আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দীনেশ দাসের দুই ঘাতক: আবু হাসান শাহরিয়ার ও ট্রাক

সাংবাদিক হিসাবে দীনেশ দাসকে চিনি সেই নব্বইয়ের দশক থেকে। নিজে নিউজ লিখলেও সাহিত্যের প্রতি তার ঝোক ছিল বেশি। বইমেলায় এক বাণ্ডিল বইয়ের প্রচ্ছদ হাতে দীনেশ দাসকে সবসময় দেখা যেত ব্যস্ত সন্ত্রস্ত। কারণ একটু পরই ছুটতে হবে কাভারগুলো নিয়ে পত্রিকার অফিসে। প্রায় সব তরুণ লেখকদের সাথেও এভাবেই পরিচয় হয়ে যেত দীনেশ দার।

আমার সাথেও এর ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু তাকে সহকর্মী হিসাবে পেয়েছিলাম গেল বছর আমাদের সময়ে। কাজ করতে গিয়ে দেখলাম মানুষ হিসাবে সরল। ব্যক্তিত্ববান হওয়া স্বত্বেও হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তার বয়সে ছোট অনেক ছোকরাও দীনেশ দাকে বকাঝকা করত।

পত্রিকার সম্পাদক গোষ্ঠীর সাথে খাতিরের সূত্রে। তাও দীনেশ অপরাধীর মতই মাথা নত করে মেনে নিতেন। আদতে তিনি এগুলোকে প্রশ্রয় দিতেন মনে হয়। কারো বিরুদ্ধে কোনোদিন কোনো অভিযোগ করতে দীনেশ দাসকে কেউ দেখেছে কিনা জানিনা আমি দেখি নাই। সত্যি বলতে কি দীনেশ দাকে অতি সরলতার জন্য ঘৃণা করতাম।

সবকিছু চুপচাপ মেনে নেয়া একজন ঋষি টাইপের অচল মানুষ। যে ধরনের মানুষের ওপর ইদুর চামচিকাও তাদের ব্যক্তিত্বগিরি ফলায়। তাদেরকে তো বর্তমান সময়ে অচলমানুষই বলা যায় নাকি। যাইহোক দীনেশ দা নিহত হয়েছেন। তাই আজ বাধ্য হয়ে কিছু কথা বলছি।

দীনেশ দাকে ট্রাক চাপা দিয়েছে তিনি মরেছেন কিন্তু তারও আগে তিনি মরেছিলেন আবু হাসান শাহরিয়ারের হাতে, হয়তো সেই মৃত্যু চিন্তার কারণেও তিনি ট্রাকের তলায় চলে যেতে পারেন। যখন তিনি ট্রাকের তলায় চলে যাচ্ছেন তখন হয়তো আবু হাসান শাহরিয়ারকেই ভাবছিলেন। এরকম হয়, শাহরিয়ার যখন বিভিন্ন ছল ছাতুরিরর মাধ্যমে আমার চাকরি খায়। আমারও এরকম হয়েছিল। হারানো প্রথম প্রেমিকার মতই তাকে ভেবেছি আমি।

কারণ বাসাভাড়া না দিতে পেরে বাড়ীওয়ালার গালাগালি শুনলেই শাহরিয়ারের কথা মনে পড়ে, দুধ না পেয়ে বাচ্চা কাঁদলেই শাহরিয়ারের কথা মনে পড়ে। চাকরি যাওয়া শূন্য হাতে সমস্ত প্রতিবন্ধকতার সামনে যেন শাহরিয়ারই আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন বেকার জীবন অতিবাহিত করাকালে আমি একবার স্বপ্নে দেখি পরিবারের সবাই মিলে শাহরিয়ারের সুস্বাদু মাংশ খাচ্ছি। দীনেশ এখন মরেছেন ট্রাকে আগে মরেছিলেন আবু হাসান শাহরিয়ারে ছলনায়, ষড়যন্ত্রে। আবু হাসান শাহরিয়ারকে মিডিয়া চাকুরি করা প্রায় মানুষ চিনে।

তিনি একসময় ছড়া লিখতেন। অনেকগুলো পর্ণ বইয়ের প্রকাশক ছিলেন, বাংলাবানান নিয়ে প্রায় মানুষকে উপদেশ দিয়ে থাকেন। কারণ বাংলা একাডেমির ডিকশনারী তার মুখস্থ,এটাই তার একমাত্র যোগ্যতা। যদিও প্রায় সময় তিনি প্রলাপ বকেন তিনি কোন এক নেতার নাতি। তার মর্যাদাও শেখ মুজিবের নাতি জয়ের মত হওয়া উচিত।

শাহরিয়ারের সাথে কাজ করা মানুষ মাত্রই জানেন। । শাহরিয়ারকে হত্যাকারী হিসাবে চিহিৃত করতে হলে সামান্য অনুষঙ্গ দরকার হবে তাই খানিক পিছনে ফিরে তাকাতে হবে আমাদের। সালটা ঠিক মনে নাই। তিনি তখন তৎকালীন বেক্সিমকোর মুক্তকণ্ঠে ‘খোলাজানালা’ নামে একটা সাহিত্য পাতার সাংবাদিক ছিলেন।

তখন তার সহকারী ছিলেন স্বনামধন্য কবি টোকন ঠাকুর। চলচ্চিত্র বিষয়ক আমার দুইটা লেখা ছাপা হয়েছিল সেখানে। সেই সূত্রে তৃতীয়বার আমি আরেকটা লেখা নিয়ে গিয়েছিলাম। স্পষ্ট মনে পড়েনা অই ঘরে তখন অন্য কে কে ছিল। অতর্কিতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তুমি তো খুব গদার-মদার নিয়া লিখছো।

এই বাংলায় কত গদার-ফদার আছে তা কি দেখতে পাও? আমি অবাক ও বিব্রত হয়েছিলাম তার এই ধরনের আচরণে কারণ এর আগে শাহরিয়ারের সাথে আমার কোনো কথা হয় নাই। বিশ্ময় কাটিয়ে বলেছিলাম, কারা.. শাহরিয়ার ভাই.. এই বাংলার গদার..। শাহরিয়ারকে যারা চিনে তারা জানে ক্ষমতাহীন শাহরিয়ার যত মমত্ববানের অভিনয় করতে জানে। ক্ষমতাবান শাহরিয়ার তত নিষ্ঠুর আচরণ করে। তিনি গলা সপ্তমে চড়িয়ে বললেন, আবুহাসান শাহরিয়ার- টোকন ঠাকুর কি বাল ছিড়ে বাংলা কবিতায়!!! বলাবাহুল্য এরপর শাহরিয়ারের পাশ দিয়েও যাইনি।

কিন্তু শাহরিয়ার কিছুই ভুলে না। বুঝতে পারলাম যখন অহেতুক বিভিন্ন কারণে তিনি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা শুরু করেন। এক পর্যায়ে মানসিক সঙ্কটে ফেলেন আমাকে। শেষে বাধ্য করেন চাকরি ছাড়তে। একটা পত্রিকার মালিকানা হস্তান্তরের পর যে ভয়ংকর পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তা অনেক কৌশলে সামলাতে দেখি নাঈমুল ইসলাম খানকে।

কোথাও কোনো ভারসাম্যহীনতা নাই। উনি ভরসা দিলেন এবং তা বাস্তবায়ন করলেন যে কারো চাকরি যাবে না। কারণ এই পত্রিকার সব সাংবাদিকরাই নাঈমুল ইসলাম খানয়ের পারিবারিক সদস্যের মতই। কিন্তু নিজে সম্পাদক হওয়া স্বত্তেও যে কাজটা মানবিক কারণে নাঈমুল ইসলাম খান করতে পারেন নাই। তা অবলীলায় করতে দেখি আবু হাসান শাহরিয়ারকে।

যোগদানের পর দু’একদিন হাসি হাসি মুখে সবার খোঁজখবর করলেন। ভালবাসার ভান করলেন। গল্পগুজবে হাসি তামাশায় মেতে ওঠলেন। কিছু স্তাবকদের নিয়োগ করলেন। তার মধ্যে শাহরিয়ারকে কবি প্রমাণ করার জন্য আস্ত বই লিখেছে এই রকম লোকও আছে।

এবং খুব দ্রুত পত্রিকার দুর্বল কিন্তু খল চরিত্রের কিছু লোক নিজের দলে টেনে নিলেন, স্তাবকগিরি ছাড়া যাদের কোনো মেরুদণ্ডতো নাই, কোনো যোগ্যতাও নাই। পত্রিকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে খুব দ্রুত নিজের আখের গোচানোর জন্য শাহরিয়ার কর্পোরেট হাউজের দালালে পরিণত হন । এবং তার মূর্খ স্তাবকগুলো যার তার সাথে হম্বিতম্বি করতে থাকে। নাঈমুল ইসলাম খান যা করতে পারেন নাই। মালিকের পক্ষ হয়ে যা করতে না পারার কারণে অধিনায়ক থেকে আসা মঞ্জু ভাইও নির্জীব তাই অবলীলায় করার জন্য শার্টের হাতা গোটালেন শাহরিয়ার।

বিনাদোষে বা সামান্য কারণ দর্শিয়ে আমাদের সময়ের জন্ম থেকে জড়িত সাংবাদিকদের একের পর এক চাকরি খাওয়া শুরু করলেন। এই রকমই এক পরিস্থিতির শিকার আজ নিহত দীনেশ দাস। অতর্কিতে চাকরি যাওয়া কী মর্মান্তিক তা ভূক্তভোগী মাত্রই জ্ঞাত। মৃত্যুর আগে দীনেশ দাসের কী মর্মান্তিক অবস্থা হয়েছিল তা ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি। তিনমাসের বাসাভাড়া বাকী।

পকেটে ২০ টাকা আছে। সম্পর্কের সূত্রে এই কথা তিনি আমাকেও বলেছিলেন একদিন। লোন চেয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমার পকেটে ২০ টাকাও ছিল না। 'অ আপনারও এই অবস্থা' বলে চলে যাওয়া দীনেশের দিকে তাকিয়েছিলাম অনেক্ষণ।

এখনো আমাদের সময়ে শাহরিয়ার যাদের চাকরি খেয়েছে অনেকেই যারা কোথাও চাকরি পায়নি। তাদের অবস্থা দীনেশের চাইতেও ভয়াবহ। হয়তো শাহরিয়ারের হত্যা করার ধরণ আলাদা। শাহরিয়ার আমাদের সময়ের অজস্র সাংবাদিকের জীবিকা কেড়ে নেবার পরও কেউ তাকে দোষীও করতে পারে নাই। কারণ কী এক অজানা কারণে শাহরিয়ার বাংলাদেশে ক্ষমতাবান মানুষ।

কারণ তিনি গালবাজ, চাপাবাজ। তার মুখ বিদ্যুতের মত। তিনি মুহূর্তের মধ্যে সার্কাসের সঙের মত ডিগবাজি খেতে জানে। এরাইতো এই যুগের পীর। শাহরিয়ারের হীনমন্যতার সামান্য নজির দিলে মনে হয় বাহুল্য হবে না।

আমাদের সময়ে আমরা বেশ কয়েকজন নিয়মিত কলাম লিখতাম। তাদের মধ্যে অনেকে বিদেশেও থাকেন। আবিদ রহমান, আহমেদ শরীফ শুভ, ড. কালাম আজাদ, মিল্টন হাসনাৎ, আকিদুল ইসলাম সহ অনেকে। এই কলামিস্টরা কোনো বিলের তোয়াক্কা করতেন না। নিজের কথা বলতে গেলে আমি লিখতাম।

নাঈমুল ইসলাম খান লেখার কোনো অংশ সংশোধন করতেন না, এবং যথাযোগ্য সম্মানের সাথে লেখা ছাপতেন। কলাম গুলো প্রায়শই প্রথম পাতায় জ্বলজ্বল করতো। শাহরিয়ার যোগ দেয়ার পর কলামগুলো স্থান পেল এমন জায়গায় তা আর কলাম বলে চেনা যেতনা। এটা একেবারেই ইর্ষা থেকেই তিনি করতেন। আমার একটা লেখা সম্পাদক সেন্টারপিস মার্ক করে দেয়ার পর লেখাটা তিনি এতই গুরুত্বহীন করে দিলেন।

যেন লেখাটা কেউ দেখতে না পায়। একই পাতায় আবার তার নিজের একটা দালালি মার্কা লেখাকে পত্রিকার মেইন স্টোরি করে দিলেন। প্রায় সময় বলতেন আবিদ রহমান মূর্খ, আকিদুল ইসলাম মূর্খ, রাজাকার ইত্যাদি। কারণ এই দু'জনের লেখাই বেশি ছাপা হতো আমাদের সময়ে। তার স্তাবকদের কারণে তার মলমূত্রও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যেত ছাপার পর।

সবাই খুব তৃপ্তি পাওয়ার ভান করতো, আর তাদের বেতন বাড়িয়ে দেয়া হত। পেশাদার হত্যাকারীরা একজনকে হত্যা করে, শাহরিয়ার হত্যা করে একটি পরিবার। ধীরে ধীরে। সেটা মৃত্যুর আগে দীনেশও বহুবার বহুজনকে বলে গেছেন প্রকাশ্যে। তাই দীনেশের মৃত্যু নিয়ে কথা বলার আগে শাহরিয়ারে বিচারের কথাও তুলতে হবে।

। এরকম খুনীরা আমাদের ভেতর বেঁচে আছে বিভিন্ন ছদ্মবেশে, আমাদের পরিত্রাতার পোষাকে। যারা আজ শাহরিয়ারকে ছিড়ে টুকরো করার স্বপ্ন দেখে, দাঁতে ছিন্নভিন্ন করার স্বপ্ন দেখে দীনেশের হত্যাকারীরূপে এই শালিসকে রাষ্ট্রের কাছে নিয়ে যাওয়াই তাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। আর ছড়াকার, পর্ণ বইয়ের প্রকাশক, বা বানান মুখস্থকারী হিসাবে আখ্যায়িত করার আগে চিহিৃত করতে হবে আবু হাসান শাহরিয়ারকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী, এক নীরব সিরিয়াল কিলার হিসাবে। ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.