বৃথা হয়রানি বাঘটা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার ওপর। ব্যস্ত রাস্তা। শাঁ শাঁ করে ছুটছে গাড়ি। তাই পেরুবার জো পাচ্ছে না।
সারা গায়ে ধুলোর পরত।
জীর্ণ শরীর। বড়ো অসহায় হয়ে আছে বাঘটা।
গোল পাতা নেই। কেওড়ার বন নেই। নেই শাল-গামারির ঝোপ।
আছে শুধু বেনিয়ার লোলুপ দৃষ্টি। ভোগের অগ্ন্যুৎপাত। চারদিকে শুধু বিলবোর্ড আর বিলবোর্ড।
বিজ্ঞাপনের বনে বড়ো বিপন্ন বাঘ।
দৃশ্যটা আপনার শহরেরই।
একটু দরদি মন নিয়ে টাইগারপাস মোড়টা ঘুরে এলেই বুঝতে পারবেন।
কী সুন্দর ছিমছাম একটা শহর বিলবোর্ডের মোড়কে মুড়িয়ে নরক বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। সবুজের কোমল-বক্ষে কেবল বিজ্ঞাপনের আঁচড়।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একটা সাঁড়াশি অভিযান শুরু হয়েছিল এই বিলবোর্ডের বিরদ্ধে। বৈধ অবৈধ নির্বিচারে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল অনেক ওভারহেড, বিলবোর্ড, পোল ইত্যাদি।
আমি তখন ছুটিতে চট্টগ্রাম এলে জিইসি নইলে টাইগারপাস মোড়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতাম। আর অবাক হতাম এই শহরের স্বপ্নদ্রষ্টাদের দূরদর্শিতার কথা ভেবে।
এই শহরের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ মোড়েই এক পশলা সবুজের আয়োজন রাখা হয়েছিল। প্রতিটা মোড়েই ছিল একটা করে ফুলের বাগান। সেই বাগান উপড়ে বিপনি বিতান করা হয়েছে।
তারপরও যা আছে কম কী। এই জিইসি মোড়ের কথা ধরুন। পশ্চিম পাড়ে জিইসি ফ্যাক্টারি আর গৃহায়ণ অধিদপ্তরের অফিস। বিলবোর্ডগুলো সরিয়ে দেয়ার পর ঝিলমিল করে উঠেছিল যেন এই সবুজের উপত্যকা। আর টাইগারপাস, প্রবর্তক, নিউ মার্কেট... এসব মোড়ে এলে নিজেই দ্বিধায় পড়ে যেতাম, এই কি সেই আমার চিরচেনা চট্টগ্রাম?
আসলে অতিরিক্ত সুন্দরীদের বেশি সাজতে নেই।
বড়জোর একটা লাল টিপ, নইলে চোখে দুটো কাজলের টান। তাতেই সই। তাতেই দশ পাড়ার বউ- ঝিদের বুকে কাঁপুনি লাগে।
বিশ্বকাপের আগে বিলবোর্ড সরানো সেই ফকফকা শহরে আলতো কিছু কাজলরেখা দিয়েছিল সিটি কর্পোরেশন। যারাই খেলা দেখতে চট্টগ্রাম এসেছিল সবার মুখে ছিল ধন্যি ধন্যি।
আমরাও ভেবেছিলাম নতুন নগরপিতা তাঁর এই পরিমিতিবোধ দিয়ে আরো উৎকর্ষিত করবেন প্রাচ্যের দুলালীকে।
কিন্তু আমরা ভাবি এক হয় আরেক। কাল দেখলাম টাইগারপাসের সরু ফুটপাথ খুঁড়ে বড়ো বড়ো পোল বসানো হচ্ছে। তাতে চড়ানো হবে বিলবোর্ড। বছর দুয়েক আগে একই স্থান থেকে একই বস্তুই সরানো হয়েছিল।
এটা কিসের আলামত?
বিলবোর্ডে বিলবোর্ডে শহরটা এখন এমন হয়ে যাচ্ছে আমাদের দৃষ্টি আর ঊর্ধ্বগত হবার কোন উপায় নেই। সেদিন প্রবর্তক থেকে গোলপাহাড় পর্যন্ত এই একরত্তি পথে হিসাব করলাম বিলবোর্ডের ৬ টি বড়ো পোল। প্রবর্তক মোড় থেকে গোলপাহাড়ের দিকে তাকালে কেবল বিলবোর্ডগুলোই চোখে ভাসে। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণের মতো এই শহরে প্রকট হয়ে উঠছে বর্ণ দূষণও।
ঈশ্বরের দেয়া রূপের ওপর বাড়তি রূপ চড়াতে গেলে প্রকৃতি বিরূপ হয়।
পরমা হয় পেঁচা।
জিইসি মোড়টার দিকে তাকালে এর সত্যতা মেলে। পশ্চিম-প্রান্তটা এতো সবুজ, অথচ তিন তলা চার তলা বিজ্ঞাপনের বাহুপাশে পুরোটাই হরিয়ে গেছে দৃষ্টিসীমা থেকে। ওদিককার অনেক গাছ নাকি মারা পড়ছে সূর্যালোকের অভাবে।
জানি একটা শহর চালানোর জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন।
এই টাকা যেসব জায়গা থেকে আসে বিজ্ঞাপন তার একটা। তবে আমার জানা মতে বিজ্ঞাপন খাত থেকে চসিকের খুব একটা বড়ো অংকের রাজস্ব আসে না। ২০০৬ সালে একবার খবর নিয়ে দেখেলিাম সেই আয় বছরে এক কোটি টাকাও নয়। যেখানে সিটি কর্পোরেশনের বার্ষিক বাজেট অর্ধসহস্র কোটি টাকার অধিক, সেখানে এই মামুলি টাকার জন্য মুখে কালি মাখানোর কি মানে? অঞ্চলভিত্তিক বিজ্ঞাপনের ভাড়া স্থির করলে আরো কম বিজ্ঞাপন দিয়ে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ উপার্জন সম্ভব।
সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার একটা ঘূর্ণিঝড় কিংবা ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে এই বিলবোর্ড পোলগুলো রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়বে।
তখন সব রকমের উদ্ধারকাজ থমকে যাবে এসবের জন্য।
লেখাটা বড়ো করা যায়। অনেক কথা বলা যায়। অনেক যুক্তি দেখানোও যায়। কিন্তু কাকে দেখাবো।
কাকে বোঝাবো। এই শহরের কর্ণধার যিনি তিনি আমার চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসেন এই শহরটাকে আমি বিশ্বাস করি। না হলে এতো বিপুল ভোটে তার জয় হত না। আশা করি আমার এই ক্ষুদ্র আঁকুতিটা তাঁকেও স্পর্শ করবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।