থলের বিড়াল খুজতেছি সন্ত্রাস ও সেশনজট কমানো আর বিদেশমুখী প্রবণতা রোধের ¯স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯২ সালে দেশে যাত্রা শুরু হয়েছিল শিক্ষার নতুন এক ধারা যার নাম বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দীর্ঘ ১৯ বছর পরেও অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সওদাগরি মানসিকতার বলি হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা। তবে এই পথপরিক্রমায় শত সমালোচনা ও বিতর্ককে কাটিয়ে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান চলে এসেছে সফলতার তালিকায়। শিক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ নিয়ে কিছু প্রশ্ন থাকলেও যেখানে স্থায়ী ক্যাম্পাস ছাড়াও নিশ্চিত হচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা। সরকারের নিয়মনীতি মেনে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ¯^ার্থে যেখানে বন্ধ হয়েছে টাকার বিনিময়ে অযোগ্যদের ভার্তির সুযোগ।
কিন্তু মানসম্মত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কত? কতটি আসলে শিক্ষা দিচ্ছে? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতে, বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ভাল করার চেষ্টা করলেও এখন পর্যন্ত সফল বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০ থেকে ১১টির বেশি নয়।
জানা গেছে, উচ্চশিক্ষা প্রসারের লক্ষা যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করার জন্য ১৯৯২ সালে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। ১৯৯৮ সালে এর সামান্য সংশোধনী আনা হয়। উক্ত আইনের অধীনে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মোট ৫৬টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ীভাবে স্থাপনের সাময়িক অনুমোদন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মান রক্ষায় ব্যর্থতার কারণে ২০০৬ সালে ৫টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বাতিল করা হয়।
আশা করা হয়েছিল উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ ভূমিকা ও অবদান রাখতে সক্ষাম হবে। পরবর্তীকালে প্রতীয়মান হয় যে ¯^ল্পসংখ্যক প্রশংসনীয় ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানে অসমর্থ বা অনাগ্রহী ছিল। এমন অবস্থার কারণেই বেসরকারী পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হয়। বর্তমানে দেশে সরকার অনুমোদিত ৫১টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে। আইন- ১৯৯২-এর অধীনে শর্তসাপে¶ে ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয় সাময়িক অনুমতি গ্রহণ করে তাদের শি¶া কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সাময়িক অনুমতিপ্রাপ্ত ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দু’টি বিশ্ববিদ্যালয় (আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ এবং ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি) ব্যতীত ৪৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক অনুমতির মেয়াদ (প্রতিষ্ঠাকাল থেকে শর্তানুযায়ী ৫ বছর) উত্তীর্ণ হয়েছে। মূলত এতদিন ইচ্ছেমতো শিক্ষার নামে বাণিজ্য করলেও গেল বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশেষত শিক্ষামন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের পর থেকেই দ্রুত পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। জমি কিনে কার্যক্রম শুরু করতে টাইমফ্রেম বেঁধে দেয়ার পর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে রীতিমতো মাঠে নেমে পড়েন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা। ৫ থেকে ১৫ বছর কার্যক্রম চালিয়েও যারা স্থায়ী ক্যাম্পাসে মানসম্মত শিক্ষার কথা ভাবেনি; শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশের পর তাঁরাও মাঠে নেমে পাড়েন। সব বিশ্ববিদ্যালয় নিজ¯^ ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করতে না পারলেও পরিস্থিতিকে সন্তোষজনক বলেই মনে করছে ইউজিসি।
ইউজিসির হিসাব অনুসারে, ইতোমধ্যেই নিজ¯^ স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেছে ১১টি বিশ্ববিদ্যালয়। আরও ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়েরও স্থায়ী ক্যাম্পাস প্রস্তুত। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তারা সেখানে কাজ শুরু করবে। তবে কেবল জমি কেনা নয়তো জমি কেনার বায়না পর্যন্ত গিয়েই আটকে আছে বাকি ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি তাদের সেই জমিতে ভবনের অনুমোদনও পায়নি।
অন্তত ১৯টি প্রতিষ্ঠান জমি কিনে সেখানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেই হাত গুটিয়ে বসে আছে।
কিন্তু কেমন চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো? কয়টি আসলে মানসম্মত শিক্ষা দিচ্ছে? কার কি অবস্থা? এসব উত্তর সরকারীভাবে খোঁজা হয়েছে একবারই। আর সেটিও হয়েছে আট বছর আগে। তখন তদন্ত কমিটি বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে আটটিকে নীতিমালা পূরণে ব্যর্থ এবং অতি নিম্নমানের চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করেছিল। এছাড়া ৬টি অধিকাংশ শর্ত পূরণে ব্যর্থ, ১০টি আংশিক ব্যর্থ, ১০টির মান আশাপ্রদ, ৯টি মোটামুটি সন্তোষজনক এবং মাত্র ১০টিকে সন্তোষজনক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।
রিপোর্টে যেসব দিক উঠে এসেছিল তার মধ্যে ছিল- নীতিমালা অনুযায়ী প্রশাসনিক ভবন ও ক্যাম্পাস না থাকা, শি¶ক, শ্রেণীক¶, লাইব্রেরি না থাকা, পার্টটাইম শি¶কনির্ভর হওয়া, অনুমোদন ও অনুমতি ছাড়া ক্যাম্পাস চালানো, ক্লাস ও পরীক্ষা নামসর্ব¯^, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে গচ্ছিত অর্থ তুলে নেয়া ও জামানতের ¶েত্রে ছলচাতুরি, শি¶ার নামে বাণিজ্য ইত্যাদি। এখনও কোন এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল নেই। তাই গ্রেডিং করে ভাল মানের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আট বছর আগে সরকারীভাবে যেসব ব্যর্থতার কথা সরকারী তদন্তে উঠেছিল অন্তত ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠান সেই সঙ্কটকে অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। চেষ্টা করছে আরও অন্তত ১০টি প্রতিষ্ঠান।
ব্যয় এবং মানসম্মত শিক্ষার দিক বিবেচনায় নিলে প্রথমেই আসে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নর্দান ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটি। এছাড়া মোটামুটি কম বিতর্ক আছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিটি ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটিসহ আরও কিছু ইউনিভার্সিটি। শি¶া প্রদানের ¶েত্রে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি সফলতা অর্জন করেছে সুনামের সঙ্গেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ১৯৯৬ সালে ২০ ছাত্রছাত্রী এবং ৬ শি¶ক নিয়ে এই ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এই ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার ৮০০ এবং পূর্ণকালীন শি¶ক-শি¶িকা রয়েছেন ১৮০ জন।
পরিচালনার জন্য শুরু থেকেই একটি নন-প্রফিট ট্রাস্টি বোর্ড রয়েছে। নাম প্রগতি ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশন এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। ঢাকার রামপুরার আফতাবনগরে তৈরি হচ্ছে ৭.৫ বিঘার ওপর এই বিশাল নিজ¯^ ক্যাম্পাস। বিশাল এই ক্যাম্পাস তৈরিতে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের ওপর কোন অতিরিক্ত ফিও ধার্য করেনি। উপাচার্য অধ্যাপক আহমদ শফি বলেন, এখানে ভর্তি পরীক্ষা থেকে প্রতিটি পরীক্ষায় মেধাকেই কেবল মূল্যায়ন করা হয়।
মানসম্মত শিক্ষার বিষয়ে কোন আপোস নেই। রয়েছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। আরেকটি দিক হচ্ছে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সেন্টারÑএই সেন্টারে ছাত্রছাত্রীদের ক্যারিয়ার গাইডলাইন দেয়া হয়। এছাড়াও রয়েছে ১৭টি ক্লাব যেখানে ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক এবং সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ রয়েছে। প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধার ছেলেমেয়ে, গরিব এবং মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের প্রায় তিন কোটি টাকার বৃত্তি প্রদান করা হয়, যা একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।
বসুন্ধরায় ৫ দশমিক ৫ একর জমির ওপর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি গড়ে তুলেছে নিজ¯^ ক্যাম্পাস। শিক্ষা ব্যায় বেশি হলেও শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানের তালিকায় সামনের কাতারে চলে এসেছে এটিও। শিক্ষার্থী ১৫ হাজার, যার জন্য পূর্ণকালীন শিক্ষক আছেন ২৮৫ জন। এখানে ক্যাম্পাস তৈরির জন্য অতিরিক্ত ফি ধার্য করায় শিক্ষার্থীরা এক সময় আন্দোলনে নামলেও এখন শিক্ষার্থীরা তা মেনে নিয়েছে। রয়েছে সমৃদ্ধ লাইব্রেরিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা।
রয়েছে নানা ক্লাব যেখানে ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক এবং সৃজনশীলতা বিকাশের সুযোগ রয়েছে। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠা হয়ে আজ এমন এক স্থানে চলে এসেছে যে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিকে বাংলাদেশের সেরা ৫টি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির মধ্যে একটি ধরা হয়। কর্তৃপক্ষ মনে করে, ইউনিভার্সিটি পড়াশোনার বিষয়ে কখনই ছাড় দেয় না এবং পরীক্ষার পদ্ধতি ও সব প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে আলাদা এবং জটিল। উপাচার্য অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, মানসম্মত শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ আমরা নিচ্ছি।
ভর্তি পরীক্ষাসহ কোন পরীক্ষায় আমরা কোন সুপারিশ গ্রহণ করি না। শিক্ষক নিয়োগ হলেই তার প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা হয়। এক গ্রæপে ৩০ জনের বেশি শিক্ষার্থী হলেই দুটি সেকশন করে শিক্ষা দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেই বলছেন, দীর্ঘ ১৯ বছর পরেও আজ অধিকাংশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের সওদাগরি মানসিকতার বলি হচ্ছে শিক্ষা ও শিক্ষার্থীরা। অবস্থা এমন যে যদি ভাল মানের প্রতিষ্ঠানের তালিকা কেউ জানতে চাইলে ৯ থেকে ১০টি প্রতিষ্ঠানের পর আর নাম খুঁজে পাওয়া দায়।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য অধ্যাপক আতফুল হাই শিবলী তাঁর প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করে বলেন, যেহেতু এ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল নেই তাই গ্রেডিং করে ভাল খারাপ তালিকা করার সুযোগ নেই। তবে আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, ১০০ ভাগ মানসম্মত কিনা প্রশ্ন থাকলেও এটা বলা যায় অন্তত ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির আদেশ নির্দেশ মেনে চলে। এরা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে চলে এসেছে
সুত্র: দৈনিক জনকন্ঠ ২৪/০১/২০১২ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।