কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! ১
আমি ছোটবেলায় ইনজেকশনকে খুব ভয় পেতাম। ইনজেকশন দেখলেই এখানে সেখানে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতাম। আমার বাবা ডাক্তার, সেই হিসেবে বাসায় সবসময়ই সিরিঞ্জ থাকত। সেই সিরিঞ্জগুলো কোনভাবে চোখে পড়লেই আমার কেন যেন মনে হত যে এটা আমার জন্যই আনা হয়েছে এবং যে কোন সময় এটার লম্বা সুঁই আমার হাতে ঢুকিয়ে দেয়া হবে। সেজন্য পারতপক্ষে আমি কখনও কোন সিরিঞ্জের দিকে তাকাতাম না, কিন্তু মাঝে মাঝে যখন বাবার চেম্বারে কাউকে ইনজেকশন দেয়া হত তখন ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকতাম আর ভাবতাম, ইস, কি ভয়ঙ্কর কষ্টই না পাচ্ছে লোকটা!
কোন কারণে আমার রক্ত পরীক্ষা করার দরকার হলে বা আমাকে টিকা দিতে হলে আমি সেদিন সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে থাকতাম।
ভয়ে আমার খাওয়া দাওয়া হত না, ক্লাসে মন বসত না। খেলতে যেতাম শুধুমাত্র টেনশনটা ভুলে থাকার জন্য। আর বারবার মনে হত, ইনজেকশন না নিয়ে মুখে খেলে হয় না? বা অন্য কোন পদ্ধতিতে রক্ত নেয়া যায় না? বা শরীরের এমন কি কোন জায়গা আছে যেখান থেকে রক্ত নিলে কোন ব্যথা লাগবে না?
শুধু তাই নয়, একেক সময় মনে হত, ধ্যাত, রক্ত পরীক্ষা করার এত কিইবা দরকার ছিল? বা এইসব টিকা কি না দিলেই নয়? এটাও মনে হত, ইস, আজকে যদি আমি বাসার পথ হারিয়ে অন্য কোথাও চলে যেতাম!! বা আমাকে যে টিকাটা দেয়া হবে তা আর বাজারে পাওয়া না যেত!!
কিন্তু এসব চিন্তা করে স্বাভাবিকভাবেই কোন লাভ হত না। শেষ পর্যন্ত আমাকে বাসাতেই ফিরতে হত, একসময় চোখের সামনে সিরিঞ্জের ভয়াবহ সুঁই দেখে ঢোঁক গিলে চোখ বন্ধ করে ফেলতেই হত, এবং সুঁই ঢোকানোর সময় ব্যথা হোক বা না হোক আর্তনাদ করে উঠতেই হত।
মেডিকেল কলেজে ভর্তি হবার পর হলে আসার সময় আমি আরও একগাদা জিনিসপত্রের সাথে এই ভয়টাকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলাম।
২
আমাদের মেডিকেল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অনেকে সন্ধানীর সাথে জড়িত। সন্ধানী একটা স্বেচ্ছাসেবী রক্তদাননির্ভর সেবামূলক প্রতিষ্ঠান।
ফার্স্ট ইয়ারে ক্লাস শুরু করার কদিন পরেই একদিন সন্ধানী থেকে আমাদের সদস্য ফর্ম দেয়া হল। বলা হল সবকটা পূরণ করে দিতে।
ফর্মটা হাতে নিয়ে আমি ভাবলাম, এখন যদি আমি এই ফর্মে সাইন করি, তাহলে হয়তো যখন তখন রক্ত দিতে হবে।
রক্ত দেয়া নিঃসন্দেহে মহৎ কাজ, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু আপত্তি শুধু এক জায়গায়। সিরিঞ্জের সুঁইটা যে শরীরে ঢুকাতে হবে!! কি ব্যথাই না লাগবে! ওরে বাপরে!! ফলাফল, সন্ধানীর ফর্মে আমার আর সাইন করা হল না। ফর্মটার জায়গা হল সম্ভবত ডাস্টবিনে।
কিন্তু সন্ধানীর সদস্য না হলেই যে রক্ত দেয়া যাবে না তা তো আর নয়। ফার্স্ট ইয়ারে প্রায়ই যা হত, তা হচ্ছে, হয়তো ক্লাসে বসে আছি, হঠাৎ কোন ক্লাসমেট এসে বলল, তোর রক্তের গ্রুপ কি? বা, তোর রক্তের গ্রুপ কি ও পজিটিভ? যদি একবার হ্যাঁ বলে ফেলি তো শেষ, সাথে সাথে অনুরোধ আসবে দোস্ত প্লিজ ব্লাড লাগবে...আমার এক আত্মীয়...তুই কি দিতে পারবি?...
অজুহাত তখন হঠাৎ হঠাৎ মাথায় চলে আসত।
যেমন হয়তো বললাম, আমি কয়েকদিন আগেই রক্ত দিয়েছি, এখন দিতে পারব না। বা আমার জন্ডিস আর টাইফয়েডের হিস্ট্রি আছে, আমার রক্ত নিয়ো না ভাই। আসলে সত্যিই আমার একসময় এই দুটো রোগ হয়েছিল বিধায় এই কথাটা বলার সময় মিথ্যা বলার মানসিক অনুতাপটা আমাকে স্পর্শ করত না।
এভাবেই জন্ডিস আর টাইফয়েডের হিস্ট্রি দিয়ে ফার্স্ট আর সেকেন্ড ইয়ার কাটিয়ে দিলাম। অনেক অসহায় মুখের ফ্রেন্ড বা সিনিয়রকে ফিরাতে হয়েছে বলে একটু খারাপ যে আমার লাগে নি তা নয়, কিন্তু ঐ যে, সিরিঞ্জের সুঁইটা যে হাতে ফুটাতে হবে! ওরে বাপরে!!
৩
এখন আমি থার্ড ইয়ারে।
একদিন বাইরে থেকে এসে রুমে ঢুকেছি, ঢুকেই দেখি এক বড় ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। এই, তোমাদের কারো কি ও পজিটিভ ব্লাড আছে?
হঠাৎ পুরনো ভয়ে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠল। আমার নিজেরই তো ও পজিটিভ! ব্লাড টাড দিতে হবে নাকি আবার?
কি, আছে?
আমি নিজেকে বলতে শুনলাম, ভাই আছে। আমার নিজেরই ব্লাড ও পজিটিভ।
উনি বললেন, ব্লাড দিতে পারবা?
ঠিক ঐ মুহূর্তে আমার মনের দরজায় অতীতে ব্যবহার করা বা করার চেষ্টা করা সমস্ত অজুহাত একের পর এক উঁকি মারতে থাকল।
ভাইয়া আমি তিন দিন আগে রক্ত দিয়েছি।
ভাইয়া আমার দু মাস আগে জন্ডিস হয়েছিল।
ভাইয়া আমি আন্ডারওয়েট।
ভাইয়া আমার জ্বর।
ভাইয়া আম্মু ব্লাড দিতে নিষেধ করেছে।
ভাইয়া আমার ভয় লাগে।
কিন্তু আমি বললাম, ভাই পারব। কখন দিতে হবে?
উনি বললেন, কালকে দুপুরে।
কোথায়?
পি জি তে।
আমার বাকি দিনটা গেল অন্যভাবে।
কেমন একটা ভয়, কেমন একটা উত্তেজনা। হঠাৎ করে মনে হল, ইস, যদি কালকে আমি হলের বাইরে থাকতে পারতাম! বা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারতাম! তাহলে তো আর ব্লাড দেয়া লাগত না!
এইসব ছাইপাশ ভেবেই পরেরদিন দুপুর চলে এল।
৪
পরেরদিন দুপুরে কেউ আমায় কল করল না। কেউ এসে বলল না, এই, তোমার না ব্লাড দেয়ার কথা? যাও পিজিতে যাও।
আমি ভাবলাম, তাহলে কি বেঁচেই গেলাম? দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল, বিকেল গড়িয়ে রাত।
কেউ আমাকে ডাকল না। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
পরেরদিন সকালে একটা ক্লাস করে ক্যান্টিনে গিয়েছি, হঠাৎ আরেক বড় ভাই ডাকলেন। এই ভাই, তোমার না ব্লাড দেবার কথা ছিল?
হায় হায়, এটা কি হল? আমি তো ভেবেছিলাম আর ব্লাড দেয়া লাগবে না...
জি ভাই।
তাহলে তুমি দুপুরে রেডি হয়ে থেক।
আমি কল দিব নে।
আচ্ছা।
ব্যস, আবার শুরু হল টেনশনের পালা। আবার সেই ভয়াবহ সুঁইয়ের কল্পনা। আবার সেই ভয়জনিত ঢোঁক গেলা।
কিন্তু শেষমেশ যেতেই হল। পৌনে তিনটার দিকে সন্ধানীর গাড়িতে করে আমি আর কয়েকজন বড় ভাই পি জি র উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
৫
ব্লাড দেবার আগে স্ক্রিনিং টেস্ট করতে হয়। কয়েকটা রোগের জীবাণু আছে কি না দেখতে হয়। গ্রহীতার ব্লাডের সাথে মিলিয়ে ক্রস ম্যাচিং করতে হয়।
আমি ওখানে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, রক্ত শুধু আমিই দিব না, আমার সাথে আরও যে চার জন বড় ভাই আছেন, তারা সবাই ব্লাড দিবেন। আরেকটু অবাক হলাম তখনই, যখন দেখলাম, সবাই মিলে একই ব্যক্তিকে ব্লাড দিতে হবে।
একজনের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের পেশেন্টের কি রোগ ভাই?
উনি বললেন, জানি না ভাই। বলেছে, চলে এসেছি।
স্ক্রিনিং টেস্ট করার জন্য প্রথমে একটু ব্লাড দিতে হয়।
এটা যে সিরিঞ্জ দিয়ে করা হয় তার সুঁইটা চিকন, তাই অতটা ভয়াবহ নয়। কোনভাবে দাঁতে দাঁতে চেপে ঐ পরীক্ষাটা পার হয়ে এলাম।
এরপর শুরু হল প্রতীক্ষার পালা। পিজির মত জায়গায় ব্যবস্থাপনার এই হাল জানতাম না। স্ক্রিনিং করতেই এক ঘণ্টা মত লাগিয়ে দিল।
অনেক অনেকক্ষণ পরে আমাদের ডাক পড়ল। আমরা সবাই একটা রুমের মধ্যে ঢুকলাম।
৬
এবার আমার পালা।
ভয়ে বুক দুরু দুরু কাঁপছিল। বিশেষ করে ব্লাড নেবার জন্য যে মোটা নিডল ব্যবহার করা হয় তা দেখেই আমার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হবার জোগাড়।
এত বড়! এত মোটা! এটা আমার হাতে ঢুকানো হবে?
আমাকে শুয়ে পড়তে বলা হল। চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। আমাকে দিয়ে একটা বন্ড সাইন করে নেয়া হল, আমি অমুক এই মর্মে প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে আমি স্বেচ্ছায়...
আমার হাতে একটা বিপি মেশিনের কাফ বাঁধা হল। তারপর প্রেশার তোলা হল অনেকদূর।
আমি ভয়ে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে থাকলাম।
হঠাৎ একটা সূক্ষ্ম ব্যথা...না, এটা কোন excruciating pain নয়, চিৎকার করে ওঠার মত কোন ব্যথা নয়, দৌড়ে পালিয়ে যাবার প্রবৃত্তি উদ্রেককারী ব্যথাও নয়...এটা আসলে...আসলে কিছুই নয়! তেমন কোন ব্যথাই লাগলো না আমার!
আমাকে হাতে একটা বেলুন দিয়ে বলা হল আস্তে আস্তে প্রেস করতে। আমি করলাম। ভয়ে ভয়ে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি সত্যিই ঐ মোটা সুঁইটা আমার হাতে ঢুকানো হয়েছে, এবং তার মাধ্যমে জীবনসঞ্জীবনী সুধা বয়ে যাচ্ছে আমার শরীর থেকে। জমা হচ্ছে একটা প্রাণহীন প্লাস্টিকের ব্যাগে।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, আমি তাহলে এতদিন ভয় পেতাম কাকে? সুঁইটাকে? কিন্তু ওটা তো মোটেও ব্যথাদায়ক নয়...যেটুকু ব্যথা ওটুকুকে ধর্তব্যের মধ্যে না আনলেও চলে।
বয়ে যেতে লাগল রক্ত। আর আমার মনে একটা প্রশ্নই ঘুরেফিরে বারবার আসতে লাগল, আমি তাহলে এতদিন ভয় পেতাম কাকে?
৭
ব্লাড দেয়া শেষে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলাম পুরো এক বোতল। সাথে এক প্যাকেট বিস্কুট।
যখন সবার ব্লাড দেয়া শেষ, তখন আমরা সবাই মিলে গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম। পেশেন্টের এক লোক আমাদের কুশলাদি জিজ্ঞেস করে বারবার ধন্যবাদ জানাতে থাকলেন।
গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে বাকি সবার সাথে কথা বলা শেষে উনি সবার থেকে বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে আমার সাথে কথা বললেন।
তুমিও কি মেডিকেলে পড়, বাবা?
জি আঙ্কেল।
তুমি কি আগে কাউকে রক্ত দিয়েছ? নাকি এটাই প্রথমবার?
এটাই প্রথম।
তোমার বাড়ি কোথায়?
অমুক জেলায়।
কলেজ?
অমুক কলেজ।
স্কুল?
অমুক স্কুল।
বড় হয়ে কিসের ডাক্তার হবে?
সার্জন হব।
ডাক্তার হবার পর কশাই হয়ে যাবে না তো আবার? একেকটা অপারেশনে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেবার ধান্দা করবে না তো তুমি?
নাহ, কি যে বলেন আঙ্কেল!
এবার আমিই শুরু করলাম।
আঙ্কেল, পেশেন্ট আপনার...
মেয়ে।
মেয়ে? কি হয়েছে ওনার?
ঐ তো, এমনি একটু জ্বর।
দুদিন পরেই সেরে যাবে।
তাহলে যে এতজনের রক্ত নিতে হল?
ঐ তো, এমনিতেও সেরে যেত। কিন্তু ডাক্তার আমার পরিচিত তো, উনি বললেন ব্লাড দিলে তাড়াতাড়ি ভালো হবে।
এখন উনি কোথায় আছেন?
উনি? না না, আমার মেয়ে তো ছোট। তোমার ছোট বোনের বয়সী।
তোমার কোন ছোট বোন নেই?
না আঙ্কেল। আমরা দুই ভাই। ছোট ভাই আছে।
ও আচ্ছা। ও তো এখানেই আছে, কেবিনে ভর্তি...আচ্ছা ঠিক আছে, বাবা তোমরা এখন যাও, তোমরা অনেক মহৎ কাজ করছ...নিঃস্বার্থভাবে অন্যের জন্য এতটুকু কেইবা করে?...
বলতে বলতেই উনি আমার হাতে জোর করে একশ টাকা গুঁজে দেবার চেষ্টা করলেন।
আমি অনেক গাইগুই করলাম, আঙ্কেল, এসব কি করছেন...এটা আমরা নিব না... কিন্তু গাইগুই করে ওনার ভালবাসার অত্যাচার থেকে রেহাই পেলাম না আমি। টাকাটা নিতেই হল।
আমরা সন্ধানীর গাড়িতে উঠলাম। গাড়ির জানালার ভিতর দিয়ে দেখলাম, অজস্র মানুষের মধ্যেও আলাদা করা যাচ্ছে আমাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা একজন মানুষকে।
একজন বাবাকে।
পিছনে সন্ধ্যার আকাশ, নানা রঙে রাঙ্গানো।
৮
হলে ফেরার পথে আমি এক বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ওনার মেয়ের কোন জ্বর হয়েছে?
জ্বর মানে?
কেন? উনি যে বলল ওনার মেয়ের নাকি জ্বর?
জ্বর...?
ডাক্তার নাকি বলেছে এমনিতেও সারত, আমরা ব্লাড দিচ্ছি বলে তাড়াতাড়ি সারবে।
তাই?
হ্যাঁ...তাই তো বলল...
বড় ভাই এদিক ওদিক তাকালেন। কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না।
আমি আবার শুরু করলাম, ভাই, মেয়েটা কত বড় জানেন?
কার মেয়ে?
আরে...ঐ লোকের মেয়ে।
আমরা যাকে ব্লাড দিলাম।
মেয়ে...?
হায় হায়, এ দেখি কিছুই জানে না। আমি আরেকটা বড় ভাইকে ধরলাম। ভাই, পেশেন্ট মেয়েটার বয়স কত জানেন?
উনিও দেখি ভড়কে গেছেন। মেয়ে?
হ্যাঁ...লোকটা তো বলল তার মেয়ে-ই পেশেন্ট।
তাই?...
ধুর, কেউ দেখি কিছুই জানে না। এমনি এমনি এসে ব্লাড দিয়েছে। কাকে দিয়েছে কোন খোঁজ নাই। ধুর।
হলের সামনে চলে এলাম।
গাড়ি থেকে নামলাম। আরেক বড় ভাইকে এবার সরাসরি প্রশ্ন করলাম, ভাই, আমরা যে সবাই মিলে ব্লাড দিলাম, আপনি কি জানেন আমরা কাকে ব্লাড দিলাম? পেশেন্ট কে? বয়স কত? ওনার কি হয়েছে?
ভেবেছিলাম উনিও অন্য সবার মত বলবেন, জানি না।
কিন্তু না, আমাকে অবাক করে উনি বললেন,
পেশেন্ট একজন মহিলা। বয়স আনুমানিক পঞ্চান্ন। ওনার যে রোগটা হয়েছে তার নাম ক্রনিক মায়েলয়েড লিউকেমিয়া।
এই রোগে একুশ দিন পর পর রোগীকে প্লেটলেট দিতে হয়। রোগের প্রথম স্টেজে যদি বোন ম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হত তাহলে রোগী বেঁচে যেত। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই। এই রোগী মারা যাবে। অচিরেই মারা যাবে।
আর ঐ লোকটা...? উনি রোগীর একমাত্র ছেলে।
৯
জীবনে প্রথমবারের মত রক্তদান করে একটা মানুষ যখন জানতে পারে যে সেই রক্তদান রোগীকে সুস্থ করে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনবে না, বরং তাকে মৃত্যুর সাথে মৃত্যুপথযাত্রীর নিরন্তর যুদ্ধটাই শুধু প্রলম্বিত করবে, তখন সেই মানুষটার কেমন লাগা উচিৎ?
আমার প্রথম রক্তদান কি বৃথা গেল? পেশেন্ট তো মারাই যাবে। তার আর রক্ত নিয়ে লাভ কি?
বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে মনে হয়, আমার রক্তদান আসলেই বৃথা গেল। কারণ, এই রক্তটা আমি এই রোগীকে না দিয়ে অন্য এমন কাউকে দিতে পারতাম যে হয়তো আমার রক্তে সুস্থ হয়ে উঠবে। আমার রক্তের সাহায্যে যে হয়তো রোগশয্যা থেকে উঠে আবার সুস্থ জীবন যাপন করা শুরু করবে।
কিন্তু যুক্তি আর বস্তুবাদ কি জীবনের প্রতিটি কাজ, প্রতিটি আবেগ ব্যাখ্যা করতে পারে?
না, আমি জানি, জীবন যুক্তি আর বস্তুবাদে চলে না। জীবন চলে বিশ্বাসে। আমি বিশ্বাস করি আমার রক্তদান বৃথা যায় নি। যেতে পারে না। যে অসহায় মানুষটি বিছানায় শুয়ে শুয়ে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর প্রহর গুনছে, নিয়মিত যাকে অন্যের সুস্থ শরীরের কাছ থেকে রক্ত নিতে হচ্ছে, যে যদি আমার রক্তের পুন্যে আর এক মুহূর্তও বেশি বাঁচে, আর একটা নিঃশ্বাসও বেশি ফেলে, আর একটা স্বপ্নও বেশি দেখে, চোখের জল আর একটা ফোটাও বেশি ফেলে, সন্তানের মাথায় আর একটিবার হলেও হাত রাখতে পারে...তাহলেই তো আমার রক্তদান সার্থক।
একজন মানুষ হিসেবে আর কিইবা পাওয়ার বাকি থাকে আমার?
জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত যে কতটা মূল্যবান তা এক মৃত্যুপথযাত্রী ছাড়া আর কে বুঝবে?
রাগ-হিংসা-দ্বেষ-ঘৃণার শেকলে সুখের জীবনকে যারা বিষাক্ত করে রাখে, তারা জীবনের মর্ম কিইবা বুঝবে?
সবাইকে ধন্যবাদ। আর হ্যাঁ, জীবনের প্রথম সুযোগেই রক্তদান করতে ভুলবেন না। অন্যের নিভন্ত জীবনপ্রদীপে নিজের জ্বালানি ঢেলে একটি অপার্থিব হাসি উপহার পাবার এমন বিরল সুযোগ কখনই ছাড়বেন না।
আবারও সবাইকে ধন্যবাদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।