আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমান্তে অসহায় বাংলাদেশ

সকালের মিষ্টি রোদ পেরিয়ে আমি এখন মধ্যগগনে,

সিলেট সীমান্তে বাংলাদেশের ভূমি দখল করতে মরিয়া ভারত। আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তি এবং আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার ১০ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কৃষিজমি দখল করে চলেছে ভারতীয় নাগরিকরা। মীমাংসিত এ সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাংলাদেশের ভূমি দখলের পক্ষে ভারত নতুন নতুন যুক্তিও উত্থাপন করছে। দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা লঙ্ঘন করে নোম্যান্সল্যান্ডে স্থাপনা তৈরি করছে বিএসএফ। সীমান্ত পিলার ঘেঁষেই গড়ে উঠছে ভারতীয় বসতি।

বাংলাদেশের ভূমিতে ভারতীয় এ আগ্রাসনে নিরূপায় এখন সিলেট সীমান্তবাসী। ভারতীয় দখলদারদের কবল থেকে নিজেদের ভূমি রক্ষা করতে গেলে প্রতিনিয়ত ভারতীয়দের আক্রমণের শিকার হচ্ছে তারা। আর নিজ দেশের ভূমি রক্ষায় শপথ নিয়েও সশস্ত্র প্রতিরোধে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা থাকায় দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বিডিআর। নিজেদের ভূমি ভারতীয়রা দখল করে চললেও এসব দেখেশুনে মনে হয়েছে সীমান্ত নিয়ে যেন অসহায় বাংলাদেশ। সিলেটের উত্তেজনাপূর্ণ জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট এলাকা সরেজমিন ঘুরে সীমান্তের বাংলাদেশী, বিডিআর এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

স্থানীয় জনসাধারণ, বিডিআর এবং প্রশাসনিক সূত্র জানায়, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর সীমান্তে ভারতীয়রা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ভূমি দখল শুরু করে। তারা বিএসএফের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ১০ কিলোমিটার সীমান্তের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিন জমি দখল করে চাষাবাদ করছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি জৈন্তাপুরের মুক্তাপুর এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে ঢুকে টহলরত বিডিআর সদস্যদের ওপর গুলিবর্ষণ এবং এক জওয়ানকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে সিলেট সীমান্তে ভয়ভীতি ছড়ায় বিএসএফ। গত মার্চের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ডিবির হাওর ও কেন্দীবিলে মাছ ধরার মাধ্যমে দখলি অভিযান শুরু করে। জুন মাসে সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশী কৃষক, শ্রমিকদের ওপর বিচ্ছিন্ন হামলা ও গুলিবর্ষণ এবং কৃষিজমি দখল সীমান্তের ভূমি দখল শুরু হয়।

আর চলতি মাসে গরু লুটপাট এবং সীমান্তের ১০০ থেকে ৩০০ গজ ভেতরে প্রবেশ করে জমি দখল ও চাষাবাদের ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েন সীমান্তের কৃষক। এদিকে সিলেট সীমান্তে বাংলাদেশের ভূমি দখলে ভারতের দাবি এবং বেপরোয়া অভিযানের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক সূত্র জানায়, সিলেটের জৈন্তাপুর-গোয়াইনঘাট সীমান্তে বসবাসকারী খাসিয়া সম্প্রদায়ের একটি অংশ ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির সময় পূর্ব পাকিস্তানের এলাকা ছেড়ে ভারতীয় অংশে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে খাসিয়া সম্প্রদায়ের ভারতে যাওয়া অংশ পাকিস্তানে ফেলে যাওয়া সীমান্ত সংলগ্ন জমি চাষাবাদের দাবি জানায়। জানা যায়, বিরোধ মেটাতে ভারত পাকিস্তান জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং কমিটি হয়। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সরকার সিলেট সীমান্ত ছেড়ে যাওয়া খাসিয়াদের ভূমি ফেরত পেতে পাকিস্তান ফিরে আসতে বলে।

কিন্তু ভারতীয় এসব খাসিয়া নাগরিকরা সে সুযোগ গ্রহণ না করায় ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকার খাসিয়াদের সম্পত্তিগুলো খাসজমির অন্তর্ভুক্ত করে। তখন থেকে সিলেট সীমান্তে জয়ন্তা রাজ্যের অধীন খাসিয়াদের সম্পত্তি সরকারি সম্পত্তি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং বিষয়টি স্থায়ীভাবে মীমাংসা হয়ে যায়। এরপর আর কখনও জয়ন্তা রাজ্য দাবি করে কেউ জমি দখল করতে আসেনি। কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে ওই সীমান্তবর্তী জমি ভারতীয়দের দাবি করে বিএসএফের সহায়তায় ভারতীয়রা জমি দখল ও চাষবাস শুরু করে। কৃষকরা ভারতীয় দখলদারদের প্রতিরোধ করতে গেলে বিডিআর আশা-ভরসা দেয়া ছাড়া কৃষকদের সাহায্য করতে পারেনি।

জানা যায়, বিডিআরকে ওই সীমান্ত অঞ্চলে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালনার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। এমনকি মাঝে মধ্যে কোনো বিডিআর জওয়ান বা কর্মকর্তা নিজ উদ্যোগে আগ্রাসন প্রতিরোধের পদক্ষেপ নিলে তাকে বদলি করে দেয়া হয়। ফলে সিলেট সীমান্তে বাংলাদেশী মানুষগুলো এখন রয়েছে চরম উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায় এবং নিরাপত্তাহীনতায়। তবে বিডিআর রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে ওই সীমান্তে। কিন্তু ভারতীয়রা দখল করে চাষবাস করতে থাকলেও তারা বাংলাদেশের জমি থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান করা ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা রাখে না।

এ বিষয়ে ওই সীমান্তের বিডিআর জওয়ানদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢুকে ভারতীয়রা মানচিত্রে কলঙ্ক লাগিয়েছে। যে শপথ নিয়ে তারা সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে সে দায়িত্ব এখন আর তারা পালন করতে পারছে না। তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের ছোট মনে করছে তারা। এদিকে সীমান্তবর্তী খাসজমিগুলো বাংলাদেশের ভূমিহীন ও ছোট কৃষকদের লিজ দেয়ার জন্য বিডিআর বারবার সুপারিশ পাঠালেও তা অনুমোদন পাচ্ছে না। অথচ ভারত সীমান্ত পিলার ঘেঁষেই বসতি ও স্থাপনা করছে।

আবার মীমাংসিত সীমানার অঞ্চলে অবৈধ অনুপ্রবেশ করছে। আর বাংলাদেশ সরকার ভারতীয়দের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে জয়েন্ট বাউন্ডারি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে। এ পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার মীমাংসিত সীমানা নিয়ে আবার একটি জটিলতার ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। সিলেট সীমান্তে বিডিআরের এ নির্লিপ্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে ২১ ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল মো. খায়রুল কাদির আমার দেশকে বলেন, সীমান্তে যাতে সংঘাত না হয় সে বিষয়ে বিডিআর সতর্ক রয়েছে। রেড অ্যালার্ট জারি করা আছে।

তবে দখলদারদের বিরুদ্ধে কেন অভিযান করছেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চলছে। অভিযান কেন হয় না এমন প্রশ্নের অবশ্য জবাব দিয়েছেন সীমান্তের এক জওয়ান। তিনি বলেছেন, সেনাপতি যদি মীরজাফর হয় তাহলে সৈন্যদের যুদ্ধ করতে হয় না। আমাদের হয়তো পলাশীর পরিস্থিতিই বরণ করতে হবে। এদিকে গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরের ১২৭৭ থেকে ১২৮৪ সীমান্ত পিলার পর্যন্ত গত এক সপ্তাহ ধরে কোনো না কোনো স্থানেই দখলি অভিযান করছে ভারতীয়রা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ৭৭ নম্বর পিলারের সঙ্গেই রয়েছে বিএসএফ ক্যাম্প। এখানে আমস্বপ্ন এলাকায় চলছে ভারতীয়দের চাষাবাদ। আর বাঙালিচাষীরা এসে বসে আছেন বিডিআর ক্যাম্পে। ১২৭৮ সীমান্ত পিলার সংলগ্ন জৈন্তাহিল রিসোর্ট এলাকায় ৭৯ পিলারের আলু বাগান এলাকায় ৮০ পিলারের শ্রীপুর সংলগ্ন এলাকা, ৮২ থেকে ৮৪ মিনা টিলা, পাগলা টিলায় ভারতীয়দের চাষাবাদের জমি দেখা যায়। এসব এলাকায় বাঙালিচাষীরা জমির দিকে এগিয়ে গেলেই দখলদার ভারতীয়রা তীর ছোড়ে ও নানা গালাগাল করে।

তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে দেখা যায় বিএসএফ সদস্যদের। গত ১২ জুলাই মিনা টিলা থেকে ১৪ গরু নিয়ে গিয়েছিল ভারতীয়রা। এখানে গরু পাহারা দিচ্ছিল কিশোর রাখাল গিয়াস। তাকে ভারতীয়দের সম্পর্কে জানতে চাইলে কেঁদে ফেলে এ কিশোর। সে বলতে থাকে অতীতে আমরা সীমান্ত পিলার পর্যন্ত যেতে ভয় পেতাম না।

কিন্তু এখন গরুরও নিরাপত্তা নেই। তারাও থাকে ভয়ে ভয়ে। কখন বিএসএফের চররা গুলি বা ভারতীয় নাগরিকদের তীর এসে গায়ে লাগে। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আলেয়া বেগম বললেন, এখানে বিডিআরই ভয়ের মধ্যে থাকে। আর গরিব মানুষগুলোর চিন্তা কে করবে।

মধ্যবয়সী এ মহিলা এখন আর সীমান্ত পিলারের কাছে যান বলে জানান। কয়েকদিন আগে এক বোবা রাখাল গরুর সঙ্গে সঙ্গে সীমান্তের কাছাকাছি বাংলাদেশের জমিতে দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে গুলি করে বলে জানান তিনি। সিলেট সীমান্তের এ নাজুক পরিস্থিতি সত্ত্বেও সরকারের নির্লিপ্ততায় হতবাক সীমান্তের মানুষগুলো। তাদের জীবনে নিজেদের এমন অসহায় বোধ কখনও হয়নি বলে জানালেন গ্রামবাসী। আমার দেশ, Mon 26 Jul 2010


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.