ব্লগার পাঠক হিসেবেই বেশী আনন্দে আছি।
ব্যক্তি হিসেবে না, জামায়াত ইসলাম দলগতভাবেই মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরোধীতা করেছিলো। এখন জামায়াতের যেসব নেতারা বলেন যে দেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই বা জামায়াত ইসলাম মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে, তারাই দলীয়ভাবে যুদ্ধাপরাধে নেতৃত্ব দিয়েছিলো। তথ্য প্রমাণের অভাবে তাদের অনেক কথারই জবাব দেওয়া যায় না। তাই চেষ্টা করলাম আবেগ বহির্ভূতভাবে শুধু তথ্যসূত্র সম্বল করে জামায়াত ইসলামের যুদ্ধাপরাধের কিছু নমুনা তুলে ধরতে।
এখানে কিছু দেওয়া হলো। আরো অনেক আছে, ধীরে ধীরে এই পোস্টে আরো কিছু নমুনা (অবশ্যই তথ্যসূত্রসহ) যোগ করার আশা রাখি। সবার প্রতিই অনুরোধ রইলো মন্তব্যের ঘরে যোগ করে দিন আপনার জানা তথ্যগুলো। তবে সূত্র ছাড়া কোনো তথ্যই না দেওয়ার অনুরোধ রইলো।
জামায়াত প্রেমিকদের প্রতিও অনুরোধ রইলো যদি কিছু বলতে হয়, বা বিরোধীতা করতে হয়, তবে তথ্যসূত্রসহ কথা বলুন… নতুবা চুপ থাকুন।
……………………………………………………………………
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গোলাম আযম সহযোগীদের নিয়ে গঠন করেন ‘শান্তি কমিটি’। এই কমিটির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করা। কমিটির প্রথম বৈঠকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতম নরমেধযজ্ঞ সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনার জন্য সন্তোষ প্রকাশ করা হয় এবং মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনগণকে আখ্যায়িত করা হয় ইসলামবিরোধী হিসেবে।
[মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধ: শাহরিয়ার কবির]
‘৭১-এর ১২ এপ্রিল ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি কমিটির মিছিলে গোলাম
আযম নেতৃত্ব দেন এবং মিছিল শেষে গোলাম আযম গণহত্যাকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
[দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১]
১৪ আগস্ট পাকিস্তানের আজাদী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী ও শান্তি কমিটির মধ্যে যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে জামায়াত নেতা গোলাম আযম বলেন- ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে শান্তি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
’
[দৈনিক পাকিস্তান, ১৬ আগস্ট ১৯৭১]
শান্তি কমিটির তৎপরতা চালানোর পাশাপাশি জামায়াত নেতা গোলাম আযম পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর সহযোগী একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠনে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর নির্দেশে জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসুফ ‘৭১ এর মে মাসে খুলনার খান জাহান আলী রোডের একটি আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেন। প্রথম পর্যায়ে রাজাকার বাহিনী ছিল শান্তি কমিটির নেতৃত্বাধীন। ‘৭১ এর ১ জুন জেনারেল টিক্কা খান ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যন্স ১৯৭১’ জারি করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত করে রাজাকার বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন, যদিও এর মূল নেতৃত্ব ছিল জামায়াতের হাতে। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের পূর্ণাঙ্গ সেনাবাহিনীর সদস্যের সমান ক্ষমতা অর্পণ করে ৭ সেপ্টেম্বর এক অধ্যাদেশ জারি করে।
(নং ৪/৮/৫২/৫৪৩ পি এস=১/ক৩৬৫৯ ডি-ক)
[মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধ: শাহরিয়ার কবির]
২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকায় হোটেল এম্পায়ার এর এক কর্মী সমাবেশে গোলাম আযম বলেন, ‘পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্যই জামায়াতে ইসলামী শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। ……… জামায়াতের কর্মীরা শাহাদত বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে যে তারা মরতে রাজী, তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করতে রাজী নয়’
[দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১]
১৪ সেপ্টেম্বর ‘৭১ জামায়াতীদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম ‘আলবদর’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লিখেছিলো- ‘আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়। আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আল-বদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আল-বদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আল-বদর সাক্ষাৎ আজরাইল।
’
আল-বদর হাই কমান্ড এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটি:
১. মতিউর রহহমান নিজামী- সমগ্র পাকিস্তান প্রধান
২. আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ- পূর্ব পাকিস্তান প্রধান
৩. মীর কাশেম আলী- আল-বদর বাহিনীর তৃতীয় স্থানীয় প্রধান নেতা
৪. মোহাম্মদ কামারুজ্জামান- বদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক
৫. আশরাফুজ্জামান খান- ঢাকা শহর বদর বাহিনীর হাই কমান্ড সদস্য এবং বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের ‘চীফ এক্রিকিউটর’ প্রধান জল্লাদ
৬ মোহাম্মদ শামসুল হক- ঢাকা শহর প্রধান
৭. মোহাম্মদ ইউনূস
৮. আশরাফ হোসাইন- বদর বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ও ময়মনসিংহ জেলা প্রধান
৯. মোস্তফা শওকত ইমরান- ঢাকা শহর বদর বাহিনীর অন্যতম নেতা
১০. আ. শ. ম. রুহুল কুদ্দুস- ঢাকা বদর বাহিনীর অন্যতম নেতা
১১. সরদার আব্দুস সালাম- ঢাকা জেলা প্রধান
১২. খুররম ঝা মুরাদ
১৩. আব্দুল বারী- জামালপুর প্রধান
১৪. আব্দুল হাই ফারুকী- রাজশাহী জেলা প্রধান
১৫. আব্দুল জাহের মোহাম্মদ আবু নাসের- চট্টগ্রাম জেলা প্রধান
১৬. মতিউর রহমান খান- খুলনা জেলা প্রধান
১৭. চৌধুরী মইনুদ্দীন- বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের অপারেশন ইনচার্জ
১৮. নূর মোহাম্মদ মল্লিক- ঢাকা শহর বদর বাহিনীর নেতা
১৯. এ. কে. মোহাম্মদ আলী
২০. মাজহারুল ইসলাম- রাজশাহী জেলা বদর বাহিনী প্রধান
[সূত্র: বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ: কয়েকটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (শামীমা বিনতে রহমান), দৈনিক বাংলা, ইত্তেফাক, আজাদ ১৯৭২]
উল্লেখ্য শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী প্রভৃতি দিয়েও কোনোভাবে যখন পরাজয় ঠেকিয়ে রাখতে পারছিলো না পাক বাহিনী, তখন ঠিক পরাজয়ের প্রাক্কালে বাঙ্গালী জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়ার অন্যতম উপায় হিসেবে গেস্টাপো বাহিনীর কায়দায় তারা মেতে ওঠে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে। আর সেকারণেই গঠিত হয় আল-বদর আল-শামস বাহিনী। যার পূর্ণ নেতৃত্বে ছিলো জামায়াত ইসলামী। এবং যাদের প্রধান কাজ ছিলো পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে বৈঠক করে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা প্রণয়ন করা। দেশের প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, ক্রীড়াবিদ ও সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন পেশার শত শত বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী এই আল-বদর বাহিনী।
‘৭১ এর ৭ নভেম্বর ‘বদর দিবস’ উদযাপন করতে গিয়ে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের প্রাঙ্গণে ইসলামী ছাত্র সংঘের এক সমাবেশে আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ চার দফা ঘোষণা প্রচার করেন। এই ঘোষণায় বলা হয়, ‘…. যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দুস্তানের নাম মুছে দেয়া না যাবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেবো না। …….. আগামীকাল থেকেক হিন্দু লেখকদের কোন বই অথবা হিন্দুদের দালালি করে লেখা পুস্তকাদি লাইব্রেরীতে কেউ স্থান দিতে পারবেন না, বিক্রী বা প্রচার করতে পারবেন না। যদি কেউ করেন তবে পাস্তিানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকরা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে। ….. এই ঘোষণা বাস্তবায়িত করার জন্য শির উঁচু করে বুকে কোরান নিয়ে মর্দে মুজাহিদের মতো এগিয়ে চলুন।
প্রয়োজন হলে নয়াদিল্লী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আমরা বৃহত্তর পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করবো। ’
[দৈনিক পাকিস্তান, ৮ নভেম্বর ১৯৭১]
একই সমাবেশে ইসলামী ছাত্রসংঘের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মীর কাশেম আলী ‘বদর দিবসের শপথ’ হিসেবে ঘোষণা করেন-
ক) ভারতের আক্রমণ রুখে দাঁড়াবো
খ) দুষ্কৃতকারীদের খতম করবো
গ) ইসলামী সমাজ কায়েম করবো
[দৈনিক পাকিস্তান, ৮ নভেম্বর ১৯৭১]
বদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মতিউর রহমান নিজামী ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রাম-এ লিখেছেন- ‘সেদিন আর খুব দূরে নয়, যেদিন আল-বদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে, হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে। ’
বদর বাহিনীর অপর দুই প্রধান নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং মীর কাশেম আলী ২৩ নভেম্বর এক বিবৃতিতে সৈনিক হিসেবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার জন্যে সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। এসময় প্রকাশিত তাদের এক প্রচারপত্রে বলা হয়- ‘মনে রাখবেন আপনারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কেবল যুদ্ধ করছেন না। এ যুদ্ধ ইসলামের।
নমরুদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমীরের (গোলাম আযমের) নির্দেশ পালন করুন। ’
পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র (রাজনৈতিক) বিবাগের পাক্ষিক গোপন প্রতিবেদনে (‘৭১এর অক্টোবরের দ্বিতীয়ার্ধে) বলা হয়েছে- ‘১৭/১০/৭১ তারিখে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘ (ICS) রংপুর শাখার একটি সম্মেলন (১০০ জনের) এটিএম আজহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্যদের ভেতর WPICS এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী আহসান মোঃ মুজাহিদ সম্মেলনে বক্তব্য প্রদানকালে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বলেন- দলের কর্মীদের উচিৎ হবে ইসলামবিরোধী তৎপরতার বিরুদ্ধে ইসলামী চেতনার যুব সম্প্রদায়কে নিয়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলা। তিনি বিভিন্ন স্তরে আলবদর বাহিনী গঠন করে দেশকে ভেতরের ও বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষারও আহ্বান জানান। ’
‘৭১ এর নভেম্বরের প্রথমার্ধের অনুরূপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- ৭/১১/৭১ তারিখে ঢাকাসহ প্রদেশের অন্যান্য স্থানে আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা প্রভৃতি আয়োজনের মাধ্যমে ‘আলবদর দিবস’ পালিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের দ্বারা, যেখানে অন্যান্য বিষয়ের ভেতর পাকিস্তানের প্রতি হিন্দুস্থানের আগ্রাসী মনোভাবের নিন্দার পাশাপাশি আলবদর বাহিনীতে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শত্রু ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
’
উল্লেখ্য, পাকিস্তানের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে এ ধরনের বহু বিবরণ পাওয়া যাবে।
এরপরেও জামায়াত নিজেদেরকে নির্দোষ দাবী করবে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।