প্রিয় মাধবীলতা... আনিস সাহেব বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছিলেন কাছাকাছি কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসবেন কিন্তু কোথায় যাবেন, কিভাবে যাবেন বা কাকে নিয়ে যাবেন এর কোন কিছুই ঠিক করতে পারছিলেন না। অবশেষে ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নৌকা ভ্রমনে বের হবেন আর সাথে থাকবেন তার প্রিয়তমা স্ত্রী। এখনো তিনি বিষয়টা সালেহীনের আম্মুকে জানান নি তবে ঠিক করেছেন আজ অফিস থেকে ফিরে যখন চা আর খবরের কাগজ নিয়ে বসবেন তখন জানাবেন। তিনি এটাও ভাবছেন সালেহীনের আম্মু এটা শোনার পর কিরকম রিঅ্যাক্ট করতে পারেন কেননা এই ছাপ্পান্ন বছর বয়সে হঠাত নৌকা ভ্রমনের শখ একটু বেখেয়ালীই বটে। তারপরেও যেহেতু শখ হয়েছে যেতে তো একবার হয় ই।
আর নৌকা ভ্রমন তো এবার ই প্রথম নয়, কতবার ই না তারা এরকম নৌকায় করে ঘুরেছেন, যদিও সেই বয়সটা এখন আর নেই, তখন দুজনের মাঝে ছিল এক তুমুল প্রেম, দুজন দুজনকে না দেখলে বাঁচতেন না এমন, কতদিন গেছে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করেছেন, কখনো চারুকলায়, কখনো টি এস সি, নিউ মাকের্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে যুবক আনিস চলে যেতেন কলেজের সামনে অপেক্ষা করা দিবার কাছে, এরপর দুজনে মিলে বলাকা ছিনেমা হল। রাজ্জাক-কবরীর সব ছবিই ওদের দুজনের একসাথে দেখা। ছবি দেখতেন আর নিজেদের ছবির গল্পে হারিয়ে ফেলতেন। নৌকায় চড়ে কখনো বুড়িগঙ্গা, কখনো তুরাগ পাড়ে সময় কাটিয়েছেন, এসব এখন সবই সুখ সৃম্তি রোমন্থন।
আজ অনেকদিন পর আনিস সাহেবের ঐ সময়টায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে।
সালেহীন মাঝেমাঝেই বাবার কাছে তাদের পুরনো দিনের সেসব কথা শুনে আর মিষ্টি মিষ্টি হাসে, শুনতে ভালই লাগে ওর। একান্ত মনে ও নিজেও কল্পনা করতে শুরু করে দেয়। বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, গত কয়েক বছর ধরেই মা বিয়ে বিয়ে করছে কিন্তু কোনভাবে ওকে রাজী করাতে পারছে না। মৌ এর সাথে যে দূরত্বটা তৈরী হয়েছিল তা এখনো মিমাংসা হয়নি।
মৌ নিজেও সালেহীনকে কিছু বলছে না, দুজনের মধ্যে এক থমথমে স্তব্ধতা। ও ভাবছে একদিন মৌ কে ওর অফিসে ডাকবে, কিছু খোলামেলা কথা হওয়া দরকার দুজনের মধ্যে। মৌ নিজেও বিয়ে করছে না, একটা পরিষ্কার জবাব দরকার সালেহীনের।
আনিস সাহেব বাসায় ফিরেছেন কিছু সময় আগে, তিনি সালেহীনের আম্মুকে ডাকতে যাবেন এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠল। তিনি দেখলেন ঝিনাইদাহ থেকে তার বড় বোন ফোন দিয়েছেন।
সালেহীনের বড় ফুফু বিয়ের পর থেকেই ওখানে থাকেন, ফুফার চাকরীর সুবাদেই ওখানে থাকা, তারা ওখানে একটা বাড়ি ও করেছেন। ফুফা সোনালী ব্যাংকে চাকরী করতেন, অবসর নিয়েছেন প্রায় আট বছর হয়ে গেছে। তিন ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, ছোট ছেলেটার এখনো বিয়ে হয়নি, ফুফা-ফুফু ওটা নিয়ে বেশ চিন্তিত। সবাই মিলে এখন তাই ইমুর জন্য পাত্রী খুঁজছে। বড় বোনের সাথে মিনিট দশেক কথা বলে ফোন রাখলেন আনিস সাহেব।
ইতিমধ্যে সালেহীনের আম্মু চা নিয়ে এসেছেন। আনিস সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কথা শুরু করলেন।
আনিস সাহেবঃ তারপর কি অবস্থা তোমার, সারদিন কি করলে ?
সালেহীনের আম্মুঃ ভালই আছি, কি আর করব, সকালে টিভি দেখলাম কিছুক্ষন, রান্না করলাম তিন পদ, রাতেরটাও রেঁধে রেখেছি, দুপুরে কিছুক্ষন ঘুমিয়েছিলাম। তোমরা তো আর কেউ বাসায় থাক না। তুমি থাক অফিসে আর তোমার ছেলেও তো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।
আনিস সাহেবঃ রাতের জন্য কি রান্না করছ?
সালেহীনের আম্মুঃ ফুলকপি আলু দিয়ে শোল মাছ আর ডাল চচ্চড়ি।
আনিস সাহেবঃ তোমার মেয়ের কোন খবর আছে?
সালেহীনের আম্মুঃ না, আজ আর কথা হয়নি, গত পরশু ফোন দিয়েছিল ভালই আছে, সামনের সপ্তাহে রাব্বির পরীক্ষা শেষ হলে বেড়াতে আসবে।
আনিস সাহেবঃ ও আর রাব্বী আসবে নাকি জামাই ও আসতেছে ?
সালেহীনের আম্মুঃ জামাই এখন আসবে না, ওরা দুজন ই আসবে, জামাই এর নাকি ব্যবসায় অনেক ব্যস্ততা।
আনিস সাহেবঃ ও। শুন কাল থেকে একটা কথা ভাবছিলাম, তোমাকে বলা হয়নি।
সালেহীনের আম্মুঃ কি বলবা এখন বল
আনিস সাহেবঃ অনেকদিন তো আমরা কোথাও বের হই না তাই ভাবছিলাম দুজনে মিলে একদিনের জন্য কোথাও বেড়িয়ে আসব।
সালেহীনের আম্মুঃ হঠাত করে এমন মনে হওয়ার কারণ কি ?
আনিস সাহেবঃ আরে ইচ্ছা করতে পারে না দুজনে কোথাও বেড়িয়ে আসতে আর এসব তো হঠাত করেই ভাবনায় আসে।
সালেহীনের আম্মুঃ তা কোথায় যেতে চাও ?
আনিস সাহেবঃ দুজনে মিলে নৌকা ভ্রমনে বের হতে চাই।
সালেহীনের আম্মুঃ কি বল এসব, তোমার মাথা কি গেছে নাকি ? এই বয়সে নৌকা ভ্রমন (আসলে মনে মনে যেন একটু খুশিই হলেন তিনি, কত দিন এভাবে বের হন না দুজনে)।
আনিস সাহেবঃ অসুবিধা কোথায়? একদিন বিকালে বুড়িগঙ্গা থেকে যাত্রা শুরু করব, এরপর যতদূর যাওয়া যায় মানে ২-৩ ঘন্টা নদীর মাঝে থেকে আবার ফিরে আসব।
সালেহীনের আম্মুঃ লোকে দেখলে কি বলবে আর এই বয়সে এসে...
আনিস সাহেবঃ লোকে কি বলল তাতে কি আসে যায়, আমার তোমাকে নিয়ে বেড়াতে ইচ্ছে হল, আমি বেড়াব। আর কিছু শুনতে চাই না। তাহলে আমরা পরের শুক্রবার দুপুরে খেয়ে বের হচ্ছি।
সালেহীনের আম্মুকে আর বেশি কিছু বলার সুযোগ দিলেন না আনিস সাহেব।
বাবা-আম্মুর এমন নৌকা ভ্রমনে যাওয়ার কথা শুনে সালেহীন বড়ই রোমাঞ্চিত হচ্ছে।
ওরা এখন আর এসব করে না। ওদের প্রেম মানে হয় সিনেপ্লেক্স বা ধানমণ্ডি লেক না হয় বি এফ সি-কে এফ সি-হেলভিশিয়া টাইপ রেস্টুরেন্ট। এখন সালেহীনের মনে হচ্ছে সব দূরত্বের কথা ভুলে গিয়ে মৌ কে নিয়ে ও এভাবে কোথাও বেড়িয়ে আসতে পারত। আসলে মনের ভিতর অভিমান বজায় রেখে আর যাই হোক শান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায় না। মৌ এর জন্য কেন তাকে অপেক্ষা করতে হবে, সে কি পারছে না মৌকে এখন একটা ফোন দিয়ে বলতে “চল ভুলে যাই সব অভিমান, দুরত্বের দেয়াল ভেঙ্গে দি, বন্ধুত্বের ছোঁয়া গায়ে লাগিয়ে, নতুন একটি ছবি আঁকি”।
সালেহীন –মৌ এর নৌকা ভ্রমণ হয়েছিল কিনা আর জানা যায়নি তবে সালেহীনের বাবা-আম্মু পড়ন্ত বয়সে এসে যে নৌকা ভ্রমনের স্বাদ পেলেন কোন এক বসন্ত বিকালে তা সত্যিই জীবনের আনন্দময় সময়গুলোর মধ্যে একটি।
সকাল ১১ টা ১৫
৩০। ০১। ২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।