স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান উপাসনা
কিঙ্কর আহ্সান
অবতরনিকা
কথা ছিলো ভোরে কুয়াশায় ঢেকে যাবে চারপাশ। তীব্র শীতে তারা চড়াও হবে গাছ,পাতা,ঘাস এমনকি মানুষের চোখের পাতার ওপরও। হয়নি।
শীত নিয়ম ভেঙে আকাশ হতে সকাল সকাল উপুড় করে ঢালল রোদ। কঠিন রোদ। শীতের কাপড় আর পড়লনা সেদিন কেউই। কুমারখালি নদীতে জোয়ার উঠল। সোনালী রোদে চিকচিক করা জলে তড়িঘড়ি করে নৈাকা নিয়ে নেমে পড়ল মাঝিরা।
পাড়ে গজিয়ে ওঠা কাশবন গত রাতের ভেজা শরীর শুকোতে লাগল রোদে। আর গুটিকয়েক ধূসর সাদা রংয়ের বক নিজের শরীরের রংয়ের সুযোগ নিয়ে লুকোচুরি খেলতে লাগল সেই বনেরই ভেতরে। ওদের কান্ড দেখে চোখে ধাঁধা লাগে। নৈাকা পারাপারের সময় যাত্রীরা ওদের আলাদা করে ঠাওর করার চেষ্টা করে। সময় কাটানোর জন্যে এমন ধাঁধার সমাধান দারুন প্রাচীন এক খেলা।
বেলা বাড়তে থাকে। বকগুলোর খেলা শেষ হয় একসময়। কেউ কেউ চলে যায় শিকারে। দল বেঁধে কিংবা একা। সবাই চলে যাবার পরও একটা বুড়ো বক ঠায় দাড়িয়ে থাকে বনের ভেতর।
তাকায় ইতিউতি। নিজেকে নিয়ে হয়ত এ মুহুর্তে বিভ্রান্ত কিছুটা সে। বেলা বাড়ে আরও। সূর্যের আলোর তেজ সাংঘাতিক আজ। বকটা একটা সময় আকাশে উড়াল দেয়।
বুড়ো ডানায় ভর করে উঠে যায় অনেকটা ওপরে। অনেক অনেক। তখন আর তার বয়স বোঝা যায়না একদমই।
কুমারখালি নদীর চারপাশের আকাশ বড় সুন্দর। শুধু আকাশই নয়, যে গ্রামটি সাপের মতন শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে আছে সে,সেই গ্রামটি এবং গ্রামের নামটিও সুন্দর।
গ্রামের নাম চন্দ্রপহর। নামকরনের পেছনে গল্প আছে অনেক। আজগুবি হলেও মন্দ নয় সেগুলো শুনতে। বকটা একটানা ওড়ার পর ক্লান্ত হয় একটু। চন্দ্রপহর গ্রামের বাজার লাগোয়া সবচেয়ে উচু গাছটার একটা ডালে গিয়ে বসে।
একটু জিরিয়ে নিতে হবে। কেন যেন মনে হয় হুশ লোপ পেয়েছে আজ তার। মাথাটা ঝিমঝিম করে। মানুষের বড্ড কাছাকাছি চলে এসেছে আজ বকটা। এটা বিপদজনক।
মানুষ বড্ড খারাপ। বড্ড লোভী।
বাজারের মানুষ ব্যস্ত খুব আজ। বুড়ো বকের এমন কান্ডকারখানা চোখে পড়েনা কারও। মন বলে কিছু একটা নিশ্চয়ই আছে বকের।
যদি থাকে তবে সেই মন আজ উচাটন হয়েছে বড়। মনে পড়ছে পুরনো সব কথা। হারিয়ে যাওয়া ছানাপোনাগুলোর কথা। প্রজনন মৈাসুমে জোড়ায় জোড়ায় ভালোবাসা হওয়ার কথা। ফুরিয়ে এসেছে আয়ু।
ছানাগুলো বড় হয়ে ছেড়ে চলে গেছে তাকে। বুড়ো শরীরে কিছুই ভালো লাগেনা এখন আর। মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করাই তার কাজ।
বাজারে মানুষের জটলা বেড়ে যায় হঠ্যাৎ করে। কানে আসে বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ।
জরি আর রঙিন কাপড়ের তৈরি উদ্ভট পোশাক পড়ে বাজনা বাজায় একদল লোক। তাদের ঘিরে নারী,পুরুষ আর উলঙ্গ শিশুর দল নাচতে থাকে। এলাকার প্রতাপশালী মেম্বারের মেয়ের বিয়ে আজ। এলাহি আয়োজন। গান,বাজনা আর খাওয়াদাওয়ায় জমজমাট চারদিক।
লোকজনের ব্যস্ততা দেখে বকটা সাহস পায়। নেমে আসে অনেক নিচে। বাজারের একমাত্র সেলুন ‘টিপটপ কাটিং’ এর জং ধরা টিনের চালে গিয়ে বসা হয় এবার। দোকানের ভেতর লোকজন তেমন নেই। মালিক নিতাই ফুলবাবু সেজে গিয়েছে বিয়ে খেতে।
ফাস্ট ব্যাচে খাওয়া তার চাই’ই চাই। সেলুন হতে নিতাইয়ের আয় রোজগার মন্দ হয়না। বাজারের একমাত্র সেলুন বলে লোকজনকে আসতেই হয়। সেলুনের রোজগারে ছেলেকে ঢাকায় পড়াচ্ছে নিতাই। মেয়েটাকেও বিয়ে দিয়েছে কিছুদিন হলো।
মানুষ হিসেবে নিতাই তেমন একটা সুবিধার না। আয় রোজগার ভালো হলেও দোকানটার অবস্থা করুণ। দুটো ঝাপসা আয়না আর নড়বড়ে দুটো চেয়ার রয়েছে দোকানে। দেয়ালজুড়ে শাবনুর,পপি আর মুনমুনের ছবি। নিতাই বেছে বেছে মোটামুটি অশ্লীল কয়েকটি ছবি সেটে দিয়েছে দেয়ালে।
খদ্দের টানতে এগুলো কাজে দেয়।
দোকানের কর্মচারী দুজন। নিতাই আর ধানী। ধানী নিরীহ,বোকা মানুষ। বয়স হয়েছে অনেক।
নিঃসন্তান। আপন বলতে নেই কেউই। চোখে পড়েছে ছানি। শরীর হয়েছে নড়বড়ে। হাটতে কষ্ট হয়।
তবে হাতদুটো এখনও সচল। চুল,দাড়ি,বগলের পশম কাটা,মাথা ও শরীর ম্যাসাজে সে এতটাই পাকা যে চোখে ভালোমতো না দেখলেও চলে। তবুও ধানীর বড়ই দুঃখ। গরীবেরও গরীব সে। মালিক নিতাই আয়ের সামান্য অংশই তুলে দেয় তার হাতে।
সে টাকায় তিনবেলা ডাল ভাত খেয়ে চলাই মুশকিল। থাকে নিতাইয়ের বাড়িতে গোয়ালঘরের পাশে ছোট্ট একটু জায়গায়। নিতাইয়ের মুখ খারাপ। কাজে সামান্য ভুল হলেই করে গালিগালাজ। বুড়ো বলে ছাড় পায়না ধানী একটু।
বুড়ো বয়সে আর কিছু করার সাধ্যি নেই বলে মুখ বুজে সহ্য করে সব। ইশ, একটা ছেলে যদি থাকত তার। ব্যাটা রোজগাড় করে খাওয়াতো এই বয়সে।
দোকানে খদ্দের নেই এখন। আসবে বলেও মনে হচ্ছেনা।
মেম্বার এর মেয়ের বিয়েতে সবাই। বিনে পয়সায় এমন খানাদানার আয়োজন খুব শীঘ্রই আর হবে বলে মনে হয়না। অনেক দিন মাংস খাওয়া হয়না। মাংস,পোলাও এসব খাওয়ার বড় শখ হয় নিতাইয়ের। সে ভগবানকে বড় মানে।
ভগবান লোভ করতে নিষেধ করেছেন। ধানী খাওয়ার লোভ সামলাতে পারেনা। কতদিন মাংস খাওয়া হয়না। খাওয়াদাওয়া উপাসনার মতন। ধানী খেতে বড়ই ভালোবাসে।
প্রতিদিন এক মোটা চালের লালচে ভাত আর কলুই শাক খেতে ভালো লাগেনা তার। আমিষের জন্যে মন বড় আনচান করে। কান্না পায়। বেছে বেছে ভগবান এই খানাপাগল লোকটাকেই গরীব বানাল। ভগবানের ওপর রাগ করতে নেই।
শেষ কবে আমিষের স্বাদ পেয়েছিল মনে করতে পারেনা এই বুড়ো লোকটি। দোকানের ভাঙা চেয়ারে বসে অশ্লীল ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে ধানী। এসবের দিকে মন নেই তার। তাকিয়ে থাকার জন্যে তাকিয়ে থাকা। ভগবানের দিব্যি দিয়ে সে লোভ ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
কিন্তু ক্ষুধার্ত শরীরে মাথায় অন্য কোন ভাবনা আসেনা। নিতাই তাকে দোকান ছেড়ে নড়তে নিষেধ করেছে। বিয়ে খাওয়ার ভাগ্যি তার কপালে নেই। নিতাইয়ের গালির ভয় নেই তার। তবে চাকরিটা হারানোর ভয় আছে।
শেষ জীবনে এটাই এখন একমাত্র আশ্রয়।
ক্ষিধেতে ঘুম চলে আসে। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। টিনের চালের ওপর তেরছা ভাবে পড়া রোদটা চোখে এসে লাগে। চোখের ছানি আর ক্ষিধের কারনে কাছেই থাকা একটা বুড়ো বককে দেখতে পায়না সে।
বকটা নেমে এসেছে দোকানের কাছাকাছি। বুড়ো বক পুরনো ঋণ শোধ করতে চায়। বহুদিন আগে একবার ফাঁদে আটকা পড়েছিল সে। বাঁচার জন্যে সেকি করুন আহাজারি করছিল সেদিন। ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিল ডানা।
এই লোকটা বাঁচিয়েছিল সেসময় তাকে। সব মনে আছে। পুরনো সব কথা মনে পড়ছে তার। ভালোমতোই লোপ পেয়েছে হুশ। কিছু একটা করতে চায় সে লোকটার জন্যে।
মরে যখন যেতেই হবে ঋণ শোধের সুযোগটা কাজে লাগালে মন্দ কি। পিছুটান নেইতো আর কোন। ধানীর আমিষ দরকার। সে প্রয়োজন মেটানোর সাধ্য আছে বকটার। এগিয়ে যায় বুড়ো বক।
ধানীর কাছাকাছি। একদম কাছাকাছি। ডানার ঝাপটায় জেগে যায় ধানী। একটু সময় নিয়ে চেপে ধরে বকটার গলা। নিঃশ্বাস নিতে বড় কষ্ট হয় বুড়ো বকের।
কষ্ট হয়। তবুও শান্তি। বড় শান্তি। হোকনা আত্মহত্যার মতন কাজ তবুও ঋণশোধের মতন এমন আনন্দ কজনই বা পায়।
সমাপনী
রাত হতেই বেড়েছে শীতটা।
ঝিঝি পোকারা ডেকে যাচ্ছে সমানে। থেকে থেকে একটু পরপর শোনা যাচ্ছে শেয়ালের ডাক। চন্দ্রপহর গ্রামের একটি বাড়ির উঠোনে নিভু নিভু কুপির আলোতে খেতে বসেছে ধানী নামের এক বুড়ো লোক। লোভে,আনন্দে চোখ চকচক করছে তার। বাড়ির মালিক নিতাইয়ের পরিবার রান্নার পরে বকের মাংস অতি সামান্যই তুলে দিয়েছে তার পাতে।
সে নিয়ে ক্ষোভ নেই ধানীর। সে খাচ্ছে। বড় আনন্দে। কুড়মুড় করে চিবোচ্ছে হাড়। দুর্বল দাতের ফাঁকে মাঝে মাঝে আটকে পড়া মাংসেরও রেহাই নেই।
আঙ্গুল দিয়ে টেনে চালান করে দিচ্ছে পেটের ভেতর। আহা,খাওয়াই তো ভগবান। আমিষের উপাসনাই ধর্ম। খেতে খেতে চোখ বুজে আসে ধানীর। আমিষের সুখ।
বুড়ো বকের ঋণশোধের ব্যাপারটাও নিমিষে ভুলিয়ে দিতে পারে এই সুখ। এমনই ক্ষমতা তার...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।