মধ্যরাতে জোছনা দেখি, উদভ্রান্ত হেঁটে বেড়াই শহরের রাজপথে । আমি বুকপকেটে স্বপ্ন জমা করি । প্রতিদিনের মতো সান্ধ্য ভ্রমণ শুরু করার আগে আমি বৃদ্ধ মহিলার কাছে গেলাম। তাঁর হাতে কেকের প্যাকেট দুটি দিয়ে বললাম, ‘চা খাবেন?’ বৃদ্ধা আগ্রহ নিয়ে মাথা নাড়েন। আশপাশে ছাপরা ঘরের চায়ের দোকানগুলো নেই।
আমি আমিন সেন্টারের ভেতরে ঢুকলাম। সবই তো প্যান্ট-শার্টের দোকান, এখানে চা কোথায় পাই! একটা ফাস্টফুডের দোকান। ফাস্টফুডের দোকান থেকে প্লাস্টিকের কাপে এক কাপ কফি এনে বৃদ্ধাকে বললাম, ‘খান’। বৃদ্ধা কেক দুটি এক হাতে নিয়ে নিশ্চল বসে আছেন।
বৃদ্ধ মহিলাকে আমি প্রথম আবিষ্কার করি গত বছরের রমজান মাসে।
তিনি বাঁ পায়ে ভর দিয়ে, টেনেহিঁচড়ে অনেক কষ্টে হাঁটছেন দেখে বুঝতে পারলাম, তাঁর ডান পা সম্ভবত অকেজো। আমি একটা ইফতারির প্যাকেট বৃদ্ধাকে দিয়ে বললাম, ‘খাবেন?’ বৃদ্ধা শূন্য চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বাঁ হাতে থলেটি উঁচিয়ে ধরেন। আমি থলের ভেতর প্যাকেটটা ফেলে দিলাম। বৃদ্ধার ডান পাশটি প্যারালাইসিস বা অন্য কোনো কারণে অসাড় হয়ে আছে। দীর্ঘ এই দেড় বছরে আমি বৃদ্ধাকে কখনো কথা বলতে দেখিনি।
হয়তো একই কারণে তিনি তাঁর কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন।
লালখানবাজার মোড়ে আমিন সেন্টারের সামনে বসে থাকা এই বৃদ্ধার অস্তিত্ব আমি ভুলে থাকার চেষ্টা করি সব সময়। যখন বাসায় ফেরার জন্য লালখানবাজার মোড়ে আসি, প্রতিদিন দেখতে পাই, বৃদ্ধা আমিন সেন্টারের সিঁড়িতে অসহায়ভাবে বসে আছেন। বন্ধ মার্কেটের সামনে বসে থাকা নিঃসঙ্গ বৃদ্ধাকে অতিপ্রাকৃত গল্প থেকে উঠে আসা কোনো চরিত্র বলে মনে হয়। আমি মাথা নিচু করে পরাজিত মানুষের মতো হেঁটে আসি।
আমি বৃদ্ধার দিকে তাকাই না। বৃদ্ধা আমার প্রচণ্ড মন খারাপ করিয়ে দেন। আমি বৃদ্ধাকে ভুলতে চাইলেও বৃদ্ধা তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে আমাকে লজ্জায় ডুবিয়ে দেন।
কয়েক দিন আগে আমিন সেন্টারের সিঁড়িতে বসে থাকা বৃদ্ধা আবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। বৃদ্ধার মুখে অসহায় ভাব নেই।
কেউ একজন তাঁকে এক প্যাকেট পাউরুটি এবং এক কাপ চা দিয়ে গেছে। তিনি খুব আনন্দ নিয়ে পাউরুটি চায়ে ভিজিয়ে খাচ্ছেন। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি। সুন্দর একটি গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে একটি বাচ্চা ছেলে বৃদ্ধার কোলে একটি চকচকে নতুন পাঁচ টাকার নোট ফেলে যায়। বৃদ্ধা টাকার দিকে ফিরেও তাকান না।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, টাকা বৃদ্ধার মনোযোগ বিন্দুমাত্রও আকর্ষণ করতে পারেনি। আমার মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। কেউ যদি টান মেরে পাউরুটির প্যাকেটটা নিয়েও যায়, তাহলে কিছুই করতে পারবেন না এই শক্তিহীন বৃদ্ধা। আমি দাঁড়িয়ে বৃদ্ধাকে পাহারা দিতে থাকি।
এই বৃদ্ধার কোনো সন্তান আছে কি না, জানি না।
ওই বৃদ্ধা প্রতিদিন একই জায়গায় কেন বসে থাকেন, তা-ও জানি না। হয়তো বা এই জায়গাতেই তাঁর সন্তানেরা তাঁকে ফেলে রেখে গেছে। বৃদ্ধা হয়তো মনের কোণে এক টুকরা আশা জ্বালিয়ে রাখেন, তাঁর সন্তানেরা একদিন এসে তাঁকে এখানেই খুঁজবে কিংবা চলনশক্তিহীন, থুত্থুড়ে এই বৃদ্ধা স্বপ্ন দেখেন, একদিন পরম করুণাময় নেমে আসবেন তাঁর কাছে। গভীর মমতায় হাত ধরবেন এই মুমূর্ষু মহিলার। বৃদ্ধা চলে যাবেন কোনো অনন্ত শান্তির দেশে।
বৃদ্ধা একটি নতুন পাঁচ টাকার নোট অত্যন্ত অবহেলায় কোলে ফেলে রেখে পাউরুটি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকেন এক হাতে। আমি প্রচণ্ড মন খারাপ নিয়ে বৃদ্ধার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি।
জুয়েল দেব
চট্টগ্রাম।
প্রথম আলো, ছুটির দিনে'তে প্রকাশিত ৪/২/২০১২,
মূল লেখার লিংক
**আমি যদ্দুর পারি, আমার সাধ্যমত করছি। চট্টগ্রামের কেউ যদি এই লেখাটা পড়ে থাকেন, তাহলে আপনাকে একটা অনুরোধ, কিছু করতে না পারলেও, দয়া করে অন্তত একবার লালখান বাজার এসে দেখে যাবেন কিছু মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে।
এটাকে আদৌ বেঁচে থাকা বলে কিনা! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।