আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীরা বিষয়ক কবিতা

এতকিছু ... ওই সিনেমার জন্যই... সত্যবদ্ধ অভিমান এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ? শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায় তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে নীরার সুষমা চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ? তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়-- আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে মনে মনে বলি, যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো-- ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন পাপ করতে পারি ? এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি-- এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায় ? সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনে পড়ে ভীষণ জরুরী কথাটাই বলা হয়নি লঘু মরালীর মতো নারীটিকে নিয়ে যাবে বিদেশী বাতাস আকস্মিক ভূমিকম্পে ভেঙ্গে যাবে সবগুলো সিঁড়ি থমকে দাঁড়িয়ে আমি নীরার চোখের দিকে.... ভালোবাসা এক তীব্র অঙ্গীকার, যেন মায়াপাশ সত্যবদ্ধ অভিমান--চোখ জ্বালা করে ওঠে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে, ভালোবাসি-- এই ওষ্ঠে আর কোন মিথ্যে কি মানায় ? নীরা তুমি নীরা, তুমি নিরন্নকে মুষ্টিভিক্ষা দিলে এইমাত্র আমাকে দেবে না? শ্মশানে ঘুমিয়ে থাকি, ছাই-ভস্ম খাই, গায়ে মাখি নদী-সহবাসে কাটে দিন এই নদী গৌতম বুদ্ধকে দেখেছিল পরবর্তী বারুদের আস্তরণও গায়ে মেখেছিল এই নদী তুমি! বড় দেরি হয়ে গেল, আকাশে পোশাক হতে বেশি বাকি নেই শতাব্দীর বাঁশবনে সাংঘাতিক ফুটেছে মুকুল শোনোনি কি ঘোর দ্রিমি দ্রিমি? জলের ভিতর থেকে সমুত্থিত জল কথা বলে মরুভূমি মেরুভূমি পরস্পর ইশারায় ডাকে শোনো, বুকের অলিন্দে গিয়ে শোনো হে নিবিড় মায়াবিনী, ঝলমলে আঙুল তুলে দাও। কাব্যে নয়, নদীর শরীরে নয়, নীরা চশমা-খোলা মুখখানি বৃষ্টিজলে ধুয়ে কাছাকাছি আনো নীরা, তুমি নীরা হয়ে এসো! নীরা ও জীরো আওয়ার এখন অসুখ নেই, এখন অসুখ থেকে সেরে উঠে পরবর্তী অসুখের জন্য বসে থাকা। এখন মাথার কাছে জানলা নেই, বুক ভরা দুই জানলা, শুধু শুকনো চোখ দেয়ালে বিশ্রাম করে, কপালে জলপট্টির মতো ঠাণ্ডা হাত দূরে সরে গেছে, আজ এই বিষম সকালবেলা আমার উত্থান নেই, আমি শুয়ে থাকি, সাড়ে দশটা বেজে যায়। প্রবন্ধ ও রম্যরচনা, অনুবাদ, পাঁচ বছর আগের শুরু করা উপন্যাস, সংবাদপত্রের জন্য জল-মেশানো গদ্য থেকে আজ এই সাড়ে দশটায় আমি সব ভেঙেচুরে উঠে দাঁড়াতে চাই–অন্ধ চোখ, ছোট চুল–ইস্ত্রিকরা পোশাক ও হাতের শৃঙ্খল ছিঁড়ে ফেলে আমি এখন তোমার বাড়ির সামনে, নীরা থুক্‌ করে মাটিতে থুতু ছিটিয়ে‌ বলি : এই প্রাসাদ একদিন আমি ভেঙে ফেলবো! এই প্রাসাদে এক ভারতবর্ষব্যাপী অন্যায়। এখান থেকে পুনরায় রাজতন্ত্রের উৎস।

আমি ব্রীজের নিচে বসে গম্ভীর আওয়াজ শুনেছি, একদিন আমূলভাবে উপড়ে নিতে হবে অপবিত্র সফলতা। কবিতায় ছোট দুঃখ, ফিরে গিয়ে দেখেছি বহুবার আমার নতুন কবিতা এই রকম ভাবে শুরু হয় : নীরা, তোমায় একটি রঙিন সাবান উপহার দিয়েছি শেষবার; আমার সাবান ঘুরবে তোমার সারা দেশে। বুক পেরিয়ে নাভির কাছে মায়া স্নেহে আদর করবে, রহস্যময় হাসির শব্দে ক্ষয়ে যাবে, বলবে তোমার শরীর যেন অমর না হয়… অসহ্য! কলম ছুঁড়ে বেরিয়ে আমি বহুদূর সমুদ্রে চলে যাই, অন্ধকারে স্নান করি হাঙর-শিশুদের সঙ্গে ফিরে এসে ঘুম চোখ, টেবিলের ওপাশে দুই বালিকার মতো নারী, আমি নীল-লোভী তাতার বা কালো ঈশ্বর-খোঁজা নিগ্রোদের মতো অভিমান করি, অভিমানের স্পষ্ট শব্দ, আমার চা-মেশানো ভদ্রতা হলুদ হয়! এখন, আমি বন্ধুর সঙ্গে সাহাবাবুদের দোকানে, এখন বন্ধুর শরীরে ইঞ্জেকশন ফুঁড়লে আমার কষ্ট, এখন আমি প্রবীণ কবির সুন্দর মুখ থেকে লোমশ ভ্রুকুটি জানু পেতে ভিক্ষা করি, আমার ক্রোধ ও হাহাকার ঘরের সিলিং ছুঁয়ে আবার মাটিতে ফিরে আসে, এখন সাহেব বাড়ীর পার্টিতে আমি ফরিদপুরের ছেলে, ভালো পোষাক পরার লোভ সমেত কাদা মাখা পায়ে কুৎসিত শ্বেতাঙ্গিনীকে দু’পাটি দাঁত খুলে আমার আলজিভ দেখাই, এখানে কেউ আমার নিম্নশরীরের যন্ত্রনার কথা জানে না। ডিনারের আগে ১৪ মিনিটের ছবিতে হোয়াইট ও ম্যাকডেভিড মহাশূন্যে উড়ে যায়, উন্মাদ! উন্মাদ! এক স্লাইস পৃথিবী দূরে, সোনার রজ্জুতে বাঁধা একজন ত্রিশঙ্কু। কিন্তু আমি প্রধান কবিতা পেয়ে গেছি প্রথমেই, ৯, ৮, ৭, ৬, ৫…থেকে ক্রমশ শূন্যে এসে স্তব্ধ অসময়, উলটোদিকে ফিরে গিয়ে এই সেই মহাশূন্য, সহস্র সূর্যের বিস্ফোরণের সামনে দাঁড়িয়ে ওপেনহাইমার প্রথম এই বিপরীত অঙ্ক গুনেছিল ভগবৎ গীতা আউড়িয়ে? কেউ শূন্যে ওঠে কেউ শূন্যে নামে, এই প্রথম আমার মৃত্যু ও অমরত্বের ভয় কেটে যায়, আমি হেসে বন্দনা করি : ওঁ শান্তি! হে বিপরীত সাম্প্রতিক গণিতের বীজ তুমি ধন্য, তুমি ইয়ার্কি, অজ্ঞান হবার আগে তুমি সশব্দ অভ্যুত্থান, তুমি নেশা, তুমি নীরা, তুমিই আমার ব্যক্তিগত পাপমুক্তি।

আমি আজ পৃথিবীর উদ্ধারের যোগ্য নীরা তোমার কাছে সিঁড়ির মুখে কারা অমন শান্তভাবে কথা বললো? বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে, তবু তুমি দাঁড়িয়ে রইলে সিঁড়িতে রেলিং-এ দুই হাত ও থুত্‌নি, তোমায় দেখে বলবে না কেউ থির বিজুরি তোমার রঙ একটু ময়লা, পদ্মপাতার থেকে যেন একটু চুরি, দাঁড়িয়ে রইলে নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো। নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর মাত্র দু’দিন দোল ও সরস্বতী পূজোয়–দুটোই খুব রঙের মধ্যে রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন– ও দুটো দিন তুমি আলাদা, ও দুটো দিন তুমি যেন অন্য নীরা বাকি তিনশো তেষট্টি বার তোমায় ঘিরে থাকে অন্য প্রহরীরা। তুমি আমার মুখ দেখোনি একলা ঘরে, আমি আমার দস্যুতা তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, আমরা কেউ বুকের কাছে কখনো কথা বলিনি পরস্পর, চোখের গন্ধে করিনি চোখ প্রদক্ষিণ– আমি আমার দস্যুতা তোমার কাছে লুকিয়ে আছি, নীরা তোমায় দেখা আমার মাত্র দু’দিন। নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো। আমি তোমায় লোভ করিনি, আমি তোমায় টান মারিনি সুতোয় আমি তোমার মন্দিরের মতো শরীরে ঢুকিনি ছল ছুতোয় রক্তমাখা হাতে তোমায় অবলীলায় নাশ করিনি; দোল ও সরস্বতী পূজোয় তোমার সঙ্গে দেখা আমার–সিঁড়ির কাছে আজকে এমন দাঁড়িয়ে রইলে নীরা, তোমার কাছে আমি নীরার জন্য রয়ে গেলাম চিরঋণী।

নীরা তুমি কালের মন্দিরে চাঁদের নীলাভ রং, ওইখানে লেগে আছে নীরার বিষাদ ও এমন কিছু নয়, ফুঁ দিলেই চাঁদ উড়ে যাবে যে রকম সমুদ্রের মৌসুমিতা, যে রকম প্রবাসের চিঠি অরণ্যের এক প্রান্তে হাত রেখে নীরা কাকে বিদায় জানালো আঁচলে বৃষ্টির শব্দ, ভুরুর বিভঙ্গে লতা পাতা ও যে বহুদূর, পীত অন্ধকারে ডোবে হরিৎ প্রান্তর ওখানে কী করে যাবো, কী করে নীরাকে খুঁজে পাবো? অক্ষরবৃত্তের মধ্যে তুমি থাকো, তোমাকে মানায় মন্দাক্রান্তা, মুক্ত ছন্দ, এমনকি চাও শ্বাসাঘাত দিতে পারি, অনেক সহজ কলমের যে-টুকু পরিধি তুমি তাও তুচ্ছ করে যদি যাও, নীরা, তুমি কালের মন্দিরে ঘন্টধ্বনি হয়ে খেলা করো, তুমি সহাস্য নদীর জলের সবুজে মিশে থাকো, সে যে দূরত্বের চেয়ে বহুদূর তোমার নাভির কাছে জাদুদণ্ড, এ কেমন খেলা জাদুকরী, জাদুকরী, এখন আমাকে নিয়ে কোন রঙ্গ নিয়ে এলি চোখ-বাঁধা গোলকের ধাঁধায়! নীরার জন্য কবিতার ভুমিকা এই কবিতার জন্য আর কেউ নেই, শুধু তুমি, নীরা এ কবিতার মধ্যরাত্রে তোমার নিভৃত মুখ লক্ষ্য করে ঘুমের ভিতরে তুমি আচমকা জেগে উঠে টিপয়ের থেকে জল খেতে গিয়ে জিভ কামড়ে এক মুহুর্ত ভাববে কে তোমায় মনে করছে এত রাত্রে — তখন আমার এই কবিতার প্রতিটি লাইন শব্দ অক্ষর কমা ড্যাশ রেফ ও রয়ের ফুটকি সমেত ছুটে যাচ্ছে তোমার দিকে, তোমার আধো ঘুমন্ত নরম মুখের চারপাশে এলোমেলো চুলে ও বিছানায় আমার নিঃশ্বাসের মতো নিঃশব্দ এই শব্দগুলো এই কবিতার প্রত্যেকটি অক্ষর গুণিনের বাণের মতো শুধু তোমার জন্য, এরা শুধু তোমাকে বিদ্ধ করতে জানে তুমি ভয় পেয়ো না, তুমি ঘুমোও, আমি বহু দূরে আছি আমার ভযংকর হাত তোমাকে ছোঁবে না, এই মধ্যরাত্রে আমার অসম্ভব জেগে ওঠা, উষ্ণতা, তীব্র আকাঙ্খা ও চাপা আর্তরব তোমাকে ভয় দেখাবে না — আমার সম্পূর্ণ আবেগ শুধু মোমবাতির আলোর মতো ভদ্র হিম, . শব্দ ও অক্ষরের কবিতায় তোমার শিয়রের কাছে যাবে — এরা তোমাকে চুম্বন করলে তুমি টের পাবে না, এরা তোমার সঙ্গে সারা রাত শুয়ে থাকবে এক বিছানায় — তুমি জেগে উঠবে না, সকালবেলা তোমার পায়ের কাছে মরা প্রজাপতির মতো লুটোবে | এদের আত্মা মিশে থাকবে তোমার শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে, চিরজীবনের মতো বহুদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা হলে ঝর্নার জলের মতো হেসে উঠবে, কিছুই না জেনে | নীরা, আমি তোমার অমন সুন্দর মুখে বাঁকা টিপের দিকে চেয়ে থাকবো | আমি অন্য কথা বালার সময় তোমার প্রস্ফুটিত মুখখানি আদর করবো মনে-মনে ঘর ভর্তি লোকের মধ্যেও আমি তোমার দিকে . নিজস্ব চোখে তাকাবো | তুমি জানতে পারবে না — তোমার সম্পূর্ণ শরীরে মিশে আছে | আমার একটি অতি ব্যক্তিগত কবিতার প্রতিটি শব্দের আত্মা | নীরার দুঃখকে ছোঁয়া কতটুকু দূরত্ব? সহস্র আলোকবর্ষ চকিতে পার হয়ে আমি তোমার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসি তোমার নগ্ন কোমরের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস ফেলার আগে অলঙ্কৃত পাড় দিতে ঢাকা অদৃশ্য পায়ের পাতা দুটি বুকের কাছে এনে চুম্বন ও অশ্রুজলে ভেজাতে চাই আমার সাঁইত্রিশ বছরের বুক কাঁপে আমার সাঁইত্রিশ বছরের বাইরের জীবন মিথ্যে হয়ে যায় বহুকাল পর অশ্রু বিস্মৃত শব্দটি অসম্ভব মায়াময় মনে হয় ইচ্ছে করে তোমার দুঃখের সঙ্গে আমার দুঃখ মিশিয়ে আদর করি সামাজিক কাঁথা সেলাই করা ব্যবহার তছনছ করে স্ফুরিত হয় একটি মুহূর্ত আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে তোমার পায়ের কাছে… বাইরে বড় চ্যাঁচামেচি, আবহাওয়া যখন তখন নিম্নচাপ ধ্বংস ও সৃষ্টির বীজ ও ফসলে ধারাবাহিক কৌতুক অজস্র মানুষের মাথা নিজস্ব নিয়মে ঘামে সেই তো শ্রেষ্ঠ সময় যখন এ-সবকিছুই তুচ্ছ যখন মানুষ ফিরে আসে তার ব্যক্তিগত স্বর্গের অতৃপ্ত সিঁড়িতে যখন শরীরের মধ্যে বন্দী ভ্রমরের মনে পড়ে যায় এলাচ গন্ধের মতো বাল্যস্মৃতি তোমার অলোকসামান্য মুখের দিকে আমার স্থির দৃষ্টি তোমার রেজী অভিমানের কাছে প্রতিহত হয় দ্যুলোক-সীমানা প্রতীক্ষা করি ত্রিকাল দুলিয়ে দেওয়া গ্রীবাভঙ্গির আমার বুক কাঁপে, কথা বলি না বুকে বুক রেখে যদি স্পর্শ করা যায় ব্যথাসরিৎসাগর আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে আসি অসম্ভব দূরত্ব পেরিয়ে চোখ শুকনো, তবু পদচুম্বনের আগে অশ্রুপাতের জন্য মন কেমন করে! নীরার হাসি ও অশ্রু নীরার চোখের জল অনেক চোখের অনেক নীচে টল্‌মল্‌ নীরার মুখের হাসি মুখের আড়াল থেকে বুক, বাহু, আঙুলে ছড়ায় শাড়ির আঁচলে হাসি, ভিজে চুলে, হেলানো সন্ধ্যায় নীরা আমাকে বাড়িয়ে দেয়, হাস্যময় হাত আমার হাতের মধ্যে চৌরাস্তায় খেলা করে নীরার কৌতুক তার ছদ্মবেশ থেকে ভেসে আসে সামুদ্রিক ঘ্রাণ সে আমার দিকে চায়, নীরার গোধূলি মাখা ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ে লীলা লোধ্র আমি তাকে প্রচ্ছন্ন আদর করি, গুপ্ত চোখে বলি : নীরা, তুমি শান্ত হও অমন মোহিনী হাস্যে আমার বিভ্রম হয় না, আমি সব জানি পৃথিবী তোলপাড় করা প্লাবনের শব্দ শুনে টের পাই তোমার মুখের পাশে উষ্ণ হাওয়া নীরা, তুমি শান্ত হও! নীরার সহাস্য বুকে আঁচলের পাখিগুলি খেলা করে কোমর ও শ্রোণী থেকে স্রোত উঠে ঘুরে যায় এক পলক সংসারের সারাৎসার ঝলমলিয়ে সে তার দাঁতের আলো সায়াহ্নের দিকে তুলে ধরে নাগকেশরের মতো ওষ্ঠাধরে আঙুল ঠেকিয়ে বলে, চুপ! আমি জানি নীরার চোখের জল চোখের অনেক নিচে টল্‌মল্‌। । নীরার অসুখ নীরার অসুখ হলে কলকাতার সবাই বড় দুঃখে থাকে সূর্য নিভে গেলে পর, নিয়নের বাতিগুলি হঠাৎ জ্বলার আগে জেনে নেয় নীরা আজ ভালো আছে? গীর্জার বয়স্ক ঘড়ি, দোকানের রক্তিম লাবণ্য–ওরা জানে নীরা আজ ভালো আছে! অফিস সিনেমা পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে মুখে রটে যায় নীরার খবর বকুলমালার তীব্র গন্ধ এসে বলে দেয়, নীরা আজ খুশি হঠাৎ উদাস হাওয়া এলোমেলো পাগ্‌লা ঘন্টি বাজিয়ে আকাশ জুড়ে খেলা শুরু করলে কলকাতার সব লোক মৃদু হাস্যে জেনে নেয়, নীরা আজ বেড়াতে গিয়েছে। আকাশে যখন মেঘ, ছায়াচ্ছন্ন গুমোট নগরে খুব দুঃখ বোধ। হঠাৎ ট্রামের পেটে ট্যাক্সি ঢুকে নিরানন্দ জ্যাম চৌরাস্তায় রেস্তোরাঁয় পথে পথে মানুষের মুখ কালো, বিরক্ত মুখোস সমস্ত কলকাতা জুড়ে ক্রোধ আর ধর্মঘট, শুরু হবে লণ্ডভণ্ড টেলিফোন পোস্টাফিসে আগুন জ্বালিয়ে যে-যার নিজস্ব হৃৎস্পন্দনেও হরতাল জানাবে– আমি ভয়ে কেঁপে উঠি, আমি জানি, আমি তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই, গিয়ে বলি, নীরা, তুমি মন খারাপ করে আছো? লক্ষ্মী মেয়ে, একবার চোখে দাও, আয়না দেখার মতো দেখাও ও-মুখের মঞ্জরী নবীন জনের মতো কলহাস্যে একবার বলো দেখি ধাঁধার উত্তর! অমনি আড়াল সরে, বৃষ্টি নামে, মানুষেরা সিনেমা ও খেলা দেখতে চলে যায় স্বস্তিময় মুখে ট্রাফিকের গিঁট খোলে, সাইকেলের সঙ্গে টেম্পো, মোটরের সঙ্গে রিক্সা মিলেমিশে বাড়ি ফেরে যা-যার রাস্তায় সিগারেট ঠোঁটে চেপে কেউ কেউ বলে ওঠে, বেঁচে থাকা নেহাৎ মন্দ না! নীরার পাশে তিনটি ছায়া নীরা এবং নীরার পাশে তিনটি ছায়া আমি ধনুকে তীর জুড়েছি, ছায়া তবুও এত বেহায়া পাশ ছাড়ে না এবার ছিলা সমুদ্যত, হানবো তীর ঝড়ের মতো– নীরা দু’হাত তুলে বললো, ‘মা নিষাদ! ওরা আমার বিষম চেনা!’ ঘূর্ণি ধুলোর সঙ্গে ওড়ে আমার বুক চাপা বিষাদ– লঘু প্রকোপে হাসলো নীরা, সঙ্গে ছায়া-অভিমানীরা ফেরানো তীর দৃষ্টি ছুঁয়ে মিলিয়ে গেল নীরা জানে না! হঠাৎ নীরার জন্য বাস স্টপে দেখা হলো তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ দেখেছি ছুরির মতো বিঁধে থাকতে সিন্ধুপারে–দিকচিহ্নহীন– বাহান্ন তীর্থের মতো এক শরীর, হাওয়ার ভিতরে তোমাকে দেখছি কাল স্বপ্নে, নীরা, ওষধি স্বপ্নের নীল দুঃসময়ে।

দক্ষিণ সমুদ্রদ্বারে গিয়েছিলে কবে, কার সঙ্গে? তুমি আজই কি ফিরেছো? স্বপ্নের সমুদ্র সে কী ভয়ংকর, ঢেউহীন, শব্দহীন, যেন তিনদিন পরেই আত্মঘাতী হবে, হারানো আঙটির মতো দূরে তোমার দিগন্ত, দুই উরু ডুবে কোনো জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো, অথচ একলা ছিলে, ঘোরতর স্বপ্নের ভিতরে তুমি একা। এক বছর ঘুমোবো না, স্বপ্নে দেখে কপালের ঘাম ভোরে মুছে নিতে বড় মূর্খের মতন মনে হয় বরং বিস্মৃতি ভালো, পোশাকের মধ্যে ঢেকে রাখা নগ্ন শরীরের মতো লজ্জাহীন, আমি এক বছর ঘুমোবো না, এক বছর স্বপ্নহীন জেগে বাহান্ন তীর্থের মতো তোমার ও-শরীর ভ্রমণে পুণ্যবান হবো। বাসের জানালার পাশে তোমার সহাস্য মুখ, ‘আজ যাই, বাড়িতে আসবেন!’ রৌদ্রের চিৎকারে সব শব্দ ডুবে গেল। ‘একটু দাঁড়াও’, কিংবা ‘চলো লাইব্রেরির মাঠে’, বুকের ভিতরে কেউ এই কথা বলেছিল, আমি মনে পড়া চোখে সহসা হাতঘড়ি দেখে লাফিয়ে উঠেছি, রাস্তা, বাস, ট্রাম, রিকশা, লোকজন ডিগবাজির মতো পার হয়ে, যেন ওরাং উটাং, চার হাত-পায়ে ছুটে পৌঁছে গেছি আফিসের লিফ্‌টের দরজায়। বাস স্টপে তিন মিনিট, অথচ তোমায় কাল স্বপ্নে বহুক্ষণ।

। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরে। মাত্র চার বছর বয়সে তিনি কলকাতায় চলে আসেন। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ একা এবং কয়েকজন এবং ১৯৬৬ সালে প্রথম উপন্যাস আত্মপ্রকাশ প্রকাশিত হয়।

তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হল আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, যুগলবন্দী (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), হঠাৎ নীরার জন্য, রাত্রির রঁদেভূ, শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা, অর্ধেক জীবন, অরণ্যের দিনরাত্রি, অর্জুন, প্রথম আলো, সেই সময়, পূর্ব পশ্চিম, ভানু ও রাণু, মনের মানুষ ইত্যাদি। শিশুসাহিত্যে তিনি "কাকাবাবু-সন্তু" নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় "নীললোহিত", "সনাতন পাঠক" ও "নীল উপাধ্যায়" ছদ্মনামেও লেখেন। বর্তমানে তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য অকাদেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর আকাদেমির সভাপতি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪ (২১ ভাদ্র, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ) ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।