পাগলীর নাম কেউ জানে না। এখন অনেক বয়স ওর। সারাদিন এ- গ্রাম ও- গ্রাম, একা একা লাঠি ভর দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। অনেকে বলে, সে নাকি লোকের ক্ষেত থেকে কাঁচা পটল, তিতে উচ্ছে, বেগুন তুলে কচকচ চিবিয়ে খায়। আর বোশেখ মাসে ধানক্ষেতের আইল ধরে কাপড়ের আঁচল ভর্তি করে হরিৎ বর্ণের ফড়িং ধরে।
তারপর ওই আদিনিবাস তালতলাতে আসে। এই আস্তানায় কৃষ্ণপক্ষের রাতগুলোতে শুধু ঘুমায়, আর শুল্কপক্ষের রাতগুলোতে একটা একটা করে ফড়িং দাঁতের নিচে দিয়ে চাবায় ও পেত্নীর মত অট্টহাসিতে ভেঙ্গে পড়ে; হাসির মধ্যে চাঁদের পানে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে- নৌকাটা সোজা করে ভাসা, নৌকাটা সোজা করে ভাসা... এ কথার অর্থ আমার বাবা অনেক লম্বা অতীত ইতিহাস টেনে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি তার কথার শুরুতেই পাগলীর ছেলের কথা বলেছিলেন, যে এখন কবরবাসী, বলেছিলেন নাতীর কথা, যে এখন ভরা নদীতে নৌকা চালায়।
ছার ঝিলান যাইবেন?
আবছা অন্ধকারের ভেতর তার ঘাড় নাড়া চোখে পড়লে আব্দুল ব্যস্ত হয়ে ওঠে; কারণ নদীর কিনার থেকে নৌকায় উঠতে হলে দু’তিন কদম জলকাদা অতিক্রম করতে হয় যাত্রীকে। আব্দুলের দীর্ঘদিনের মাঝিগিরির অভিজ্ঞতা তাকে বিব্রত হতে দেয় না মুহূর্তের জন্যও।
নৌকার পাটাতনের একখণ্ড তক্তা গলুইয়ে কাত করে বসিয়ে দিলে মানুষটা নিঃশব্দে নৌকায় উঠে আসে।
ছারের বাড়ি কোম্মে?
আব্দুলের এই প্রশ্নে যাত্রীর কনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায় না। সে নির্বিকার উত্তর দেয়, তালুকদার বাড়ি।
আব্দুল কেঁপে উঠে। সে এবার যাত্রীর মুখের দিকে তাকায় অনুসন্ধানী চোখ মেলে।
মুহূর্তের জন্য বৈঠার ছপছপ শব্দ থেমে যায়। মনে মনে বলে,- চিনছি আমথেরে’ এবং এই চেনার মধ্য দিয়ে আবুদুল যেন সম্বিৎ ফিরে পায়। তার দাদীর কাছ থেকে শোনা তার বাবার খুনিদের চিনতে আব্দুলের এতটুকুও কষ্ট হয় না। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরা পাখিদের কোলাহলের সঙ্গে তার দাড়ের শব্দ একাকার হতে থাকে। সে অপেক্ষা করতে থাকে, এবার নিশ্চয় যাত্রী তার পরিচয় জানতে চাইবে- যা গাঁও-গেরামের মানুষেরা হরহামেশাই করে থাকে।
কিন্তু এ যাত্রী একদম নির্বিকার। হঠাৎ বলে ওঠে-
-আহ কতকাল পর এইসব...
-হয়, হেয়া প্রায় বাইশ বচ্চর!
ফুটিফুটি করেও আব্দুলের মুখ থেকে কথা কয়টি ফুটে বেরোয় না। আবছায়ার মত অন্ধকারের মধ্যে বসে থাকা মানুষটার প্রায় সাদা হয়ে যাওয়া চুল, মাঝখানে ডিম্বাকৃতি টাক, মাংসল থলথলে ঝুলে পড়া গাল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা...। এসব পরিবর্তন এই বাইশ বছরের ঘটে যাওয়ার পর যাত্রীকে চিনতে আব্দুলের কষ্ট হয় না। দশ বারো বছর বয়সে দেখা ছবির সঙ্গে কত অমিল।
এই মানুষটাকে আব্দুল তার স্বপ্নের পুরুষ মনে করত; কিন্তু এই-ই-সে...! দাদির কাছে শুনেছিল তার বাবার খুনি এই লোকটা।
-কি খেইলডাই না খ্যাললে কয়ডা বছর। আমার বাপেরে মাইরা পালাইছিলা চান্দু, আন্দারের মধ্যে চাইদর মুরা দিয়া। আচ্ছা পুরুষ মানসে ঘোমডা দেলে লাগে ক্যামন! হাপের ফনার নাহান? চকিতে একটা ভাবনা মাথার মধ্যে খেলে যায় এবং ভাবনাটুকু সম্পূর্ণ রুপ পাওয়ার আগেই তার মাথায় রক্ত চড়ে। এবার যেন নদীতে নয়, তার বুকের ভেতরে বৈঠার ছপছপ আওয়াজ ওঠে।
মনে হয়, অন্য কেউ তার বুকে দাঁড় ঠেলছে; বৈঠার খোঁচায় হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। কে... কে অমন করে দাঁড় বাইছে তার বুকে ! বা-প-জা-ন! বুকের ভেতর তীব্র আর্তচিৎকার জলের কুণ্ডলীর মতো শোঁ শোঁ করে ঘুরপাক খেতে থাকে। বাপজানের হা করা মুখের নিচে তার গলাটা দু’ফাক; বিকট হাঁ হয়েছিল। আব্দুল দেখেনি। শুনেছে।
কোথায় কোণ চরে গিয়ে ঠেকেছিল, হাঁ করা মুখ, দু’ফাক গলা- বাপজানের লাশ। নৌকাটাও সেখানে ছিল না...
-মাঝি ঠিকমতো নাও বাও, এত ঢোলে ক্যানো?
যাত্রীর ধমক খেয়ে আব্দুল শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বৈঠা। বৈঠাটা তুলে সর্বশক্তিতে তাক বরাবর একটা যুৎসই ঘাই তারপর মাথাটা দু’ফাক। ঠিক বাপজানের দু’ফাক হওয়া গলার মতো। এরপর লাশটাকে ঝুপ করে নদীর জলে ফেলে দিতে হবে।
পাটাতনে লেগে থাকা রক্ত সারারাত ধরে ধুয়ে ফেলবে নদীর জলে। ধুয়ে ধুয়ে ধবধবে তকতকে করে তুলবে নৌকাটা। কাল যাত্রীরা উঠলেই বলবে,
-কিরে আব্দুইল্লা, নাওখানা বড় সুন্দর লাগতাছে আইজ?
আব্দুল নির্বিকার উত্তর দিবে- ধুইছি রাইতে।
-হুনছি চরে বোলে মোগো তালুকদারের লাশ গ্যাছে ভাসতে ভাসতে। হ্যায়রে বলে কাইল সোন্দ্যায় বাড়তে আওনের কথা, ঘাডে হ্যারে বোলে দ্যাখছে কেউ কেউ, মোগো আব্দুল্লা তুমি দ্যাখছ?
-ডাহাইতে মারছে।
-মোনে অয় না, হ্যায় কি আর আমাগো নাহান, লগে টাহা-পয়সা, সোনাদানা লইয়া কি আর গেরামে আইছে। তয় এয়ার মধ্যে কিন্তু আছে মনে অয়।
-বোজ্জো, কপালটাই হালার পোড়া মোগো।
-হ্যাকা, তোমার আবার অইলে কি?
-মোর বড় পোলাডারে চাকরি দেওনের কথা কইছেলে, মুই হেন্না ঢাকা গ্যালহাম তো হেই কামেই। আহা কি আলিশান বাড়ি, উরেব্বালাই! দ্যাশের মানুষ হুইন্না এক কতায় রাজি হইয়া গ্যালে।
বড় ভালো মানুষ, কি কও মেয়ারা।
-হ-হ।
হঠাৎ কেউ যদি আব্দুল কে প্রশ্ন করত, তোর নায়ের লাইগ্যাই বোলে হে খারাইয়ে রইছেলে, তুই ঘাডে আইয়া হ্যারে পাও নাই? তখন, তখন কি চমকে উঠবে সে?
০২.
আব্দুল তার দাদির কাছে শুনেছিলো তালুকদার তার বাবাকে একদম সহ্য করতে পারত না। সে কি এই লোকটাকে নৌকাতেই মেরে ফেলবে, নাকি অন্য কোথাও? আব্দুল যখন এই চিন্তা করছিল, তখনই তালুকদার বলে উঠল,- ও মাঝি, একটু গাঁ লাগাইয়া বাও, রাইত করবা নি?
এবার আর সে যাত্রীর চেহারা ভালোভাবে দেখতে পায় না; চিন্তা করে এই অন্ধকারে নিশানা ঠিক করতে একটু কষ্ট হতে পারে। বৈঠার এক আঘাতে কাবু করতে না পারলে সব ভুন্ডুল হয়ে যাবে।
লোকটা লাফিয়ে পড়ে সাঁতরে পার পেয়ে যেতে পারে। হাতার দেলেও ছারমু না, মুইও হাতার দিমু, হালার ফলারে চুবাইয়া মারুম। ফেরাউনের মত ডুবাইয়া মারুম... আব্দুল ভাবে লোকটা নদীর কাদাজল গিলতে গিলতে বিলাপ জুড়ে দেবে নিশ্চয়ই- মাগো... বাঁচাও মেরে ফেলল গো...
এক সময় গলার স্বর থিতিয়ে আসবে। ধীরে ধীরে তলিয়ে যাবে। একেবারে নদীর তলায় গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে চিত হয়ে পড়ে থাকবে।
এক সময় ভুস করে ভেসে উঠবে।
-আচ্ছা মানুষ মরলে ভাইস্যা থাকে জ্যান?
মানুষ মরে গেলে কেন ভাসে থাকে, এই রহস্যের কুল কিনারা করতে পারে না আব্দুল। এ সময় শুধু এই একটি ছবি তার চোখে ভাসতে থাকে- চার হাত-পা ছড়িয়ে ভাসে যাচ্ছে একটা লাশ। তালুকদারের ড্রামের মতোন ফুলে ওঠা পেটের ওপর একটা শকুন কিংবা শকুনের যদি একান্ত আকাল হয় গোটা দুই কাক; কাক দুটো লোকটার পেট, পেটের ভেতর নাড়িভুড়ি নিয়ে ভাসতে ভাসতে চলে যাবে।
-মাঝি এত দোনামোনা ক্যান, হাঁক করে বৈঠার বারিদ্দে মাথাটা ফাঁক করে দাও।
ভয় পাচ্ছ মেয়া, ডরাইলে ডর, না ডরাইলে... একটা প্রতিধ্বনি আব্দুলের বুকের মাঝে তীরের ফলার মত বিদ্ধ হতে থাকে। আরেকবার তার মাথায় রক্ত চড়ে- এখনই সময়, এখনই সেরে ফেলতে হবে। আর এক মুহূর্তও দেরি করা চলবে না। ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে সময়। নৌকাটাকে ঘুরিয়ে দেবে কিনা ভাবতে ভাবতে শক্ত করে বৈঠাটা দু’হাতে আঁকড়ে ধরে।
আস্তে আস্তে উপরে তুলতে থাকে বৈঠাকে, তার বুক ধড়াস ধড়াস লাফায়...
...এবং তারপর থেকে আব্দুল গ্রামছাড়া।
void(1);
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।