মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে গতকাল ১৪তম সাক্ষী হিসেবে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন আব্দুল হালিম বাবুল। জবানবন্দীতে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী অন্যান্য রাজাকার ও পাক আর্মির লোকজন তাদের ঘরে প্রবেশ করে লুটপাট করে। এরপর তারা ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। জবানবন্দী শেষে মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা জেরার সময় সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন- ‘১৯৭১ সালে আপনার ঘর না পোড়ানো সত্ত্বেও আপনি ঘর পোড়ানো বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আপনার মা ও ছোট দুই ভাই আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। ’ সাক্ষী তখন ‘না’ বলে জবাব দেন।
তার মা পৃথক অন্নে খান- এ-জাতীয় প্রশ্নের জবাবেও তিনি ‘না’ বলে জবাব দেন।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা জেরার সময় সাক্ষীকে প্রশ্ন করেন আকলিমা খাতুন নামে এক মহিলা আপনার বিরুদ্ধে চুরির মামলা করেছিলেন এবং আপনি সে মামলায় জামিন নিয়েছিলেন। সাক্ষী এর জবাবে বলেন, ওই মামলা ছিল মিথ্যা মামলা। তাদের বিরুদ্ধে আমার একটি মামলার কাউন্টারে ওই মিথ্যা মামলা তারা আমার বিরুদ্ধে দায়ের করেন। আমি সে মামলা থেকে পরে খালাস পাই।
সাক্ষী জানান, এসএসসি সনদ অনুযায়ী তার জন্ম তারিখ ৬/৬/১৯৬০। সে হিসাবে ১৯৭১ সালের জুন মাসে তার বয়স ১১ বছর পূর্ণ হয়। তবে তিনি জবানবন্দীতে বলেছেন, বর্তমানে তার বয়স ৫৫ বছর; আর সেই হিসাব অনুযায়ী ১৯৭১ সালে তার বয়স ছিল ১৬ বছর।
সাক্ষীর জবানবন্দী : ট্রাইব্যুনালে দেয়া জবানবন্দীতে ১৪তম সাক্ষী বলেন, আমার নাম আব্দুল হালিম বাবুল। বয়স ৫৫ বছর।
১৯৭১ সালের ২ জুন আমি আমার নিজ বাড়িতে ছিলাম। ওই দিন আমি আমার বাড়ির সামনে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ সময় লোকজনের হইচই শুনতে পাই। আমি লোকজনের কাছে জানতে চাইলাম কী হয়েছে। তারা বলল, পাক হানাদার বাহিনী আসতেছে।
আমরা সব সময় পাক হানাদার বাহিনীর ভয়ে আতঙ্কে থাকতাম। তাদের আসার খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির লোকদের বললাম তোমরা সবাই সরে যাও। তারা সবাই আত্মগোপন করে। আমিও আত্মগোপন করলাম। দূর থেকে দেখতে পাই দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, দানেশ মোল্লা, মোসলেম মাওলানা, তার সাথে আরো কিছু সশস্ত্র রাজাকার ও পাক সেনারা আমার ঘরে প্রবেশ করে মালামাল লুটপাট করে।
লুটপাটের পর আমার ঘরে আগুন দেয়। তার পর তারা চলে যায়। শঙ্করপাশা নিবাসী খসরু মেয়ার বাড়িতে যায় এরপর তারা। খসরু মেয়া ও আমির খানের বাড়িতে আগুন দেয়। উমেদপুর ও হিন্দুপাড়া গিয়েও আগুন দেয় ও মানুষ মারে বলে লোকজনের মুখে শুনতে পাই।
সাক্ষীর জেরা
আইনজীবী : আপনি মুক্তিযুদ্ধে যাননি?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : পারেরহাট এলাকায় পাক আর্মি কত তারিখ আসে তা আপনার জানা আছে?
সাক্ষী : তা বলতে পারব না।
আইনজীবী : রাজাকার বাহিনী পাক বাহিনী আসার আগে না পরে গঠন হয়?
সাক্ষী : সম্ভবত পরে।
আইনজীবী : শান্তি কমিটিও পরে গঠন হয়?
সাক্ষী : আমার জানা নেই। আমার বয়স তখন কম ছিল।
আইনজীবী : ট্রেজারি থেকে অস্ত্র লুটের বিষয়েও আপনার কোনো ধারণা নেই?
সাক্ষী : শুনেছি টাকা-পয়সা ও অস্ত্র লুট হয়েছে।
আইনজীবী : এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে কবে জবানবন্দী দিলেন মনে আছে?
সাক্ষী : ২৭/৭/২০১০।
আইনজীবী : তদন্ত কর্মকর্তা যে আপনার এলাকায় গেলেন সে খবর আগে কেউ দিয়েছিল?
সাক্ষী : পারেরহাট আসার পর আমি শুনেছি।
আইনজীবী : কবে শুনলেন?
সাক্ষী : ওই দিনই।
আইনজীবী : ওই দিন ক’টায় শুনলেন বলতে পারবেন?
সাক্ষী : ১২টা-১টা হবে।
আইনজীবী : ওই খবর যখন শুনলেন তখন পারেরহাট বাজারে আপনার সাথে আর কে কে ছিল?
সাক্ষী : তদন্ত সংস'ার লোকজন ছিল। এলাকার অনেক লোক ছিল। নাম বলতে পারব না।
আইনজীবী : তদন্ত কর্মকর্তাকে জবানবন্দী কোথায় বসে দিলেন?
সাক্ষী : রাজলক্ষ্মী স্কুলের দোতলায় ক্লাসরুমে বসে।
আইনজীবী : তথ্য জানানোর জন্য তদন্ত সংস'ার লোকজন কি এলাকায় মাইকিং করেছিল?
সাক্ষী : আমি মাইকিং শুনি নাই।
আইনজীবী : তদন্ত কর্মকর্তা সরাসরি আপনার কাছে গিয়ে বললেন আপনি যা জানেন আমাদের বলেন?
সাক্ষী : জি না। আমি স্কুলে যাওয়ার পর শুনলাম তথ্য নেয়ার জন্য লোকজন এসেছে।
আইনজীবী : আপনার পেশা কী?
সাক্ষী : গ্রাম ডাক্তার (পল্লী চিকিৎসক)
আইনজীবী : আপনার ওই ডাক্তারখানা কোথায়?
সাক্ষী : বৌডুবি বাজারে।
আইনজীবী : বৌডুবি বাজার আপনার বাসা থেকে কত দূর?
সাক্ষী : এক কিলোমিটার।
আইনজীবী : আপনার বাসা থেকে প্রথমে বৌডুবি বাজার, তার পর চালনা ব্রিজ, তার পর পারেরহাট বাজার?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : বৌডুবি থেকে চালনা কত দূর?
সাক্ষী : দুই কিলোমিটার। মাইল পোস্ট আছে।
আইনজীবী : ডাক্তারখানায় আপনি সাধারণত ক’টায় যান?
সাক্ষী : ৮টা-৯টায়।
আইনজীবী : ২৭/৭/২০১০ কী পারেরহাট হাটের দিন ছিল?
সাক্ষী : জানা নেই।
আইনজীবী : ২৭/৭/২০১০ তারিখ সকালবেলা কি মাহবুবুল আলম হাওলাদার ও মানিক পসারী আপনার বাড়িতে গিয়েছিল?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : ১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য গণ-আদালত গঠিত হয়েছিল। সে সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে?
সাক্ষী : জি না।
আইনজীবী : পরে জাহানারা ইমাম, সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে গণতদন্ত কমিশন হয়েছিল, সে সম্পর্কে ধারণা আছে?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : পিরোজপুর জেলা পরিষদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গ্রন' প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রচারণা চালানো হয়।
বিভিন্ন এলাকায় গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে কার কী অবদান, যুদ্ধের সময় স্বাধীনতাবিরোধীদের অপকর্ম এসব বিষয়ে তথ্য দেয়ার জন্য এসব প্রচারণা চালানো হয়। সে সম্পর্কে আপনার জানা আছে?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান সেনাকর্মকর্তাদের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে তদন্ত হয়েছিল; সে সম্পর্কে জানা আছে?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এবং আজকে আদালতে জবানবন্দী দেয়া ছাড়া স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত আপনার ঘর পোড়ানো বিষয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ করেননি এবং জবানবন্দীও দেননি?
সাক্ষী : দেইনি।
আইনজীবী : তদন্ত কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দী দেয়ার সময় আপনার বাড়িতে লুটপাটকৃত ও পোড়া মালামালের কোনো তালিকা দিয়েছিলেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, দানেশ মোল্লা, রাজাকার ও পাক বাহিনী আসার খবর কার কাছে শুনলেন?
সাক্ষী : স্মরণ নেই।
আইনজীবী : যে খসরু মেয়ার বাড়িতে আগুন দেয়া হয় বলেছেন তাকে তো আপনি চেনেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পারেরহাটে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করেছিল সেটি আপনার জানা আছে?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : এই ক্যাম্পের কমান্ডার ছিলেন খসরু মেয়া?
সাক্ষী : জানা নেই।
আইনজীবী : এসএসসি সনদে আপনার জন্ম তারিখ কত লেখা আছে?
সাক্ষী : ৬/৬/১৯৬০।
আইনজীবী : আপনার মা জীবিত আছেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনার মা ও আপনি একই বাড়িতে পৃথক অন্নে খান?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : আকলিমা খাতুন, স্বামী আবদুস সোবহান, গ্রাম নলবুনিয়া।
তার দায়ের করা চুরির মামলায় আপনি জামিন নিয়েছেন। মামলার নম্বর ১১৬০/১৯৮২। ওই মামলায় অন্যান্য অভিযোগের সাথে চুরির অভিযোগও আছে।
সাক্ষী : ওটি ছিল মিথ্যা মামলা। আমি তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলাম।
তার কাউন্টারে তারা আমার নামে মিথ্যা মামলা করে। আমি ওই মামলা থেকে খালাস পাই।
আইনজীবী : দেলোয়ার শিকদার পিতা রসুল শিকদার নামে একজন রাজাকার ছিল চেনেন?
সাক্ষী : জানা নেই।
আইনজীবী : আপনার ছোট দুই ভাইয়ের একজন আব্দুস সালাম বাহাদুর?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : তিনি জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) কেন্দ্রীয় নেতা।
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আরেক ভাই আব্দুল করিম মধু। তিনি এমএ পাস?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনি আওয়ামী লীগ করেন?
সাক্ষী : হ্যাঁ।
আইনজীবী : আপনার ঘর না পোড়ানো সত্ত্বেও আপনি ঘর পোড়ানো বিষয়ে মাওলানা সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার কারণে আপনার মা ও ছোট দুই ভাই আপনার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন?
সাক্ষী : না।
আইনজীবী : আপনি তদন্ত কর্মকর্তার কাছে যে জবানবন্দী দিয়েছেন সেখানে ২ জুন নিজ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা, দাঁড়িয়ে থেকে লোকজনের হইচই শুনতে পাওয়া, লোকজনের কাছে ঘটনা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা এ কথাগুলো বলেননি।
সাক্ষী : বলেছি।
আইনজীবী : বাড়ির লোকজনকে সরে যেতে বলা, তাদের আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এ কথাও বলেননি।
সাক্ষী : বলেছি।
নতুন সাক্ষী আনতে পারেনি প্রসিকিউশন : আব্দুল হালিম বাবুলের জবানবন্দী ও জেরা গতকাল দুপুর ১২টায় শেষ হয়ে গেলে আদালত রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের কাছে নতুন সাক্ষী সম্পর্কে জানতে চান।
রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী আদালতকে জানান, নতুন সাক্ষী তাদের হাতে নেই। তখন আদালত বলেন, আমরা রেডি। আসামি পক্ষও রেডি। কিন' আপনাদের সাক্ষী নেই। আগামীকাল কোনো সাক্ষী তারা হাজির করতে পারবেন কি না তা জানতে চান ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক।
তখন সৈয়দ হায়দার আলী বলেন, চেষ্টা করব। বিচারপতি নিজামুল হক বলেন, চেষ্টা করব বললে হবে না। নিশ্চিত করে বলতে হবে।
সৈয়দ হায়দার আলী তখন বলেন, আমাদের পরের সাক্ষীর বয়স ৮০ বছর। সে ঢাকায় আছে।
তার সাথে আমার এখনো দেখা হয়নি। আগামীকাল তাকে আনার চেষ্টা করব। না পারলে মাফ করে দিতে হবে।
মাওলানা সাঈদীর আইনজীবীরা আদালতের বাইরে বলেন, আমরা যখনই কোনো আবেদন দেই তখনই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা অভিযোগ করেছেন বিচারকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এবং বিলম্বিত করার জন্য আমরা এসব করছি। কিন' এখন তারা সময়মতো সাক্ষী আনতে পারছেন না।
এর আগেও বেশ কয়েকবার তারা সাক্ষীদের অসুস'তার কারণে সময় নিয়েছেন। তখন যেন বিচার বিলম্বিত হয়নি। কিন' আমরা ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোনো আবেদন করলে বা কোনো দাবি উত্থাপন করলেই তারা অভিযোগ করেন, বিচারকে বিলম্বিত করতে চাচ্ছি আমরা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।