ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন... ‘আপনি কখনো কাউকে ভালবেসেছেন বা প্রেমে পড়েছেন?’ মাঝ বয়সের কোনো ব্যক্তিকে ফেলে আসা জীবনে চোখ বুলিয়ে আপনার প্রশ্নটির জবাব দিতে বলুন তো। নিজের প্রতি সৎ থেকে সত্য কথাটা স্বীকার করেন যদি, এমন কাউকে বোধকরি খুঁজে পাওয়া যাবে না যার উত্তর না বোধক হবে। কিন্তু তাকেই যদি আবার প্রশ্ন করেন ‘আচ্ছা, বলুন তো, ভালবাসা কাকে বলে? প্রেমের সংজ্ঞা কী?’ দেখবেন, বলতে গিয়ে কেমন আটকে যাচ্ছেন তিনি। আসলে তার দোষ-ই বা দেবেন কেমন করে? প্রেম বা ভালবাসার সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা তো এখনো দিতে পারেননি কেউ না কোনো সাহিত্যিক, কোনো দার্শনিক বা মনস্তাত্তিক। প্রেম আর ভালবাসা একই বিষয় কি না তা নিয়েও রয়েছে বিতর্ক।
ইংলিশ-বাংলা ডিকশনারিতে ‘লাভ’ (LOVE)-এর অর্থ হিসেবে প্রেম ও ভালবাসা দুটোই লেখা থাকলেও, বাংলা একাডেমীর ব্যবহারিক বাংলা অভিধান ‘প্রেম’-এর অর্থ বা সমার্থক শব্দ হিসেবে ভালবাসা এবং উল্টোভাবে ‘ভালবাসা’র ক্ষেত্রে প্রেম লেখা থাকলেও অনেকের কাছেই ‘ভালবাসা প্রেম নয়’। এক্ষেত্রে অবশ্যই নর-নারীর মধ্যকার প্রেম-ভালবাসা বা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি অনুভূতির কথাই বলা হচ্ছে, বাবা-মা-ভাই-বোন বা বন্ধুর প্রতি অনুভূতিকে এখানে ‘লাভ’ অর্থে বোঝানো হয়নি।
প্রেম বা ভালবাসার অর্থ বোধে আমজনতা দুভাগে বিভক্ত। এক দলের কাছে ভালবাসা বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শরীরপ্রধান একটি অনুভূতি। শরীরের উপস্থিতি ছাড়া ভালবাসার অস্তিত্ব তাদের কাছে অকল্পনীয়।
তারা ভালবাসার ফ্রয়েডীয় তত্তের অনুসারী। বিখ্যাত অস্ট্রিয়ান নিউরোসায়েন্টিস্ট সিগমুন্ড ফ্রয়েড-ও তার মতাদর্শী মনস্তাত্তিকদের মধ্যে সব প্রেমের উৎস শরীরী আকর্ষণ- যৌনতা। এমনকি পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের ভালবাসাও কাম-উৎসারিত বলেই তাদের ধারণা। কালের প্রবাহে এই থিউরি বিতর্কিত এবং এর বিপক্ষে শক্ত যুক্তি প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনো এই মতবাদের প্রভাব কম নয়। এখনো অনেকের কাছে প্রেম মানেই শরীর বা যৌনতা।
বিপরীত মতাদর্শীদের কাছে প্রেম শাশ্বত, চিরন্তন, স্বর্গীয় এক অনুভূতি। সেখানে শরীরের কোনো স্থান নেই। পরস্পরের প্রতি মানসিক আকর্ষণই সেখানে প্রেম বা ভালবাসার ভিত্তি এবং স্থায়িত্বের নিয়ামক। তাদের মতে, যতক্ষণ অনুভূতিটা মনের ততক্ষণই তা ভালবাসা। এতে শরীর ঢুকে গেলে তা আর তাদের কাছে ভালবাসা নয়Ñ কেবলই যৌনতা, কাম।
তাদের ধারণায়, মানসিক আকর্ষণ প্রবল হলেই কেবল প্রেম টিকে থাকে। এদের কাছে ভালবাসা ব্যাপারটি ‘প্লেটোনিক’। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক প্লেটো যদিও মোটা দাগে প্রেমের কোনো তত্ত¡ উপস্থাপন করেননি, তবে তার দর্শনের একাংশে এমন এক ধরনের প্রেমের ধারণা দেয়া হয়েছে, যা ইন্দ্রিয়াতীত এক চিরš—ন সৌন্দর্যের ধারক।
কেউ আবার দেহজ আকর্ষণ-প্রধান অনুভূতিকে ‘প্রেম’ বলে আখ্যায়িত করেন, মানসিকটি ‘ভালবাসা’। আবার কেউবা বলেনÑ নর-নারীর পারস্পরিক ভালবাসা বা প্রেমে শরীর বা যৌনতা আসতে পারে।
এই বিতর্ক চিরকালীন। মনীষী-বিজ্ঞানী-গবেষকরাও এখনো একমত হতে পারেননি, আসলে প্রেম বা ভালবাসা শরীরপ্রধান নাকি মনপ্রধান।
প্রেমের ধরন নিয়ে গ্রহণযোগ্য একটি মতবাদ দিয়েছেন কানাডার প্রখ্যাত মনস্তত্তবিদ জন অ্যালান লি। তার তত্তের নাম- ‘কালারস অব লাভ’ (ভালবাসার রং!)। রঙের মতবাদের সঙ্গে মিল রেখে এই তত্তের নাম দেয়া হয়েছে।
মূল রং তিনটি লাল, সবুজ, নীল। বাকি সব রং এই তিন রঙের ভিন্ন ভিন্ন মিশ্রণের ফল। একই রকমভাবে লির তত্¡ মতে, প্রেমের ধরন প্রধানত তিনটি-ইরোস (Eros), লুডোস (Ludos), এবং স্টর্জ (Storge)। ইরোসে মনের চেয়ে শরীর-সৌন্দর্য প্রভাব বিস্তার করে বেশি। এতে কামনা বা উপভোগই প্রধান এবং তাৎক্ষণিক আবেগ বেশি।
লুডোস ঘরানার প্রেমিক-প্রেমিকারা প্রেমকে খেলা হিসেবে গ্রহণ করে। সম্পর্কের ব্যাপারে এরা মোটেও বিশ্বস্ত ও আন্তরিক নয়। একসঙ্গে একাধিক প্রেম চালিয়ে যেতে এরা দ্বিধাহীন। স্টর্জ ধরনের প্রেম হয় দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের, ভালো লাগার, মানসিক বোঝাপড়ার পরিণতিতে। এই ধরনের প্রেমে যৌনতার চেয়ে বিশ্বাস, নির্ভরতা ও মানসিক আকর্ষণ বেশি।
এই তিন প্রধান ধরনের প্রেমের সংমিশ্রণে আরো তিন ধরনের প্রেমের দেখা মেলে। ইরোস আর লুডোসের সংমিশ্রণে ম্যানিয়া (Mania)- যাকে বলা যায় ‘পাগলের মতো ভালবাসা’। এতে আবেগ খুবই তীব্র থাকে, প্রিয়জনের সান্নিধ্য ছাড়া পৃথিবীর সব কিছুই অর্থহীন মনে হয়। লুডোস আর স্টর্জের সমস্তিত রূপ প্রাগমার (Pragma)-এর অনুসারী প্রেমিক-প্রেমিকারা বাস্তববাদী। এরা আগে থেকেই জীবনসঙ্গীর মাঝে যেসব বৈশিষ্ট্য দেখতে চায় তার তালিকা করে রাখে এবং সে অনুযায়ী সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়।
সর্বশেষ ধরনটি হচ্ছে অ্যাগাপি (Agape)। এতে ইরোস আর স্টর্জ উভয় ধারার বৈশিষ্ট্যের সমš^য় ঘটে। অ্যাগাপি হচ্ছে নিঃ স্বার্থ প্রেম। এতে প্রতিদানের আশা না করে প্রেমিক বা প্রেমিকা তার প্রিয়জনের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে।
ভালবাসার আরেকটি গ্রহণযোগ্য মতবাদ দিয়েছেন আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী রবার্ট জেফ্রি স্টার্নবার্গ।
তার মতবাদ ‘ভালবাসার ত্রিভুজ তত্ত¡’ হিসেবেই পরিচিত। তার মতে, ত্রিভুজের তিন বাহুর মতো ভালবাসারও তিনটি ভিন্ন উপাদান Intimacy বা অন্তরঙ্গতা, Passion বা কামোচ্ছাস এবং Commitment বা প্রতিশ্রুতি। অন্তরঙ্গতা বলতে বোঝায় পরস্পরের প্রতি নৈকট্যের অনুভব। প্যাশন হচ্ছে কাম, জৈবিক আকর্ষণ বা যৌন আকাক্সক্ষা। আর দীর্ঘস্থায়িত্ব ও পারস্পরিক নির্ভরতায় ভবিষ্যতের পরিকল্পনাই হচ্ছে কমিটমেন্ট।
ভালবাসার এই তিনটি উপাদানের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির ওপর ভিত্তি করে ভালবাসা বা প্রেমকে সাতটি ভাগ করেছেন স্টার্নবার্গ। এর মধ্যে যেমন রয়েছে শুধু যৌনতানির্ভর ভালবাসা বা Infatuated Love, রয়েছে Companionate Love - দীর্ঘস্থায়ী বিবাহিত জীবনে এ ধরনের ভালবাসা দেখা যেতে পারে, যেখানে যৌনতা মুখ্য নয়, কিন্তু অন্তরঙ্গতা আর প্রতিশ্রুতির সমš^য়ে ভালবাসা বিরাজমান। অন্তরঙ্গতা আর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে যদি যৌনতাও বিদ্যমান থাকে তখন একে বলা হয় Consummate Love. একজন প্রেমিক বা প্রেমিকা তার জীবনে প্রেমের এই সাতটি ধরনই উপভোগ করতে পারেন, একই মানুষের প্রতি জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন রীতির প্রেম অনুভব করতে পারেন। আবার সব ধরন একই ব্যক্তির জীবনে বা একই প্রেমেরক্ষেত্রে নাও ঘটতে পারে।
আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী হেলেন ফিশার প্রেম-ভালবাসাকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন- Lust, Attraction, Attachment. Lust হচ্ছে যৌনতার সমার্থক।
Attachment হচ্ছে রোমান্টিক ভালবাসা যাতে আবেগ প্রাধান্য পায়। Attachment হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য প্রয়োজনীয় গভীর অনুভ‚তি। ফিশারের মতেও, প্রেম-ভালবাসার সম্পর্ক এই তিনটি ধরনের যে কোনো একটি দিয়ে শুরু হতে পারে এবং পরবর্তী সময়ে তা অন্য ধরনে পরিবর্তিতও হতে পারে। আবার একই সঙ্গে তিনটি ধরনই উপস্থিত থাকতে পারে।
প্রেম শরীরসর্বস্ব নাকি মনসর্বস্ব এই বিতর্কের এখনো পর্যন্ত কোনো সমাধান মেলেনি।
মনস্তাত্তিক, দার্শনিক, সমাজবিদরা ভালবাসার যেসব মতবাদ দিয়েছেন বা দিচ্ছেন সেগুলোও যে সর্বজনগ্রাহ্য বা বিতর্কের ঊর্ধ্বে তাও নয়। তবে এসব মতবাদের কথা ভেবে ভেবে কে কবে প্রেম করেছে, প্রেমে পড়েছে? ‘ভালবাসা কারে কয়?’ সার্বজনীন এই প্রশ্নকে এক পাশে ঠেলে রেখেই যুগে যুগে প্রেমের আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছে কপোত-কপোতীরা।
.............................................................................
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।