আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাড়ির পাশের আরশিনগর...... জয়স্কন্ধভার শ্রীবিক্রমমনিপুর

হাউকাউ পার্টি "বিক্রমপুরের পোলা আশি টাকা তোলা"--------- ইমদাদুল হক মিলনের লেখা এবং তৌকির/বিপাশা অভিনীত " রুপনগর" নাটকে রফিকুল্লাহ সেলিম এর ঠোটে অতি চর্বিত একটা ডায়লগ ছিল। অনেকের মতো আমিও খুব মজা পেয়েছিলাম, মনে হতো এই প্রবচনটার উদ্ভব হলো কিভাবে! যাই হোক, তারও অনেকপরে যখন বিক্রমপুরের ইতিহাস নিয়ে কিছু পড়ালেখার সুযোগ পেলাম, তখন মনে হলো, প্রবচনটা উদ্ভব যৌক্তিক। কেন বলছি সে কথা? আসুন দেখি......... বিক্রমপুর নিম্ন গাঙ্গেয় উপত্যকায় পদ্মা-মেঘনা-বক্ষ্রপুত্র বিধৌত অঞ্চল। প্রাচীন বিক্রমপুর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থান। বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলার বেশিরভাগ অঞ্চল এর অন্তর্ভুক্ত হলেও এক সময়ে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার বিস্তৃত অঞ্চল সহ পদ্মা নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যাওয়া বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এর অবস্থান ছিল।

গবেষকগণ চন্দ্র, পাল ও সেন রাজাদের বাংলার রাজধানী হিসাবে বিক্রমপুরকে উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন লিপিসাক্ষ্যে বিক্রমপুরকে "জয়স্কন্ধভার" বলে উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হবার কারণে প্রতিটি রাজবংশ তাদের জয়স্কন্ধভার" বা বিজয় ছাউনী এখানে স্থাপন করেছিল। বিক্রমপুর, রামপাল, ব্রজযোগিনী, বল্লাল বাড়ি সহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী স্থান নাম থেকে বিক্রমপুরের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে ধারণা পাওয়া যায়। এ অঞ্চল থেকে চন্দ্র ও সেন রাজবংশের বেশ কিছু তাম্র লিপি পাওয়া গেছে, এছাড়া বৌদ্ধ ও হিন্দু সভ্যতার বেশ কিছু প্রস্তর ভাস্কর্য, কাঠের ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, যেগুলো বাংলাদেশ জাতীয় যাদুঘর, বরেন্দ্র রিসার্চ যাদুঘর ও ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম কোলকাতায় প্রদর্শিত হচ্ছে। এখানে বিশ্বনন্দিত অনেক গুনীজন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পন্ডিত অতীশ দিপঙ্কর, নালন্দা মহাবিহারের আচার্য শীলভদ্র।

এখানে বসেই বল্লাল সেনের শিক্ষাগুরু গোপালভট্ট রচনা করেছিলেন :বল্লাল চরিত"। বিক্রমপুরের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ, ঢিবি, জলাশয়ে সেই প্রাচীন আলোকিত সভ্যতার কিছুটা আজও ধারণ করেছে। আসুন দেখে নেই কিছু প্রাচীন জয়স্কন্ধভার শ্রীবিক্রমমনিপুরের বর্তমানের কিছু নিদর্শন...... মুন্সিগঞ্জ ভাগ্যকুলের ভুতপূর্ব জমিদার যাদুনাথ সরকারের বাড়ি। এই স্থাপত্য কমপ্লেক্সে রয়েছে ৪ টি আলাদা স্থাপত্য এবং ২ টি পুকুর। আরেকটি ভবন।

মন্দির এখানেই গড়ে তোলার প্রকল্প চলছে বিক্রমপুর যাদুঘর এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। এটা দেখে কি দিল্লীর রেড ফোর্টের প্রবেশদ্বারে কথা মনে পরছে না? এটা বিক্রমপুরের আরেক জমিদার টোকর পালের প্রাসাদ কমপ্লেক্সের প্রবেশ দ্বার। কমপ্লেক্সের ঢোকার মুখেই চিনিটিকরী কারুকায করা দারুন সুন্দর একটা মন্দির। মন্দিরের স্তম্ভ এটা অন্দর মহলের একটা অংশ সব গুলো জানালার উপরের প্যানেলে এমন স্টাকো ফ্লোরাল ডেকোরেশন। এটা আরেকটি ভবন।

এমন ধরনের ৫/৬টা আলাদা প্রাসাদ আছে সেখানে। পুকুর ঘাট টঙ্গী বাড়ি সোনারং গ্রামে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে বিখ্যাত সোনারং মন্দির। শিখর শীর্ষ মন্দিরের নীচের অংশটা। অনেক বড় এ কারনে পুরোটা এক ফ্রেমে আনতে পারিনি। রামপাল থানার কসবা গ্রামের বাবা আদম মসজিদ, সুলতানী স্থাপত্যকলার একটি চমৎকার নিদর্শন।

মসজিদের গায়ে সংযুক্ত শিলালিপি অনুযায়ী এর নির্মানকাল ৮৮৮ হিজরী/ ১৪৮৩ সাল। সুলতান ফতেহ শাহ এর শাসনামলে মালিক কাফুর এটা নির্মান করেছিলেন। মসজিদের সামনের দিকের আর্চে রয়েছে পোড়ামাটির ফুল লতা-পাতার অলংকরন। এছাড়া মসজিদের কার্নিশ প্যানেল গুলোতে পোড়ামাটির ফলকে জিওমেট্রিক আর ফ্লোরাল ডেকোরেশন রয়েছে। এখানে রয়েছে একটা সুলতানী আমলের জলদূর্গ, ইদ্রাকপুর দূর্গ।

এছাড়াও এখানে আছে বল্লাল সেনের দিঘী, রাজবাড়ীর ঢিবি, শান্তিবাবুর বাড়ির মঠ, টঙ্গিবাড়ি মঠ, শ্যামসিদ্ধীর মঠ ইত্যাদি। সুলতানী, মুঘল এবং ঔপনিবেশিক আমলের এই স্থাপনা গুলো আজও ঠিকে থাকলেও কালের পরিক্রমায় গুপ্ত এবং পাল আমল বিক্রমপুরের মানববসতি সম্পর্কিত প্রত্যক্ষ কোন নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়নি। এছাড়া পদ্মা এবং ধলেশ্বরী নদীর করাল গ্রাসে প্রাচীন বিক্রমপুরের অনেক অংশই বিলিন হয়ে গেছে। তারপরও বিক্রমপুরের সেই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে খুজে বের করার জন্য ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রালয়ের আর্থিক সহায়তায় 'অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের' উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র "ঐতিহ্য অন্বেষণ" এবং জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ ও অন্যান্য গবেষকগণের অংশ গ্রহণে এখানে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে উৎখনন এবং অনুসন্ধানের কাজ শুরু হয়েছে। উৎখননে পাওয়া স্থাপত্যিক নিদর্শনের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য হলো রঘুনাথপুরে আবিস্কৃত ৫ মিটার দীর্ঘ এবং ১.৪৫ মিটার চওয়ার ইটের দেয়াল।

দেয়ালে পার্শ্ব সংযুক্তি থাকায় একে তাৎপর্যপূর্ণ স্থাপনা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া সুখবাসপুর, বজ্রযোগিনী গ্রাম, গুহাপাড়া, খানকা ইত্যাদি গ্রামে ৯ টা উৎখনন ট্রেঞ্চ নেয়া হয়েছিল ২০১০। উৎখননে পাওয়া ইটের পরিমাপ থেকে ধারণা করা হয় কোন কোন স্থানের সময়কাল প্রাক-মধ্যযুগ হতে পারে। উৎখননে পাওয়া কিছু জৈব অবশেষ কার্বন ১৪ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে, এটার রেজাল্ট পাওয়া গেলে সঠিক সময়কালটা বলা সম্ভব হবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১২ এর ৭ই জানুয়ারী দ্বিতীয় পর্যায়ের খনন কাজ উদ্বোধন করা হয়।

উদ্বোধনে এসেছিলেন বিচারপতি হাবিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পারছি না, এই বয়সে হাবিবুর রহমান স্যারের এই সকল বিষয়ে এত উদ্যম আর উৎসাহ খুব প্রেরণা দেয়। তিনি নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বেরও একাধিকবার এসেছিলেন। ঊৎখনন আর অনুসন্ধান চলুক পূর্ণোদ্যমে, আশা করা যায় এর এসব সূত্র- ধরে ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য অঞ্চলে ক্ষেত্রীয় জরিপ আর উৎখননের মাধ্যমে প্রাচীন বিক্রমপুরের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে খুজে বের করা সম্ভব হবে। যেভাবে যাবেন উৎখনন দেখতে: ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হল মার্কেটের উল্টো দিক থেকে বাস যায় ধলা গাঁও বাসস্টান্ড পর্যন্ত।

এখানে নেমে ডানের রাস্তা ধরে ২০০ মি: এর মতো হাঁটলেই পৌছে যাওয়া যাবে উৎখনন ট্রেঞ্চে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।