শুদ্ধতার আগুনে যেন সতত পুড়ি একজন পায়েল ও তার কয়েকটি মুহূর্ত
রাস্তাটার বাঁক ঘুরতেই প্রথম চোখে পড়েছিল একটি বাড়ির দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। আর তখনই কেমন যেন একটি অস্বস্তি হতে থাকে পায়েলের। অথচ সে এ কদিন অনেক ভেবেও তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারেনি লোকটির এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার হেতু। সে তাকে ফলো করছে বা কারো নির্দেশে এখানে দাঁড়িয়ে থাকছে সেই জিজ্ঞাসার কোনো সুরাহা করতে পারেনি। অবশ্য বছর কয়েক আগে লোকটি এ এলাকায় থাকতো।
পায়েল যখন এইট নাইনের ছাত্রী সে সময় লোকটিকে মামা বলেও সম্বোধন করেছে। তখনকার দিনে লোকটির আচরণে একটি পরিচিতি বা স্বাভাবিকতার সুবাস বজায় থাকতো। কিন্তু অনেকগুলো বছর পর হঠাৎ করেই রাস্তার অদৃশ্য বাঁকে লোকটিকে আবিষ্কার করে চমকে উঠেছিল সে। কেন যেন দীর্ঘদিন পর প্রথম দেখলেও লোকটির চাহনি ভাল লাগেনি। কেমন কুতকুতে চোখে তাকিয়ে ছিল।
সেদিনের পর থেকেই দূর থেকে লোকটিকে দেখতে মাথা তুলতে পারে না সে। মনের ভেতর একটি শিরশিরে ভাব চিড়বিড় করতে থাকে যদি লোকটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়? অবশ্য চোখাচোখি হলে কী বা অমন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে তাও ভাবনায় আসে না। কেবল অস্বস্তি পায়ে পায়ে জড়িয়ে থাকে। মন্থর হয়ে যায় চলার গতি। অথচ বাসায় ঢুকতে হলে লোকটির সামনে দিয়েই যেতে হবে।
একবার তার ইচ্ছে হয়েছিল সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে, কেন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে সে? তখনই ভিন্ন ভাবনা তার জিজ্ঞাসা নিয়ে শব্দের কাটাকুটি খেলে। কেন, আমি কি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না? বা এ সময়টাতেই আমার একজনের সঙ্গে দেখা করতে হয়। সে আসে। কথাবার্তা বলে চলে যায়। কিংবা পালটা জিজ্ঞাসায় যদি আহত করে লোকটি? যদি বলে বসে আপনাকে কেন ফলো করব, নিজেকে দামী কারো মতো ভাবেন নাকি? আবার তেমন কিছুই ঘটবে না।
আবার ভয়াবহ কোনো একটি ব্যাপার ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। যেদিন মা গ্রামের বাড়ি যাবেন সেদিন ভাইয়া আর ভাবি ঘরে ফেরার আগ মুহূর্তে বেশ কিছুক্ষণ একা একা থাকে সে। সে সময়টায় যদি লোকটি নিঃশব্দে তার পিছু পিছু দরজা পর্যন্ত চলে আসে আর তোলা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ঝাপিয়ে পড়ে তাকে টেনে নেয় ঘরের ভেতর, চেপে ধরে হাত-পা সমেত মুখ, অথবা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার সময়টাতে পেছন চুপচাপ ঘরের ভেতর গিয়ে মাথায় সজোরে কিছু দিয়ে আঘাত করে বেরিয়ে যায় লোকটি? তাহলে কেমন একটি বিশ্রী ব্যাপার হয়ে যাবে। আবার তেমনটি না হয়ে মৃত্যুর চেয়েও আরো ভয়াবহ কিছু ঘটে যেতে পারে, যা তাকে প্রতিটি দিন মনে করিয়ে দেবে এর চেয়ে মৃত্যুই ভাল ছিল।
প্রতিদিন বাসায় ফিরে হাত মুখ ধোওয়া বা কখনো শাওয়ার শেষে এক কাপ কফি হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দৃষ্টিকে ছড়িয়ে দেয় সামনের গ্রামটির দিকে।
যেখানে খুব ঘন হয়ে আছে সবুজাভ প্রকৃতি। মাঝে মধ্যে কোনো কোনো মানুষ বা প্রাণীকে অতটা দূর থেকে অনেকটা কালচে দেখায়। আর সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় সে হারিয়ে যায় অপার সবুজে। একটি ঘাস-ফড়িং অথবা কোনো কাচ পোকার মতো হেটে বেড়ায় সবুজের ছায়ায় ছায়ায়। তখন তার খুবই খারাপ লাগে অর্থহীন এই মানব জন্মের জন্যে।
মানুষ হয়ে তো জন্ম নিতে চায়নি সে। হয়তো বা অন্যান্যদের কাছে মানুষ জন্মটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে কারণে তাদের অনেকেই নানা কষ্টকর সময় অতিক্রম করতে চেষ্টা করে। বৈরী নিয়তি অথবা প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকে দিনরাত। কোনো অবলম্বন বা উপায় না থাকলেও তার মনের ভেতর ক্রিয়াশীল থাকে বেঁচে থাকার অদম্য একটি সাধ।
কী প্রয়োজন এতটা কষ্ট করে বাঁচার? প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি আর বিলানোর মাঝ দিয়েই যদি নির্ধারিত হবে জীবনের মানদণ্ড তাহলে সে জীবনের আর বাকি থাকে কি? এমন জীবনের কাঙালিনী অন্তত সে নিজে ছিল না। এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত এমন কোনো ভাবনা ছিল না যে, তাকে বেঁচে থাকতেই হবে বা আরো শত সংকটেও তাকে টিকে থাকতে হবে বেঁচে থাকার সংগ্রামে। তবু যতটুকু না হলেই নয় আর সামর্থ্যে যতটা আগলানো সম্ভব তার বেশি চাহিদা নেই জীবনে। এ কারণেই কেরিয়ার নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা নেই তার। অথচ মাথাটা তার নিজের হলেও সম্প্রতি ব্যথা অনুভব করছে মাহির।
ব্যাপারটি আরো আগে হলে বা স্কুল কলেজ জীবনে হলে মনে হতো বাড়াবাড়ি কিছু কিংবা সরাসরি প্রকাশ না করলেও চেপে রাখতে পারতো না বিরক্তটুকু। কিন্তু মাহিরের কোনো কোনো ব্যাপার খুব বেশি বাড়াবাড়ি মনে হলেও বিরক্তিতে কুচকে ওঠে না কপালের মধ্যভাগ। আর এটাই তার জন্যে বড় রকমের বিস্ময়। কেমন করে সে বদলে গেল এতটা, কবে আর কখন এমন অদ্ভুত রকমের পরিবর্তনের সঙ্গে বসবাস করতে আরম্ভ করেছে তার কোনো আগাম আভাস পায়নি। আজকাল নিজেকে নিয়ে বড্ড দুর্ভাবনা চেপে বসে মনের ভেতর।
বয়সটাকে পাত্তা দিতে না চাইলেও প্রতিদিন শরীর তাকে জানিয়ে দিতে কার্পন্য করে না যে, তার সেই শক্তি কমে এসেছে অনেক। দিন শেষে দেহক্লান্তিতে ইচ্ছে হয় দিনভর নানা দিকে ছুটোছুটি, অফিসে ইচ্ছার বিরুদ্ধে নটা পাঁচটা কোনো কোনো দিন ছটা সাতটা পর্যন্ত নানা কাজের ব্যস্ততায় মন বিদ্রোহ করে উঠতে চায়। চাকরিতে রিজাইন দিয়ে বাসায় চলে যাবার দুরন্ত ইচ্ছেটার সঙ্গে যুঝতে যুঝতে যেন আরো শ্রান্ত হয়ে পড়ে।
একটি গাড়ি পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কেমন কৌতূহলী চোখে ঘাড় মাথা কাত করে তাকায় পেছনে বসা আরোহী। মাঝ বয়সের পুরুষদের বেশিরভাগই হ্যাংলা টাইপের আর দৃষ্টির জিহবা দিয়ে চাটে নারীর কাঠামো।
আচ্ছা এ বয়সে কি সব পুরুষই এমন হয়ে ওঠে? নাকি যারা ব্যাপারটা গোপন রাখার মতো ভব্যতা শেখেনি তারাই কেবল এমন? নিজের কাছে যেন জিজ্ঞাসার মাত্রা বেড়ে যায় তার। মেয়েরা কেমন হয় এ বয়সে? কিন্তু তার নিজের কথা ভাবলে তো এমন মনে হয় না। যদিও একটি শূন্যতা বা অপ্রাপ্তির আক্ষেপ আছে, তবু তা যে করেই হোক পাবার মতো দুর্মর বাসনা কখনোই জেগে ওঠেনি। আবার বাসনা-কামনা শূণ্যতাতেও ততটা আচ্ছন্ন হয়নি। পেলে ভাল না পেলে খুব বেশি হায় আক্ষেপ করার মতো মানুষ সে নয়।
যদিও মেজ খালার বয়স তার চেয়ে বছর পাঁচেক বেশি মাত্র, তবু দেখা যায় একটা খাই খাই ভাব রয়ে গেছে। বিধবা মানুষ তবু তাকে চুরি করে হলেও প্রত্যাশা পূরণ করার একটা উপায় বের করে নিতে দেখা যায়। যদিও ব্যাপারটি তার নায্য অধিকার তবু সমাজ বা লোক লজ্জার ভয়ে প্রকাশ্যে জানাতে পারছেন না দাবিটুকু। অথচ কোনোভাবে গোপন ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে পড়লে ছেলে মেয়ে আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবেন না, কথাটি প্রায়ই ভুলে যান। আরে চুরি করে খেতে যদি লজ্জাই না হবে, তাহলে মাথা উঁচু করে প্রাপ্যটা চাইতে কেন এত দ্বিধা?
মনে আছে প্রথমবার মাহির যখন তাকে বউ বলে ডেকে উঠেছিল, কী এক অদ্ভুত শিহরণে কেঁপে উঠেছিল বারবার।
এমন যদি হতো যে সংসার স্বামীর অভিজ্ঞতা তার জীবনে হয়নি, তেমনটা তো নয়। মিন্টু তো বিয়ের প্রথম দিকে বউ বউ বলে ডেকে মুখে ফেনা তুলে ফেলার অবস্থা করে ফেলতো। কিন্তু সেই ডাক শুনে কখনো তার ভেতর তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। অথচ মাহিরের মুখে ডাকটা কী এক অদ্ভুত মাদকতায় আচ্ছন্ন করে ফেলে তাকে। মাহিরের অনেক গুনের চেয়ে দোষের পরিমাণ যদিও বেশি তবু একটা দিক বিবেচনা করে তাকে আর সব মানুষের চেয়ে আলাদা করে ফেলা যায়।
ভাল করুক আর মন্দ করুক কোনোটারই আড়াল রাখাটা পছন্দ করে না। কিন্তু সমাজে সেইসব মানুষের সংখ্যাই বেশি যারা আড়াল আবডালকেই পছন্দ করে।
মিন্টুর সঙ্গে ছাড়া ছাড়ির পর ব্যক্তিগত যোগাযোগ তেমন হয় না। যদিও অনেকবারই সে চেষ্টা করেছে যোগাযোগ করতে কিন্তু নিজ থেকে ব্যাপারটাকে বাড়তে দেয়নি। তবু ইদানীং বেশ ঘন ঘনই যেন ভুল করে ফোন করছে সে।
হতে পারে মাহিরের সঙ্গে তার সম্পর্কের ব্যাপারটি জানার পর এক ধরণের ঈর্ষা কাজ করছে তার ভেতরে ভেতরে। গুলি করে মারবার ভয় দেখায়। যদিও এ নিয়ে কোনো সংশয় কাজ করে না মনের ভেতর, তবু মিন্টুর পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। তা ছাড়া মানুষে যখন তার নৈতিক খোলস থেকে বেরিয়ে পড়ে তখন কতটা নিচে নামবে তার কোনো সীমারেখা থাকে বলে মনে হয় না। এলাকার পরিচিতদের কেউ কেউ তার পক্ষে ওকালতি করতে আসে।
কিন্তু তার ইচ্ছে হয় না সে সব কথা কানে তোলে। তবু নাছোড়বান্দা টাইপের কেউ কেউ পুরো কথা না শুনিয়ে যায় না। ইনিয়ে বিনিয়ে কেবল একটি কথাই তারা বলতে চায় যে, বয়স তো মোটামুটি অনেক হয়েছে, এ বয়সে কেন আর বিয়ের ভাবনা করা। তার চেয়ে বরং বাচ্চাগুলোর দিকে মনোযোগী হওয়া বিচক্ষণতার পরিচয়। বলা তো যায় না নতুন মানুষ তার আগের ঘরের সন্তানদের কোন চোখে দেখবে!
তার তখন বেশ ধমকের সুরে বলতে ইচ্ছে হয়, আমার জীবন আমি কীভাবে কাটাবো তার রুটিন কি তোমরা করে দেবে? আমাকে কি শালীনভাবে একটা জীবন বেছে নিতে দেবে না? নাকি তোমরা যতবার ভুল করবে আমাকে ততবারই মুখ বুজে তার মাশুল দিয়ে যেতে হবে।
এবার আর তেমনটি হবার সুযোগ নেই। নিজের ভুলের মাশুল দিতে হলে ততটা কষ্ট লাগবে না হয়তো। আর কিছু না হোক মনের একটা সান্ত্বনা থাকবে। কিন্তু সে সম্ভাবনা বলতে গেলে নগণ্য। মানুষের অসতর্ক আর আবেগঘন মুহূর্তেই তার আসল চরিত্র ফুটে ওঠে।
মাহির যেমনই হোক অন্তত কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ কারবার করার মানুষ অন্তত নয়।
হঠাৎ করে পিঠের দিকে সরু একটি শিরশিরে ভাব ওপর থেকে নিচের দিকে গড়িয়ে যেতে থাকলে বেশ অস্বস্তি বোধ হতে থাকে। ইচ্ছে হয় পেছনে হাত দিয়ে একবার স্পর্শ করে দেখে। যদিও জানা আছে এই গরমে ঘামের কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই যে সেখানেই অবস্থান করবে, তবু এমন অস্বস্তিকর অবস্থা হলে হাত দুটো কেমন নিশপিশ করতে থাকে। কিন্তু উন্মুক্ত রাস্তায় এমনভাবে পিঠের দিকে হাত নিয়ে যেতেও দশবার ভাবতে হয়।
রাস্তায় এবং হাট-বাজারে লোলুপ আর কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের অভাব থাকে না।
কিছুক্ষণ আগে দেখা লোকটি এখনো দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিনা আড় চোখে একবার সেদিকে তাকাতে চেষ্টা করে পায়েল। কিন্তু কেন যেন তার হঠাৎ মনে হলো লোকটা সেখানে বা আশপাশে নেই। এতক্ষণ ঘাড়ের পেছনে বা তলপেটের দিকে যে অস্বস্তি একটা ভাব বিরাজ করছিল তা আর টের পাচ্ছিল না। মাথা তুলে সে এবার ভাল মতোই তাকায় সেদিকে।
না , দেখা যাচ্ছে না লোকটিকে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সে হাঁটছিল। একবার মনে হয়েছিল দরজির দোকানে অনেকদিন ধরেই পড়ে আছে দুটো জামা। অফিস থেকে ফেরার সময় উৎসাহ পায় না বলে সেদিকে যাওয়া হয় না। এখনও ইচ্ছে করছে না যেতে।
কিন্তু তার অবশ্যই যাওয়া উচিত। তখনই মনে পড়ে রসিদটা ঘরে আছে। সঙ্গে থাকলে যাওয়ার কথা ভাবা যেত। তবু সে মনে মনে ঠিক করে যে, ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রসিদটা নিয়ে বের হবে। যাই যাই করে এতদিন যাওয়া হয়নি।
আজও আলসেমীকে গুরুত্ব দিলে কাজটা আবার কোনদিন হবে বলা কঠিন। ভাবতে ভাবতে সে বাড়ির গেটের তালা খুলে ভেতর দিকে হুড়কো আটকে দিয়ে সিঁড়িতে উঠবার মুখেই হঠাৎ থমকে যায়। উপরে উঠবার সিঁড়ির তিনটা ধাপের ওপর বসে আছে লোকটি। হাতে কালো আর ছোট ছোট বিন্দুর মত জং ধরা একটি পিস্তল বা রিভলবার। সম্মোহিতের মতো পায়েল তাকিয়ে থাকে লোকটির চোখের দিকে।
কী করবে তাই যেন ভাববার ফুসরত পাচ্ছে না সে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।