মানুষ কেনো উপাসনা করে?
এই প্রশ্নটার উত্তর বিষয় নিরপেক্ষ থেকে দেওয়ার প্রচেষ্টা করে দেখা যাক, অবশ্যই অতিমাত্রার বিমুর্ততা না রেখে, সাধারন কিছু শব্দ ব্যাবহার করে উত্তরটা খোঁজার চেষ্টা করা ভালো। শব্দের ঝংকারে মানুষের ভাবনা বদলে যেতে পারে।
উপাসনার বিষয়টা সন্তোষের। এখানে প্রশান্তি পাচ্ছে কে? যে উপাসক সে প্রশান্তির জন্য উপাসনা করে নাকি যে উপাস্য তার প্রশান্তির জন্য উপাসক উপাসনা করে। সত্ত্বা 2টা।
এক জন যার উপাসনা করা হচ্ছে এবং অন্য জন ভক্তপুরুষ যে উপাসনার অং বং চং উচ্চারণ করছে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়, দৈহিক কসরতে নিজের ভক্তি নিবেদন করছে।
প্রণত হওয়ার বিষয়টা নিজের হীনতাকে স্ব ীকার করে নেওয়া। সভ্যতার ইতিহাস তাই বলে। মানুষকে উপাস্য বানানোর সময়, ক্ষমতাধরদের সামনে কুর্নিশের প্রক্রিয়াটাকেও উপাসনা বলতে হবে, নিজের দুর্বলতা, অক্ষমতা এসব মেনে নিয়ে অন্য একজন বলিষ্ঠপুরুষের সামনে আত্মসমর্পনের বিষয়টাকে উপাসনা বলা যায়।
প্রার্থনার এই শব্দরূপে কারো কারো তীব্র আপত্তি থাকতে পারে, তারা কিভাবে সংজ্ঞায়িত করে প্রার্থনাকে আমার জানা নেই তবে আমার কাছে প্রার্থনার অর্থ এরকমই,
আত্মসমর্পন, নিজের হীনতা, দূর্বলতা এবং অক্ষমতা মেনে নিজে বলিষ্ঠ কোনো সত্ত্বার সামনে নতজানু হওয়া।
তার কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা, তার সন্তোষ বিধানের চেষ্টা করা যেনো সে কূপিত হয়ে তোমার ক্ষতি না করতে পারে। বলিষ্ঠের আঙ্গুলি হেলনে যদি পাহাড় ভেঙে যায় তাহলে সামান্য খরকুটো মানুষ কোথায় দাঁড়াবে, সুতরাং একটা অসমান চুক্তি সম্পাদন করা, আমি তোমার অনুগত একান্ত বাধ্য হয়ে থাকবো আমার কোনো ক্ষতি হটে দিয়ো না। প্রার্থনার অন্য একটা অংশ আছে যেটাকে কেউ বলে ভালোবেসে আত্মসমর্পন। প্রেমভাবে উপাসনা। তবে এটাকে হিসাবের বাইরে রাখা ভালো, অন্তত ইসলামি ভাবনায় যেখানে ইশ্বর নপুংশক, সেই ধর্মের বিধানে ইশ্বরের প্রতি প্রেমভাব নিয়ে কেউ প্রণত হয় না।
ইতিহাসের রমনীরা বলিষ্ঠ পুরুষের সন্তান চাইতো, তাদের ভক্তি কিংবা আত্মরতির জায়গাটাতে গিয়ে বলা যায় সেখানেও আসলে লেন -দেনের সম্পর্কটাই প্রধান ছিলো। ইশ্বরের সাথে আমাদের সম্পর্কও আসলে এরকম জাবেদাখাতায় লিখে রাখা সম্পর্ক। আমরা ইশ্বরের বিধানের অনুগত থাকলে, তার কথা পালন করলে, তার অনুশাসন মেনে তাকে উপাসনা করলে ভবিষ্যতে মোক্ষ লাভের সম্ভবনা আছে। ভক্তের প্রাপ্তি এই নিশ্চয়তা, টোকেন বলা যায় এটাকে, পরকালে অনন্ত সময় সুখে শান্তিতে ভোগের জীবনযাপনের লোভ।
অবশ্য মানুষের ইশ্বরের প্রয়োজন যতোটা ইশ্বরের মানুষের প্রয়োজন তার চেয়ে বেশী।
তার উপাসনা করার জন্য মানুষকে তৈরি করা হয়েছে এমন মতের সাথে সহমত যারা তারা এই ফাঁকির জায়গাটা অনুভব করতে পারে কি না জানি না। মানুষ সৃষ্টির সময় যখন ইশ্বরকে বলা হয়েছিলো মানুষ সৃষ্টির প্রয়োজন কি, আমরা সবাইতো তোমার উপাসনা করছি দিবারাত্র, তবে কেনো উপাসনার জন্য ভিন্ন একটা প্রজাতি তৈরি করা, কেনো এত ঝামেলা করে বিশ্ববহ্মান্ড তৈরি করা।
ইশ্বরের গটিল উত্তর ছিলো- আমি যা জানি তা তোমরা জানো না, মানুষকে আমি সৃষ্টি করিয়াছি আমার প্রতিরূপ হিসাবে। আমার প্রতিনিধি হিসেবে মানুষ জগতে থাকিবে। সমস্তনিখিল তাহার সেবায় নিয়োজিত হইবে, তা বাছারা তোমরা ফেরেশতাকূল এবার আদমকে সেজদা করো।
আদম থেকেই মানুষের উৎপত্তি এমন অসম্ভব বিশ্বাস নিয়ে যারা ইবনে হিশামের সীরাতুন্নবী পড়েছেন তাদের সামনে প্রশ্ন- ইবনে হিশাম একটা বংশলতিকা দিয়েছিলো মুহাম্মদের, আদম থেকে শুরু করে মুহাম্মদ অবধি এসেছিলো সেই বংশলতিকা। সেটার সাথে আবার ইহুদিদের তালিকার মিল আছে, সেইসব হিসাব করে যারা এই গল্প ফেঁদেছিলো 5000 বছর আগের কোনো এক দিনে ইশ্বর আদমকে সৃষ্টি করেছিলো তাদের জন্য বিশেষ কিছু বলার নেই। মানুষের ইশ্বর চেতনা, একত্ববাদী ধারনার জন্ম সেই সময়ের আশে পাশে, এই হিসাবে বলা যায় একক ইশ্বরকে সৃষ্টি করেছে মানুষ 5000 বছর হলো। এর আগের ইশ্বরেরা মানুষের সাথেই রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতো। দেবরাজ জিউস যেমন বিভিন্ন সময়ে এসে পৃথিবীর মানবীদের গর্ভসঞ্চার করিতেন তেমন ভাবেই দেবতারা মানুষের পাশাপাশি লড়াই করতো, এর আগের উপাসনার বিষয়বস্তু ছিলো প্রকৃতি, সেখানে প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের বিপরীতে নিরাপত্তার জন্য মানুষ প্রকৃতিকে তুষ্ট করার চেষ্টা করছে।
এই সময়টাকে উপাসনার অর্থই আসলে তোয়াজ করা। আমাদের দেখে রাখো, আমাদের নিরাপত্তা দাও, ঝড়, মারী বন্যার কবল থেকে রক্ষা করো আমাদের।
4000 বছর আগের কোনো এক সময় ইব্রাহিম(কোনো ঐতিহাসিক চরিত্র নাও হতে পারে, হতে পারে কোনো একটা গোত্রের সম্মিলিত প্রধানের চরিত্র) তবে নমরূদের সমসাময়িক, সাদের বেহেশত তৈরির সময়কালে দেখা যায় ইশ্বরের সাথে মানুষের সম্পর্ক ঘনিষ্ট, বেশ ঘনিষ্ট, একটা গল্প আছে, হাঁসের পিঠে চেপে কেউ একজন( নমরূদ বা ফেরাউন) ইশ্বরকে তীরবিদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলো এবং মাছ তার রক্ত দিয়েছিলো, মরা মাছ খাওয়া হালাল হওয়ার পেছনে এটাও একটা গল্প।
যতই অসম্ভব হোক ভাবনাটা, যতই হাস্যকর হোক না কেনো, আমার ভাবতেও অবাক লাগে সেই সত্য যুগে ইশ্বর মানুষের মাথার 3 মাইল উপরে বসবাস করতো। সেখানে তীর ছুড়লে ইশ্বরের বাসস্থানেও পৌঁছে যেতো সে তীর।
এই সম্পুর্ন প্রক্রিয়াটাকে মানুষের সচেতন বিমূর্তায়ন বলা যায়। যেখানে মানুষের রূপটাকে ক্রমশ বিলীন করে দিয়ে একটা পরম সত্ত্বাকে কল্পনার চেষ্টা করা হয়েছে যদিও এই কল্পনা মানুষের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে পারে নাই অনেক সময়ই।
যদি-কোনো এক আশ্চর্য উপায়ে সত্যি সত্যিই কোনো ইশ্বরের খোঁজ পাওয়া যায়, সম্ভবনা নেই কোনো তারপরও যদি, তার নিজের স্তুতি শোনার কোনো প্রয়োজন কি আদৌ আছে?এটাও একধরনের মানবীয় দুর্বলতা, প্রশংসায় বিগলিত হওয়া, সেটা আবার তার ইশ্বর হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে যাবে, ইশ্বর মানবীয় দুর্বলতার উর্দ্ধের এক সত্তা, মানব যেসব কারনে তুষ্ট হয় সেই একই কারনে ইশ্বরের তুষ্ট হওয়ার জায়গা থেকে বিচার করলে একটা ঠিক স্রষ্টার গুনাবলীর সাথে যায় না।
মানুষ কেনো প্রার্থনা করে, কেনো শরণ প্রার্থনা করে, কেনো উপাস্যের পায়ে গড়াগড়ি দেয়, এসব প্রশ্নের উত্তর সেই 6000 বছর আগেও যা ছিলো, এখনও তাই আছে, অনিশ্চয়তা, ভয় এবং রহস্যময়তা ভেদ করার ব্যার্থতা। তবে অনিশ্চয়তার ধরন বদলে গেছে, ভয়ের মাত্রাও বদলে গেছে, নৃশংসতার মাত্রায় বদলেছে, রহস্যময়তার বিষয়গুলো স্পষ্ট হতে হতে এখন বেশ কিছু সুক্ষ দাগ রয়ে গেছে যেখানে আমরা বিজ্ঞানের আপো ফেলতে পারি নি।
আমরা অনেক বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্বিপাক থেকে মানুষকে রক্ষা করতে পারি না, ভূমিকম্প নামক প্রাকৃতিক ঘটনাকে কোনো মতে ব্যাখ্যা চেষ্টা করলেও এটার কোনো পুর্বাভাষ দিতে পারছি না এটাও সত্য, তবে বেশ কিছু প্রকল্প আছে মানুষের হাতে যা বড় মাত্রার ভূমিকম্প সম্পর্কে মানুষকে আগেই সাবধান করতে পারবে। এই সব প্রাকৃতিক দুর্বিপাকের থেকে আমাদের উত্তরন ঘটলে, কোনো অমীমাংসিত রহস্য না থাকলে মানুষের ইশ্বর চেতনায় কি থাকবে বলা মুশকিল। হয়তো সেই বিশ্বাসীর শেষ আশ্রয় থাকবে ইশ্বরের অভিপ্রায় তাই মানুষের হাতে বিজ্ঞানের হাতে এসব রহস্য উদঘাটনের ভার সমর্পন করেছেন তিনি।
আর মানুষের ভয়ের জায়গাগুলোই অনেকটা চিহি্নত, মানুষের মৃতু্য আর জরাকে জয় করা গেলে মানুষ এই 2 অনিশ্চয়তার কারনে ইশ্বরমুখাপেক্ষি হবে না। বিজ্ঞানের কাছে আশ্রয় চাইবে, অনন্তকাল বেঁচে থাকা বিষয়টা আমার কাছে তেমন আকর্ষনীয় না লাগলেও মানুষের বয়সসীমা বেড়েছে গত 100 বছরে 2গুনের বেশি।
এখন পৃথিবীতে যে পরিমান শতবর্ষি মানুষ আছে তার কণামাত্র ছিলো না 1400 বছর আগে তাই মুহাম্মদ বলতে পেরেছিলো আজ থেকে 100 বছর পরে কোনো মানুষ থাকবে না যারা আজ আছে। হয়তো আরও সময় যাবে মানুষের আয়ু বাড়বে আরও হয়তো 120-150 অতিক্রম করে কেউ কেউ 200 বছর বাঁচবে ভবিষ্যতে,সমস্ত বিশ্বের গড় আয়ু এখন 60 এর কাছাকাছি। উন্নত বিশ্বের মানুষের গড় আয়ু 70 ছাড়িয়েছে, আগে সেটা ছিলো 30 থেকে 40র কোঠায়। সুতরাং আমাদের মৃতু্যভয়কে আমরা প্রায় 20 বছর দুরে সরিয়ে দিয়েছি, কৈশোরের রোমাঞ্চময়তা বাদ দিলে- একমাত্র কৈশোরেই মানুষের মৃতু্যবিষয়ক রোমান্টিসিজম তুঙ্গে থাকে, মানুষ পরবর্তি সময়টাতে মৃতু্য নিয়ে ভাবে কম, তাই ধর্মের হোল সেলার যারা তারা সারা ক্ষন মৃতু্য বিষয়ক কথামালা প্রচার করে, ধর্মের ব্যাবসা হয় মৃতু্যকে পুঁজি করে।
এই মৃতু্যপরবর্তি জীবনের অনিশ্চয়তা মানুষকে আরও ইশ্বরঅভিমুখী করে, অনেকগুলো ফাংশন আছে যার সম্মিলিত রূপ মানুষের উপাসনা, ইশ্বরপ্রেমকে নিয়ন্ত্রন করে তবে মূল ফ্যাক্টরগুলো হাতে গোনা যায়-
মৃতু্য ভয়, অনিশ্চয়তা, বিপদ আপদ থেকে নিরাপত্তা চাওয়া, নিজস্ব প্রয়োজন পূরণের কামনা, আরও কিছু খুঁজে বের করা যাবে, এসব মুখ্য পার্থিব উদ্দেশ্য বাদ দিয়ে অপার্থিব জগতের কামনায় ইশ্বরমুখাপেক্ষি হওয়া মানুষের খোঁজ নেওয়া দরকার আসলে।
তারা পৃথিবীতে বসবাস করে আসলেই?
আমার সিদ্ধান্ত হলো ইশ্বরের প্রয়োজন, ইশ্বরকে উপাসনার প্রয়োজন মানুষের যতটা এর চেয়ে অনেক বেশী প্রয়োজন ইশ্বর নামক ধারণাটাকে অবিকৃত রাখার জন্য ধর্মের হোল সেলারদের প্রচেষ্টা।
আমার আগের কোনো এক পোষ্টের মন্তব্যের কিছু অংশ দেখে আমি বেশ মুগ্ধ, ধর্মের মাদকতার মাত্রা চিন্তা করে, ধর্মের উৎপত্তি সামাজিক অসাম্য নির্মূল করা- এটা কতটা মিথ্যা এটা যে বলেছে সে নিজেও উপলব্ধি করে নি, ধর্মের কাজ হলো এই অসাম্যকে একটা বিধান বলে মানুষকে নমনীয় হতে শেখানো, ধনী গরীবের ব্যাবধান, মানুষের মানুষের ভেতরের গোত্র বর্ণের দ্্বন্দ্ব দুর করনের কোনো প্রচেষ্টা নেই ধর্মে তবে ইশ্বর উপাসনার জায়গাটাতে তাদের সাম্যতা দেওয়া হয়েছে। পার্থিরব জগতের কথা বললে বলতে হয় এই সামাজিক অর্থনৈতিক অসাম্যতাকে মেনে নিয়েই এবং যাদের হাতে ধন আছে তাদের তোয়াজ করেই ধর্ম এগিয়েছে, ধর্ম বেশিরভাগ সময়ই ক্ষমতাবানদের তোয়াজ করেছে, এটা যেমন সত্য ইসলামে তেমন সত্য সনাতন ধর্মে। আর উচ্ছিস্টাংশ বিনিময় করে সামাজিক সাম্যতার যে ধারনা সামনে নিয়ে আসে ইসলাম, ধনীদের দেওয়া 2.5% আয়ের অংশ দিয়ে সাম্যবাদ তৈরির যে কামনা করে সেটার সম্ভবপরতা নিয়ে কেউ গবেষনা করে নাই। তবে ধর্মের হোলসেলাররা এটাকে ভালোভাবেই প্রচার করে কাল্পনিক হিসাব দেখিয়ে, এই চ্যারিটি দিয়ে সামাজিক অসাম্যতা নির্মুল করা সম্ভব।
সমাজতন্ত্র যদি ইশ্বরের নামে বেঁচা হতো তবে এই ধর্মে র অনুসারী হতে সবাই। কিন্তু সমাজতন্ত্র কোনো ভাববাদী বিলাস নয়, নেহায়েত একটা সামাজিক বস্তুগত প্রক্রিয়া, পূঁজিবাদের সাথে ধর্ম যায়, মূলত ধর্ম পূঁজিবাদী অস্ত্র, সমাজতন্ত্রের সাথে ধর্ম যায় না।
মানুষে মানুষে সমতার ধারনা ইসলামে আছে?? এমন কোনো দাবির কোরানিক ভিত্তি বা হাদিসের ভিত্তি কেউ দেখাতে পারবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।