আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজনৈতিক বিরোধীতা যুদ্ধাপরাধ কি না?



বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সারাদেশ ব্যাপী বিতর্ক চলছে। বিষয়টি একবাক্যে এরকম হতে পারে- রাজনৈতিক বিরোধীতা যুদ্ধাপরাধ কি না? আমরা যতটুকু জানি, ১৯৭১ সালের ভূমিকার বিচারের জন্য দুইটি আইন প্রণয়ন করা হয়েছিলো। যথাঃ- ১। ১৯৭৩-এর আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ আইন: যা শুধুমাত্র করা হয়েছিলে স্বাধীনতার পরপর তদন্তের মাধ্যেমে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত ১৯৫ জন পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর সদস্যেদের বিচারের জন্য। অর্থাৎ কোন সিভিলিয়ানের বিচারের জন্য নয়।

২। দালাল আইন: যা প্রণয়ন করা হয়েছিলো এদেশীয় সাধারণ নাগরিক/সিভিলিয়ান যারা অখন্ড পাকিস্থানের সমর্থক ছিলো বা পাকিস্থান বাহিনীকে সহযোগীতা করেছিলো তাদের বিচারের জন্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী তথা পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সশস্ত্র সহযোগীদের প্রচারকার্যের জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনাল এ্যাক্ট এবং বাংগালিদের মধ্যে যারা পাকিস্তানী সেনা সরকারকে পাকিস্তান রক্ষার যুক্তিতে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছেন তাদের বিচারের জন্য দালাল আইন প্রবর্তন করেন। ঐ সময়ের আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধু সরকারের কেউ যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বাংলাদেশী কোন সিভিলিয়ানকে বুঝাননি বা নিজেরাও তা বুঝেননি। অতি সচেতনভাবেই তাই ঐ সময়কার সরকার দু'ধরনের ‘অপরাধের বিচারের জন্য দুটি আইন প্রণয়ন করেন।

এরপর দালাল আইনে বিচার করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সুস্পষ্টই জেনেছিলেন, ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীতে আওয়ামী লীগের সদস্যই বেশি। ফলে দালাল আইনে তাদের বিচার করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হতে বাধ্য। এ বিষয় নিয়ে তিনি তৎকালীন পুলিশপ্রধান আবদুল খালেকের সাথে আলোচনাও করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত দালাল আইনে আটক বা অভিযুক্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। তার আরো একটি লক্ষ্য ছিল, বিভেদ ভুলে সব মিলে একযোগে কাজ করে যাওয়া। দেশ গঠনে সবার ঐক্যবদ্ধভাবে শরিক হওয়া।

ঐতিহাসিকভাবে এ সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। ১৯৭২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত কোনো সরকারের আমলে কখনোই বাংলাদেশী নাগরিকদের যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা কেউ করেনি। কেউ ভাবেওনি (দালাল বা রাজাকার বলেছে কিন্তু যুদ্ধাপরাধী নয়)। এই পুরো সময়টা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকদেরই যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশী যারা স্বাধীনতা বিরোধীতা করেছিলো তাদের স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে গালাগালি করা হতো।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধী নয়। এরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মধ্য দিয়ে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ ইস্যুটিও সেখানেই সমাপ্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার দালাল আইন প্রণয়ন করেছিলেন ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি। এ আইনের অধীনে তখন প্রায় ১ লাখ লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

যাচাই বাছাই করে অভিযোগ আনা হয় এদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৪১১ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু এ অভিযুক্তদের মধ্যে ৩৪ হাজার ৬২৩ জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কোন মামলাই দায়ের করা সম্ভব হয়নি। মাত্র ২ হাজার ৮৪৮ জনকে বিচারে সোপর্দ করা হয়। বিচারে ৭৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয় এবং শাস্তি হয় তাও ছোটখাট অপরাধের জন্য। শুধু চিকন আলী নামের একজনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

অবশিষ্ট ২ হাজার ৯৬ জন বেকসুর খালাস পায়। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে দালাল হিসেবে পাওয়া যায় মাত্র ৭৫২ জনকে। কিন্তু তাদের কেউই মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের মতো কোনো কাজ করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন দালাল আইনে সাজাপ্রাপ্তদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, তখন সাজাপ্রাপ্ত সবাই কারাগার থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হলেও খুন, লুটপাট, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ অর্থাৎ ৪টি অপরাধকে সাধারণ ক্ষমার বাইরে রাখা হয়।

অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ক্ষমা ঘোষণার পরও কারো বিরুদ্ধে ঐ ৪টি অপরাধের যে কোন একটির অভিযোগ থাকলে দালাল আইনে মামলা করতে পারতো কিন্তু যুদ্ধাপরাধ আইনে নয়। কারণ পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর ১৯৫ জনকে ফেরত দেয়ার মাধ্যেমে ঐ ইস্যুর পরিসমাপ্তি ঘটেছিলো। কিন্তু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা-পরবর্তী শেখ মুজিবুর রহমানের দেড় বছর এবং পরবর্তী আরো সাড়ে চার মাসে দলাল আইনের অধীনে সারা দেশে কোথাও আর একটি মামলাও দায়ের করা হয়নি। ফলে আইনটি এমনিতেই অচল হয়ে পড়ে। এরপর আইনটি বাতিল করা হয়।

সুদীর্ঘ এই সময়ের মধ্যে গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাঈদী বা অন্য কোন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে কেউই হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনেনি। দালাল বা রাজাকার হিসেবে গালাগালি করেছে শুধুমাত্র। যে একলাখ লোককে যুদ্ধের পরপর দালালীর অভিযোগে আটক করা হয়ছিলো তাদের মধ্যে জামায়াত নেতা-কর্মী ছিলোনা। এরপর ১৯৫ জন চিহ্নিত যুদ্ধপরাধীর মধ্যে থাকার তো প্রশ্নই উঠেনা। এমনকি বিশিষ্ট মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডঃ হাসানও বলেছেন, ৯৫% যুদ্ধাপরাধ করেছে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী।

৫% করেছে এদেশের অধিবাসী রাজাকাররা। এখানে উল্লেখ্য যে সমস্ত জামায়াত নেতাদের অপরাধী বলা হচ্ছে তারা কেউই রাজাকার-আল বদর ছিলেনা। একটি বইতে পড়েছিলাম, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলের একটি আসনে জামায়াতে ইসলামী ভোট পেয়েছিলো ৩৫৫ মতো। আর ১৯৭১ সালে ঐ এলাকায় তালিকাভূক্ত রাজাকারই ছিলো ১১৫০০ জনের উপরে। আওয়ামী লীগের কথা মতো যদি জামায়াতের প্রাপ্ত সকল ভোটকেই রাজাকার হিসেবে ধরা হয় তাহলে বাকি ১১ হাজারেরও বেশী লোকগুলো কারা? নিশ্চয় তারা সবাই আওয়ামী লীগের ভোটার ছিলো।

কারণ প্রাপ্ত বয়স্ক ছাড়াতো আর রাজাকারে নিয়োগ দেয়া হয়নি। রাজাকারের তালিকাটি প্রকাশ করলেই তা প্রমাণিত হবে। রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা আরো সহজ কাজ। কারণ যেহেতু রাজাকার অধ্যাদেশের মাধ্যমে পাকিস্থান সরকার রাজাকার বাহিনীকে আজকের আনসার বাহিনীর মতো করে গঠন করেছিলো সেহেতু রাজাকারের পুরো তালিকা সরকারী আর্কাইভে অবশ্যই থাকবে। তাই ঐ তালিকা প্রকাশ করা হোক।

তারপর দেখা যাবে কোন দল থেকে কতজন রাজাকারে ছিলো এবং আমরা ধারণা করছি রাজাকারের সংখ্যা মুক্তিযোদ্ধার চাইতে অনেক বেশী হবে এবং অধিকাংশ রাজাকারই আওয়ামী লীগের সমর্থক, ভোটার বা কর্মী হবে। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের পরপর সব অপরাধের ক্ষতগুলো তরতাজা ছিল। স্মৃতিও ছিল অম্লান। তারপর ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী খোঁজা হচ্ছে।

পৃথিবীর যুদ্ধাপরাধী শনাক্তকরণ ও বিচারের কোনো প্রক্রিয়াতেই কখনো কোনো বেসামরিক ব্যক্তির নাম আসেনি। এমনকি যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পাঁচ কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল, লাখ লাখ কোটি টাকার সম্পদের বিনাশ ঘটেছিল, সে বিশ্বযুদ্ধেও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বেসামরিক ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়নি। যাদের চিহ্নিত ও বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল, তারা সবাই ছিল সামরিক ব্যক্তি। তাদের অভিযোগ উথাপন, সাক্ষীসাবুদ, জেরা সবকিছুই করা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই ১৯৪৫ সালে। সে সময় যারা আত্মগোপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে তাদের পাওয়া গেলে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছিল।

নতুন করে কাউকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার প্রয়াস চালানো হয়নি। সম্ভবত সেটাই হচ্ছে ন্যায্যতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সবাই চাইছে। কিন্তু বাংলাদেশে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী, যাদের সবাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য, বিচার করার জন্য তাদের কোথায় পাওয়া যাবে? আর উদ্দেশ্যমূলক ভাবে যে জামায়াত নেতাদের নাম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তালিকায় প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের কেউই ১৯৭২-৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধী বলে চিহ্নিত হননি কিংবা দালাল আইনে গ্রেফতার বা সাজার মুখোমুখি হননি। এমনকি সে সময় কারো বয়স ছিল মাত্র ৪ থেকে ১০ বছর।

ফলে যুদ্ধাপরাধ করার মতো বয়সও তাদের ছিল না। আমাদের উদ্বেগ এখানেই। এসব পদক্ষেপ থেকে প্রতীয়মান হয়, সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্যই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নেমেছে। জামায়াতের রাজনীতি মোকাবেলা করতে হলে রাজনীতি দিয়েই করতে হবে; কূটকৌশল দিয়ে নয়। এ লিখাটি কাউকে দোষারোপ করার জন্য নয়।

শুধুমাত্র ইতিহাসের কিছু তথ্য প্রকাশ করলাম। কোন তথ্য ভূল থাকলে পাঠক বন্ধুদেরকে বলব সংশোধন করে দেয়ার জন্য।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.