সীমান্তে সহনশীলতা ও মানুষের সম্প্রীতি
ফকির ইলিয়াস
=========================================
আবারো কথার আগুন ছড়িয়েছেন ভারতের বিএসএফের মহাপরিচালক ইউকে বানসাল। ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের প্রধান বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তে তার বাহিনী গুলি চালানো বন্ধ করবে না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, সীমান্তে অপরাধীদের থামাতে আমাদের ব্যবস্থা নিতেই হবে।
গেলো মঙ্গলবার রাতে রেডিও বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিএসএফের মহাপরিচালক ইউকে বানসাল বলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি চালানো পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তিনি বলেছেন, যতোক্ষণ ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ সীমান্তে অপরাধমূলক কাজ হতে থাকবে, ততোক্ষণ সেই অপরাধ আটকাতেই হবে বিএসএফকে, সেটাই বাহিনীর দায়িত্ব।
বানসাল এ মন্তব্য করেছেন এমন এক সময় যখন সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে বাংলাদেশীদের ওপর হত্যা-নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে।
আমরা দেখেছি, বলপ্রয়োগ আর গুলি চালিয়ে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করার অনেক অভিযোগ আছে বিএসএফের বিরুদ্ধে। ফেলানিকে হত্যা করে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। হাবিবকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন করেছে বিএসএফের সদস্যরা।
এসব ঘটনায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিএসএফকে ট্রিগার হ্যাপি ফোর্স বা বন্দুকবাজ বাহিনী বলে আখ্যা দিয়েছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলেছেন, চোরাচালান এমন অপরাধ নয়- যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড হতে পারে, আর বিএসএফ আদালত নয়। তাদের বিচার করার ক্ষমতাও নেই। বিএসএফ কাউকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করতে পারে, কিন্তু তাদের গুলি চালনা অবৈধ ও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অপরাধ।
দেশে-বিদেশে এই প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান বলেছেন, সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকা- কখনই মেনে নেয়া যায় না।
তিনি বলেন, এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে প্রয়োজনে আমরা জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বিষয়টি উত্থাপন করবো। তাছাড়া এ বিষয়ে ইতোমধ্যে আমরা ভারতের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। তাকে বলেছি- কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে কিভাবে সীমান্তে হত্যা বন্ধ করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে।
তিনি আরো বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হয়েছে। আর সেই মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে স্বাধীন দেশে মানবাধিকারের অগ্রযাত্রা বেগবান করা সম্ভব নয়।
ভারত-বাংলাদেশ সম্প্রীতি বাড়াতে চাইলে দুদেশের মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়াতে হবে। আমরা জানি, একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশগুলের মধ্যে সংঘাত প্রতিঘাত ছিল কিন্তু তারা নিজেদের স্বার্থে সম্প্রীতি গড়ে তুলেছে এবং একই মুদ্রা চালু করেছে। আমাদের সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যেও সে রকম আন্তরিকতার পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। অথচ আমরা দেখি, সার্ক সম্মেলনগুলোতে আমাদের নেতারা বড় বড় ওয়াদা প্রতিবারই করেন।
বাংলাদেশ-ভারতের কিছু পুরোনো ইস্যু এখনো রয়ে গেছে।
তা অনেক আগেই সমাধান করা উচিত ছিল।
তিস্তার পানিবণ্টন, তিনবিঘা করিডোর, সমুদ্রসীমাসহ বিভিন্ন অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। যেগুলোর মীমাংসা হওয়া জরুরি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফর করে গেছেন কিছুদিন আগে। এই দেশের জনগণ সম্পর্কে খুবই ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন বলেও তিনি জানিয়েছেন।
অথচ তার সফরের সময় পানিচুক্তিটি হয়নি। এখনো ঝুলে আছে। এভাবে ঝুলিয়ে রেখে প্রতিবেশীর প্রতি কতোটা দায়িত্ব পালন হয়, তা ভেবে দেখা দরকার।
তা ছাড়া বহুল আলোচিত ট্রানজিট চুক্তিটিও হবে দুদেশের স্বার্থরক্ষা করেই। ট্রানজিট নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে এর বিরোধিতাকারীরা।
ঢাকায় এসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোলাখুলি বলেছিলেন, ট্রানজিটের মাধ্যমে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম পরিবহনের কোনো সুযোগ নেই। তার এ বক্তব্যের পর আশা করা হয়েছিল অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার এই উদ্যোগটি সম্পর্কে অহেতুক সকল সন্দেহের অবসান ঘটবে। কিন্তু তা এখনো কার্যকারিতার মুখ দেখেনি।
তিস্তা চুক্তিটি দেশের উত্তরবঙ্গের কৃষির অগ্রযাত্রার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাক্সিক্ষত ফসল উৎপাদনে সফল হতে পারলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তাও বৃদ্ধি পাবে।
তাই দুদেশের চুক্তি সম্পন্নের পর তার বাস্তবায়নও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বাংলাদেশের মানুষ সবসময়ই প্রত্যাশা করছেন, দুদেশের সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সম্পর্ক অটুট থাকবে এবং সাংস্কৃতিক বন্ধন আরো শক্তিশালী হবে।
জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, টিপাইমুখ বাঁধ ইস্যুতে সমীক্ষা টিমে বাংলাদেশের প্রতিনিধি রাখার দাবি বাংলাদেশ ভারতের কাছে জানিয়েছে। কাজটি সেভাবেই করা উচিত।
আমরা অতীতে দেখেছি, সীমান্তে হাট বসেছে।
বাজার করেছেন স্থানীয়রা। এগুলো সবই সম্প্রীতির লক্ষণ। দুই রাষ্ট্রের সহনশীলতা বাড়লে এই সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য আরো বাড়বে সন্দেহ নেই।
কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের গ্লোবাল পোস্ট নামের একটি গণমাধ্যমে বাংলাদেশ সীমান্তকে ‘মৃত্যুর দেয়াল’ বলে মন্তব্য করে বলা হয়েছে- ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সীমান্তের চাইতে ভয়াবহ। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০১০ সালের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছিল, হত্যা-মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে ভারতের বিএসএফের বিচার হওয়া উচিত।
কিন্তু তারপরও দুদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগী হয়নি। কেন হয়নি?
বাংলাদেশকে কেউ তাদের তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারবে না। এই দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, পতাকা-মানচিত্র সমুন্নত রাখতে এই প্রজন্ম আগের মতো সব সময়ই শির উঁচু করে এগিয়ে যাবে। মনে রাখা দরকার কোনো আগ্রাসনই বাঙালি জাতিকে রুখতে পারেনি। কারণ বাংলাদেশের মানুষ সকল সম্প্রীতিতে সবসময়ই আস্থা রাখেন।
৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১২
-----------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১২ শনিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।