত কালারের চা খাওয়ার ইচ্ছা জাগলো । কিন্তু সময় কুলাবে না তাই অর্ডার দিয়েও গলধ গ্রহন না করেই চলে আসলাম।
সকাল ১০.০০ টায় মাধবকুন্ড ত্যাগ করে ছুটে চললো আমাদের দল জাফলং এর উদ্দেশ্যে........
পথে আমরা দুজন ( আমার সাথের সিলেটি বন্ধু) জকিগঞ্জকে গন্তব্য বানিয়ে নেমে গেলাম বিয়ানীবাজারে। ......... সেখানে দেখলাম সুরমা , কুশিয়ারা আর বারাক নদীর উৎপত্তি স্থল।
সিলেটের ভবিষ্যতের কান্না টিপাইমুখ বাধ নিয়ে আরেক জায়গায় বলবো। .
সিলেটি বন্ধুর পরিচিত একটি মটর সাইকেলে আমরা তার বাড়ী, টিপাইমুখের স্থান দখে মটর সাইকেলে ১০০ কিমি ড্রাইভ করে যখন সিলেট শহরে প্রবেশ করলাম তখন বিকাল ৪.০০ টা বাজে। দ্রুত একটি বাসে চেপে বসলাম আমরা দুজনসহ নতুন সঙ্গী ২ জন মোট ৪ জন।
জাফলং পৌছলাম সূর্যিমামা চলে গেছে নতুন কোন দেশে । তার দেখা আমরা পেলাম গাড়ীতেই , তাকে আর পাওয়া সম্ভব হলো না কারণ তখন তো মাগরিবের আজান হচ্ছিল।
একটু ঘুরাঘুরি , হালকা কিনাকাটা , রাতের খাবারের ব্যসস্থা করে গাড়ীতে উঠার আগেই জাফলং এর পরিবেশ আর বর্তমান অবস্থায় অনেকটা বিষিয়ে উঠছিলাম।
জাফলং এর পরিবর্তন আর অবহেলা:
* গাড়ী পার্কিং এর সুব্যবস্থা নেই
* পাথর কাপার শব্দে এলাকা প্রকম্পিত আর ধুলামলিন
* অপরিকল্পিত পাথর ভাঙ্গার কারখানার জন্য পরিবেশ তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য হারিয়েছে।
* আগের মতো নদীতে পাথর উত্তোলন হচ্ছেনা । এটা ভালো নাকি খারাপ হয়েছে আমার বোধগম্য নয়
* সন্ধ্যার পরে থাকার মতো নিরাপত্তা বা সুব্যবস্থাও নেই।
* প্রচুর পর্যটকের আগমন হওয়া সত্তেও দু চারটি হোটেল ছাড়া খাবারের ভালো ব্যবস্থা নেই।
* রাস্তার অবস্থা আগের চেয়ে খারাপ
* বেশ কয়েকটি হোটেল ও পিককিন স্পট তৈরী হচ্ছে কিন্তু যা অনেক দূরে দূরে।
* তামাবিল ও স্থল বন্দর সহ এলাকার উন্নত করার কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
যে সব ব্যবস্থা গ্রহন করা উচিত:
* নদীর পানিতে গোছল করা এবং আশে ভ্রমনের জন্য সুব্যবস্থা করা দরকার
* পাথর কাটার যন্ত্রগুলো পর্যটন এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া দরাকার
* পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য বিজিবির পাশাপাশি পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা দরকার।
* পাথর শিল্পকে ব্যবহার করে আরো আকর্ষনীয় করা উচিত জাফলং এলাকাকে।
জাফলং সময় কাটানোর অনেক জায়গা রয়েছে মনটা সতেজ হবে যার এখনো যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেননি তারা অতিশীঘ্র ঘুরে আসবেন এই আহবার রইল।
এখানে গিয়ে দেখলাম কিভাবে ভারত আমাদের জন্য প্রাকৃতিক দেয়াল তৈরী করে রেখেছে। বিশাল পাহাড় পার হয়ে ওপাশে যাওয়ার রাস্তা তো বন্ধ। তবে পাহাড় থেকে নেমে আসার পানির সাথে পাথর আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে দাড়িয়েছে।
পরিশেষে:
অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শন সমৃদ্ধ বাংলাদেশে অনন্য ও আন্তর্জাতিক মানের প্রচুর পর্যটন পণ্য রয়েছে। একটি দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্য আর বৈচিত্র্যময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের ক্ষেত্রে পর্যটন অপরিহার্য নিয়ামক।
পর্যটনকে কেন্দ্র করে অর্থনীতির বিকাশ ঘটিয়ে ইতোমধ্যে বিশ্বের অনেক দেশ প্রমাণ করেছে ‘পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি’। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসাব মতে
*সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৭৫ শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে।
* তাইওয়ানের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ,
* হংকংয়ের এর ক্ষেত্রে পরিমান ৫৫ শতাংশ,
* ফিলিপাইনের ক্ষেত্রে এর পরিমান ৫০ শতাংশ,
* থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে তা প্রায় ৩০ শতাংশ
* মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। * মালয়েশিয়ার বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ৭শতাংশই আসে পর্যটন খাত থেকে।
বাংলাদেশকে সারা বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল ১০টি পর্যটন মার্কেটের একটি হিসাবে ভাবা হচ্ছে।
মাধবকুন্ড এবং জাফলং হতে পারে তার সম্ভবনাময় স্থানগুলো অন্যতম।
আশাকরি সরকারসহ দায়িত্ববান ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সম্ভবনাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন। পাশাপাশি আমাদের সচেতন নাগরিকদেরও সচেষ্ট হওয়া জরুরী।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
বি:দ্র: কয়েকটি ছবিতে তারিখ ২০০৮ সালের হলেও এগুলো কিন্তু তুলা গত শক্রবারই.......... ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।