আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাছের কান্না আর একটা ওয়েটিং রুমের গল্প

ব্লগ লেখা-পড়া মজা ভারী .....অনেক লেখাই দরকারী মীরা যে জায়গাটাতে বসে আছে সেটাকে "ওয়েটিং রুম" বলে। এই জায়গাটাতে আজকেই মীরা প্রথম এসেছে। এরপর হয়ত আরো আসবে কখনো কিন্তু আজকে যে কারণে এসেছে সেটার জন্য ভিতরে ভিতরে খুব উত্তেজিত সে। অনেকের কাছেই সে ওয়েটিং রুম যে কতটা বিরক্তিকর এ্কটা জায়গা শুনেছে। কিন্তু গত ৪৫ মিনিট ধরে মোটেও বিরক্ত লাগছে না মীরার।

আশে-পাশে কি হচ্ছে বা ওকে এখানে দেখে কে কি ভাবছে বা বলছে সেটা শোনার খুব চেষ্টা করছে মীরা। একা একা বসে থাকলে এইভাবে আশেপাশের সব কিছুতে খেয়াল রাখলে সময় দিব্যি কেটে যায়। মীরা কেন একা বসে আছে সেটা অবশ্য এখনো পরিস্কার না। ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর এই হলটা ছেলেদের। তাই মেয়েদেরকে বাইরে ওয়েটিং রুম এ বসে থাকতে হয়।

এখানে সারাদিন-ই মানুষের আনাগোনা থাকে। ঢাকা এসছে যে ছেলে প্রথমবারের মত। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর বাবা-মা-বোন সবাই আসে মফস্বলের শহর থেকে ছেলেকে দেখতে। মা নিজের হাতে করা পিঠা আনে। মাঝে মাঝে হাসের ডিম, তিলের নাড়ু, মোয়া এইসব কিছু নিয়ে এসে ছেলেগুলোকে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়।

আর বাবারা নিয়ে আসে একগাদা উপদেশ। "নিয়মিত ক্লাস করবি", "ভুলেও ছাত্র-রাজনীতি করবি না", "অযথা টাকা নষ্ট করবি না" আরো কত কি!!! আর বোনগুলোর চোখে থাকে পানি। তার ভাইয়ুটা কেন এত তাড়া্তাড়ি বড় হয়ে গেলো? এখন কার নামে বাড়িতে সে সারাদিন নালিশ করবে? কে তাকে সদর থেকে বিনোদন পত্রিকা এনে দিবে? আর পুরো সময়টা ছেলেগুলো থাকে অস্বস্তিতে। কারণ রুমে ফিরলেই রুমমেটরা হাসাহাসি করবে। আরো কত কি বলবে!!! কিন্তু যেই বাবা-মা-বোন চলে যায় অমনি তাদের মনে ভীড় করে রাজ্যের খারাপ লাগা।

এইরকম নানা রকম অনুভূতির আখড়া হচ্ছে এই ওয়েটিং রুম গুলো। আর এখানেই বসে আছে মীরা। মানুষের অনুভূতির এই নানা রঙ বুঝতে খুব আনন্দ। ছেলেদের ওয়েটিং রুমে কোন মেয়েকে একলা বসে থাকতে দেখলে ছেলেরা এইদিক দিয়ে যাওয়ার সময় অবশ্যই আড়চোখে দেখে যাবে। মীরাকেও কি এভাবে সবাই দেছে কিনা সেটা সে বুঝতে পারছে না।

৪৫ মিনিট এখন ১ ঘন্টা হল। মোবাইল ফোনের এই যুগে হয়ত অন্য কেউ হলে এর মধ্যে ফোন দিয়ে তুলকালাম করে ফেলত কিংবা সে আসলে পড়ে কিভাবে তাকে হেস্তনেস্ত করা যায় সেটার নীল নক্সা করতে থাকতো। কিন্তু মীরা আসলে এসব জিনিসগুলোকে নিতান্ত ছেলে মানুষী মনে করে। মানুষের জন্য অপেক্ষা করাটা খুব আনন্দের। কারণ এই সময়টাতে নিজে নিজে মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নেয়া যায় কি বলব বা কি বলব না এইসব।

আর এতে দুইজনের মধ্যে প্রথম থেকেই একটা কম্ফোর্ট লেভেল বজায় থাকে। হলে আজকে বোধহয় কোন বড় উপলক্ষ্য আছে। কারণ কিছুক্ষণ পরপর একগাদা ছেলে মিছিল করছে। কিছুক্ষণ হাহাকার করে ছেলেগুলো ভিতরে চলে যায়। মাঝে মাঝে নেতা গোছের এক-দুইজন ২-৩জন চ্যালা টাইপ ছেলে নিয়ে এদিক ওদিক ছুটছে।

এটা অবশ্য হলগুলোতে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটে। মটর সাইকেল আসছে কয়েকটা আবার চলেও যাচ্ছে। মীরা বসে বসে অবাক হয় কারণ মেয়েদের হলগুলোতে ব্যস্ততা বা ছুটোছুটির ব্যাপারগুলো অন্যরকম। মীরার সামনে একটা টেবিল আছে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ছোট্ট ড্রয়িংরুমে চারপেয়ে নিরীহ গোছের যেরকম টেবিল থাকে সেরকম একটা টেবিল।

টেবিলের উপর ৪-৫ দিন আগের পুরনো খবরের কাগজ পড়ে আছে। খবরের কাগজের একটা মজার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটার আয়ুস্কাল কিংবা মুল্য শুধু একদিনের জন্যই। এরপরের দিনেই এটা হয়ে যায় পুরনো। অবশ্য পুরোনো খবরের কাগজ জমানো মীরার শখ। একটার উপর আরেকটা সাজিয়ে রাখে সে।

আর পত্রিকার সাথে যে সাপ্লিমেন্টারি দেয়া হয় সেগুলো আলাদা করে রাখে। একটা বিশাল বড় কাপবোর্ডে পত্রিকাগুলো রাখে সে। মাঝে মাঝে চাকরীর বিজ্ঞাপন, পাত্রী চাই কিংবা যে কোন প্রয়োজনে সবাই এসে ওর কাছ থেকে পত্রিকা নিয়ে যায়। আর তার বিনিময়ে চকলেট-চিপ্স ও জোটে ভালো। খবরের কাগজ উড়ার শব্দ শুনে মীরার মনে পড়ে গেলো এসব কথা।

আর এই ফাঁকে একটু মিটমিট করে হেসেও নেয় সে। একা একা হাসির ব্যাপারটা অবশ্য অনেকে আজব ভাবে নেয় কিন্তু মীরার সেটা ভালই লাগে। এতে মন অনেক ফুরফুরো লাগে। ঘড়িতে কটা বাজে সেটা মীরার দেখার উপায় নেই। তবে সে এ্টা বুঝতে পারছে নেহায়েত ২ টা বাজে।

কারণ মীরার ক্ষুধা লেগেছে। ব্যাপারটা অদ্ভূত হলেও মীরার এতে সুবিধা হয়। সকালে ঠিক ৭ টায় ক্ষুধা পায় ওর এরপর দুপুর ২ টা আর রাত ৮ টা। অনেকে অবশ্য এর জন্য মীরাকে ক্ষ্যাত বলে কারণ এতো নিয়ম মেনে নাকি খাবার খেতে নেই শহরে। কিন্তু এই নিয়ম মানার কারণেই মীরার কখনো আলসারের সমস্যা হয়নি।

ওর দেহের গড়নও খুব সুন্দর। হ্যাংলা পাতলাও না আবার স্থুলকায়ও না ও মোটেও। যেকোন মেয়ে ওকে দেখেই হিংসা করবে। কিছুটা নিয়ম মেনে চলা এই মীরা যদিও আজকে অনেক আগ্রহ নিয়ে বসে আছে কিন্তু ওর পেটের ক্ষুধা ওকে কতক্ষণ শান্তিতে বসতে দিবে সেটা সে বুঝতে পারছে না। আশে-পাশে খাবারের দোকান কি আছে সেটা বুঝতে পারছে না মীরা।

এই জায়গাটাতে নতুন এসেছে তাই। এখন যদি খাবারের জন্য বাইরে যায় ও তাহলে গত ১.৫ ঘন্টা যার জন্য অপেক্ষা করেছে সে এসে তাকে না পেয়ে চলে যাবে। মীরা ভাবতে থাকে কি করবে। মানুষের ক্ষুধা লাগলে আশে-পাশের খাবারের ঘ্রাণ ঠিকি নাকে এসে লাগে। কিন্তু পেট ভরে গেলে এরপর আর ঘ্রাণ পায় না সে।

বিরানী এর গন্ধ টা ঠিক এইসময়ে কেন ওয়েটিং রুম এর আশেপাশে ঘুরাঘুরি করছে সেটা মীরা বুঝতে পারে না। কিছুক্ষণ আগেও ছিলো না ঘ্রাণটা। এখন মোটামোটি ওর ক্ষুধাকে টিজ করছে এই ঘ্রাণটা। নীলক্ষেতের ইয়াসীন এর তেহারী, চানখারপুলের মামুনের বিরানী কিংবা নান্নার বিরানী গুলোর সবগুলোই গলাধঃকরণ করা হয়ে গেছে মীরার। কিন্তু মীরার মা যে বিরানী রাধেঁন সেটা অমূল্য।

স্বর্গীয় খাবারের স্বাদ যাকে বলে। এই মুহূর্তে নিজের মা কে কেন মনে পড়ছে সেটা মীরা বুঝচ্ছে না। ওর দরকার খাবার। কিংবা অন্তত একটা ছোট বোতলের ঠান্ডা পানি যাতে ক্ষূধাটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মরে যায়। “আপা চা খাইবেন?” একটা ১৩-১৪ বছর বয়সী ছেলে এসে জিজ্ঞেস করে মীরাকে।

এই আপুকে প্রথমবারের মত দেখছে এখানে পিচ্চিটা। অনেকক্ষণ ধরে সামনে একটা গোল কাঁচের বোউল নিয়ে বসে আসে আপুটা। কাঁচের বোউলের ভিতর ৬ টা নীল রঙের মাছ। ছোট ছোট। পিচ্চি ছেলেটা একটু পর পর এসে মাছগুলো দেখে যাচ্ছে দূর থেকে।

কাছে আসতে সাহস পাচ্ছিলো না। গত আধাঘন্টায় সে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে। তাই এসেই চা খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে। যাপিত সৌজন্য যাকে বলে আরকি। শহরে থাকতে থাকতে এইরকম সৌজন্য রপ্ত করে ফেলেছে রাজু।

বাবা-মা ওর নাম রাজু রাখলেও হলের বড় ভাইরা ওকে আদর করে জু জু ডাকে। এতে রাজুর অবশ্য ভালই লাগে। সে জানে না জু জু মানে কি। কিন্তু ভাইয়ারা এই নামে ডেকে যে খুব মজা পায় সেটাই বড় আনন্দের। রাজুর কথা শুনে মীরা নড়েচড়ে বসে।

ওর প্রাণে যেন পানি পায়। ছেলেটাকে কাছে ডাকে মীরা। রাজু এক দৃষ্টিতে মাছগুলো দেখছে। এরকম নীল মাছ সে আগে কখনো দেখেনি। মাছগুলোর চোখগুলো খুব সুন্দর।

মনের অজান্তেই সে কাঁচের বোউলে একটা টোকা দেয়। মাছগুলো ভয় পায়। ছুটোছুটি করে। মীরা হাসে। রাজুর নাম জেনে নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে আশে-পাশে কোথায় খাবার পাওয়া যাবে।

আপুটার কথাগুলো খুব সুন্দর লাগে রাজুর। এত আদর করে কেউ ওর সাথে এর আগে কথা বলেছে শেষ কবে সে জানে না। ওকে তুমি করে বলছে দেখেও রাজু লজ্জা পাচ্ছে। রাজু জানায় যে হলের গেট থেকে বের হয়ে রাস্তা পার হলেই খাবারের দোকান পাওয়া যাবে। ওখানে খিচুড়ী ভুনা-ডিম, কাচ্চি এসব পাওয়া যাবে।

এও জানিয়ে দেয় যে গেলে তাড়াতাড়ি যেতে হবে। কারণ ঘড়িতে এখন পৌণে তিনটার মত বাজে। খাবার না পাওয়ার সম্ভবনাই বেশি। এই হলে ৩ বছর ধরে আছে রাজু। তাই সবকিছুই ওর মুখস্থ।

মীরা একটু হতাশ হয়। দুপুরটা না খেয়ে থাকতে হবে তাহলে তাকে। হঠাত রাজু বলে উঠে, “আপা আপনে যাস্ট ৫ টা মিনিট অপেক্ষা করেন আমি আসতেছি”। এই বলে রাজু নিখোঁজ হয়। মীরা একবার ভাবে সে কি আজকের মত চলে যাবে? কারণ যার জন্য অপেক্ষা করছে সে জানেই না যে আজকে মীরা তার জন্য এখানে অপেক্ষা করবে।

সারপ্রাইজ দিতে এসে শেষে মীরা নিজেই মনমরা হয়ে যাবে। যাব কি যাবো না এই দ্বন্দ্ব নিয়ে মীরা যখন হিসেব কষছে তখন পিছন থেকে একজন বলে উঠে...”এক্সকিউজ মি, আপনি কি মিস জলপরী?” মীরা হতচকিয়ে উঠে। গলাটা তার পরিচিত। আনমনেই বলে উঠে “জ্বী”। ছেলে কন্ঠস্বরটা এবার এগিয়ে আসে।

মীরার সামনের চেয়ারে এসে বসে। মীরা একটু অস্বস্তি বোধ করে। -“আচ্ছা আপনি যে আজকে আসবেন সেটা বলবেন তো আমাকে? আপনি কতক্ষণ বসে আছেন এখানে?” -“এইতো হবে ১-২ ঘন্টা। আসলে আপনাকে আমি চমকে দিতে চেয়েছিলাম। তাই...” -“তাই বলে এইরকম একটা জায়গায় বসে থাকবেন? আমি যদি ওয়েটিং রুমে উঁকি না দিতাম তাহলে তো কি বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হয়ে যেত?” -“আরে নাহ আপনে ব্যস্ত হবেন না।

আমি এখানে দিব্যি আছি। ভালই লাগছিলো। “ -“দুপুরে খেয়েছেন?” মীরা “না” বলতে গিয়েও থেমে যায়। ও যে কাজের জন্য এসেছে সেটা আগে শেষ করবে। খাওয়া-দাওয়াটা এখন আর জরুরী না।

মীরা বলে, “আপনাকে পরশু রাতে যে মাছগুলোর কথা বলেছিলাম সেগুলো নিয়ে এসেছি। আপনি বললেন দেখতে চান তাই আপনার কাছে দিয়ে যেতে এসেছি” -“আরে আমাকে দিতে হবে কেন? এই যে আমি দেখলাম মাছগুলো। দারুণ দেখতে। কী সুন্দর নীল। আর মাছের চোখগুলোও কেমন মায়াকাড়া” একটা ছেলে এভাবে মাছটার বর্ণনা দিবে মীরা ভুলেও চিন্তা করেনি।

ছেলেদের কাছে মাছ মানে মাছ আর ডাইনোসোর মানে ডাইনোসোর। মীরা স্মিত হেসে বলে- “আপনি রেখে দেন মাছগুলো। আমার চেয়ে আপনি মাছগুলোর যতচ বেশি নিতে পারবেন। “ -“না না আমি হলে থাকি। গেদারিঙ্গে থাকি।

মাছগুলো রাখবো কই? -“মাছগুলোর চাইলেই আপনি যত্ন নিতে পারবেন। এদেরকে দিনে ২ বার খাবার দিবেন আর প্রতি ৪-৫ দিনে পানি পালটে দিবেন। আর মাঝে মাঝে কথা বলবেন রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে। এতে মাছগুলো অনেক ভালো থাকবে” -“ইয়ে মানে কথা বলতে হবে কেন? মাছের সাথে কথা বলছি এটা দেখলে হলে থাকাটা মুশকিল হয়ে যাবেতো। “ মীরা বুঝতে পারে ছেলেটা মাছগুলো রাখবে না।

গত পরশু রাতে ফোনে কথা বলার সময় ছেলেটাকে যখন সে মাছের কথা বলেছিলো তখন ছেলেটা যত আগ্রহ দেখিয়েছিলো কিন্তু এখন তো চিত্র ভিন্ন। মীরা ধরে আসা গলায় বলেঃ “আমি ভেবেছিলাম মাছগুলো আপনার কাছে থাকুক। আমি এগুলোর যত্ন নিতে পারছি না ভালোমত। মাছগুলো আপনার কাছে থাকবে আমাদের বন্ধুত্বের স্মৃতি হিসেবে। আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে যখন এক্টুও কোন বিবাদ বা ফাটল ধরবে তখন মাছগুলোতে সেটার প্রভাব দেখা যাবে।

আমি অনেক আগে এক রূপকথায় পড়েছিলাম এরকম। ভাবছিলাম এমন হয় কিনা পরীক্ষা করে দেখব। যাই হোক আপনার বিড়ম্বনা বাড়াতে চাই না”। এমন সময় রাজু এসে হাজির হয়। “আপা আপ্নের দুপুরের খাবারে ব্যবস্থা করছি।

এই নেন এইটা আপনার প্যাকেট। আর আরেকটা আমার লাইগ্যা”। হাঁপাতে হাঁপাতে কথাগুলো বলে রাজু। আপুটার সাথে “গাতক ভাই” কে দেখে রাজু একটু অবাক হয়। এই “গাতক ভাই” হলের বিখ্যাত মানুষ।

কি একটা কাঠের জিনিস কোলে নিয়ে তারের মধ্যে টুংটাং করে আর গান গায়। ওনার গান শুনে পুরো হল ওনারে ভালোবাসে। এই “গাতক ভাই” রাজুকেও একটা সুন্দর গান শুনিয়েছিলো একদিন। রাজু সেই থেকে এই ভাইয়াকে চিনে। গাতক ভাই রাজুকে বলে, -“কিরে জুজু আমার প্যাকেট আনলি না? শুধু আপু আর তুই খাবি?” রাজু লজ্জা পায়।

বলে “ভাইজান লন এইটা আপনে খান। আমি যখন হলের পোরোগ্রাম থেকে খাবার আনতে গেছিলাম সেই সময়ে আপায় একা আছিল তো তাই” -“যাহ বোকা। আমি আরেকটা ম্যানেজ করে নিচ্ছি। আমরা ৩ জন মিলে খাব। কেমন?” রাজু ডানদিকে মাথা কাত করে।

মীরার ক্ষুধা চলে গেছে। ভাবছে কি বলে বিদায় নেয়া যায়। আজকে সকাল থেকে যত প্ল্যান করে এসেছিলো আপাতত সবগুলো বরবাদ হয়ে গেছে। এতে অবশ্য মন খারাপ লাগছে না মীরার। ৬ মাসে হয়ত একটা মানুষকে অনেক বেশি চেনা যায়না।

মীরার যে ভুল ধারণা ছিলো সেটা ভেঙ্গে গেছে। ফোনে কথা বলে যেরকম ভেবেছিলো সেরকম অনেক কিছুই নেই। মীরার সাথে ছেলেটার পরিচয় হঠাত করেই। মীরার খুব কাছের বান্ধবী টুম্পার বাসায় গিয়ে একদিন কথা হয়। ছেলেটা টুম্পাদের বাসার চারতলায় মাঝে মাঝে যেত।

ছেলেটার চাচার বাসা সেখানে। একদিন মীরা-টুম্পা বাইরে যাওয়ার সময় নিচের কলাপসিবল গেটে তালা দেখে দাড়িঁয়ে অপেক্ষা করছিলো। একটা ছেলে হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামে। গেটটা খুলে বের হয়ে যায়। কিছুদূর যেয়ে আবার ফিরে এসে টুম্পাকে জিজ্ঞেস করেছিলো ,”আপু আপনার ব্লাড-গ্রুপ কি ও নেগেটিভ? আমার জরুরী ব্লাড দরকার।

আমার মামীর সিজারিয়ান করে বাচ্চা হবে”। টুম্পার ব্লাডগ্রুপ এবি পজেটিভ। হঠাত মীরা জিজ্ঞেস করে আপনার মামী কোন হাস্পাতালে? আমি রক্ত দিতে পারব। আমি ও নেগেটিভ। সেই রক্ত দেয়া থেকেই মীরার সাথে ছেলেটার পরিচয়।

ছেলেটা গান গায় সেটা একদিনও বলেনি মীরাকে। এর মধ্যে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হত তাদের। স্বভাবসুলভ কেমন আছেন? আপনার মামী কেমন আছেন এই জাতীয়। মাঝে মাঝে কিছু জরুরী বিষয়েও কথা হত। মীরার এসব কিছু ভাবতে ভাবতে মাথা ধরে আসে।

হয়ত সে ছেলেটাকে একটু বেশিই বন্ধু ভেবে ফেলেছিল। দুইজনের নীরবতা ভাঙ্গে রাজুর কথায়। “আপা আপ্নে খাইতেন্না? আমার খিদা লাগছে তো”। মীরা বলে “নারে বাবা আমার ক্ষুধা নেইরে আর। তুই খা আর আমারটা ভাইয়াকে দিয়ে দে” রাজুর কাছে মনে হয় এই ভাইয়া আপু মনে হয় ঝগড়া করছে।

অনেকেই এইখানে এসে ঝগড়া করে। রাজু দূর থেকে দেখে অনেক আপুরা কাদঁতেছে। অনেকে আবার চিল্লায়। রাজু বুঝতে পারছে না কি করবে। হাতে দুইটা খাবারে প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে সে।

মীরা আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। টেবিল ধরে উঠে। সাথে করে আনা জিনিসগুলো গুছিয়ে নেয়। নিজের নীল রঙের পার্স, কাঁচের বোউল, ছাতা আর ঘরের কোণে রাখা সাদা ছড়িটা। যেখানে যেভাবে যা রেখেছিলো ঠিক ঠিক সেখান থেকে সেগুলো তুলে গুছিয়ে নেয়।

ছোটকাল থেকে অভ্যেস হয়ে গেছে ওর। ওর জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতাটাকে নিজের শক্তিতে পরিণত করতে শিখেছে মীরা। এতক্ষণ ধরে মীরাকে দেখছিলো দীপ্ত ওর সামনে বসে। শেষ ৫ মিনিটের ঘটনার জন্য দীপ্ত প্রস্তুত ছিলো না। যে জিনিসটা ঘূণাক্ষরেও সে টের পায়নি সেটা দেখলে যে কেউ হতচকিত হবে।

টেবিলের উপরের খবরের কাগজগুলোর দিকে মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকে দীপ্ত। নিজের উপর খুব ঘেন্না লাগে ওর। মেয়েটাকে সে অযথা কষ্ট দিয়েছে। মীরা বলে উঠে ,“আমি আজকে যাই কেমন? আমাকে একটা রিক্সা করে দিবেন? আমি আমার হলে চলে যাব। কথাগুলো বলে মীরা নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।

রাজু এখনো দুটো প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই প্যাকেট দুটো আনতে ওকে অনেক কষ্ট করতে হইছে। হলের মেসে প্রোগ্রামে আজকে বিরানীর প্যাকেট দিয়েছে একটা কি যেন উপলক্ষ্যে। সেখানে গিয়ে ও অনেকগুলো পানির বোতল ভ্যান থেকে নামিয়ে মেসে দিয়ে এসেছে। অনেক পরিশ্রম করে শেষে একটা প্যাকেট মিলে ওর।

ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরেক ভাইয়া এসে আরেকটা প্যাকেট দিয়ে দেয়। রাজু এখন এই প্যাকেট নিয়ে কি করবে বুঝতেছে না। দীপ্ত এগিয়ে যায়, মীরার হাত থেকে মাছ সহ বোউলটা নেয়। এরপর মীরাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার হাত ধরি? এতদিন মাছগুলো আপনার হাতে বড় হয়েছে। এখন এগুলো আমার হাতে বড় হবে।

কোন কিছু হাত বদলের সময় হ্যান্ড-শেক করতে হয়। আমি হ্যান্ড-শেক করব না। শুধু আপনার হাত ধরে আপনাকে পৌঁছে দেব রিক্সা পর্যন্ত। যাতে অন্তত যতদিন নিজের মধ্যে আজকে আপনাকে “না” বলে দেয়ার জন্য যে অপরাধবোধ কাজ করবে সেটার প্রায়সচিত্ত করতে পারি”। ::::::::::::শেষ পর্যন্ত মীরা কি তার হাত ধরতে দিয়েছিল? এরপর মাছগুলোর কি হয়েছিলো? রাজুর হাতের বিরানির প্যাকেটটার ভাগ্যে কি জুটেছিলো? এই ওয়েটিং রুমে কি মীরা আর কখনো এসেছিলো, বসেছিলো? দীপ্ত কি মীরাকে নিয়ে কোন গান লিখে সুর করেছিলো? দীপ্তের সাথে মীরার এর পর কি হয়েছিলো?:::::::::::::: এরপর কি হয়েছিলো সেটা জানি না।

শুধু এটা জানি অনেক ছোটকালে মীরার “কেরাটোকনজাক্টিভাইটিস সিক্কা” (keratoconjunctivitis sicca) হয়েছিলো। এর কোন চিকিতসা না হওয়াতে মীরা অন্ধ হয়ে যায় ৪ বছর বয়স থেকে, এমনকি মীরা কাঁদলেও ওর চোখ দিয়ে পানি আসতো না। ওর চোখের অশ্রুগ্রন্থি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সেই সময়ে। “If you've never eaten while crying you don t know what life tastes like.” ― Johann Wolfgang von Goethe  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।