আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিজ্ঞাপনের পোস্টমর্টেম

একটি বিজ্ঞাপন কিভাবে মানুষের মাঝে মরিচীকার মায়াজাল সৃষ্টি করে- ‘জুঁই’ নারকেল তেলের বিজ্ঞাপনের আলোকে একটি বিশ্লেষণ: আলোকচিত্র এক আজব বস্তু; কিছু মূল্যহীন কাগজের টুকরা, যা কিনা ধরে রাখে মূল্যবান বা মূল্যহীন অতীতকে। তাইতো রোলাঁ বার্থ একে ‘জাদু’ বলে উল্লেখ করেছেন। যোগাযোগের অত্যন্ত শক্তিশালী একটি মাধ্যম হলো আলোকচিত্র। এর ভাষা এতটাই শক্তিশালী যে কোন কিছু না বলে ই অনেক কিছু বলে ফেলা সম্ভব। বলা হয়ে থাকে যে, হাজার শব্দ যা প্রকাশ করতে পারে না, একটি আলোকচিত্র খুব সহজেই সেটা প্রকাশ করতে পারে।

এ কারণেই মূলত বিজ্ঞাপনে আলোকচিত্রের ব্যবহার করা হয়। সাধারণত বিজ্ঞাপনের আলোকচিত্রে দেখানো হয় সমাজের প্রচলিত ধারণায় সুন্দর কোন হিরো বা হিরোইন কোন একটি পণ্যের মডেল; মানুষ যখন বিজ্ঞাপনের আলোকচিত্রে দেখে যে, তাদের প্রিয় তারকা মডেলরা বা আকর্ষনীয় একজন মানুষ ঐ পণ্যটি ব্যবহার করছে, তখন তারাও পণ্যটি কিনতে উদ্ভুদ্ধ হয়ে উঠে। তবে বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত কোন পণ্যের উপযোগীতা ব্যবহার কারী মডেল যেভাবে ভোগ করেন বলে প্রচার করা হয় বাস্তবে ঐ পণ্যটি ব্যবহারের করে ক্রেতা তথা সাধারণ ভোক্তা সে উপযোগীতা নাও পেতে পারেন। তাই বলা যায় বিজ্ঞাপনে প্রদর্শিত একটি আলোকচিত্র সব সময় সত্য উপস্থাপন করে না। তাই দেখা যায় আলোকচিত্রের মতো শক্তিশালী একটি মাধ্যমকে ব্যবসায়ীক স্বার্থে (অপ !)ব্যবহার করা হয়।

নির্দেশক অর্থ: এই বিজ্ঞাপনের আলোকচিত্রটিতে সাধারণভাবে আমরা যা দেখতে পাই তা এমন- ঘন, কালো ও লম্বা কেশধারী একজন সুন্দর হাস্যোজ্জল তরুণীর ইমেজ আলোক চিত্রে ফুটে উঠেছে। পাশা-পাশি রয়েছে নামী বিউটি পারলারের মালিক, বিউটি এক্সপার্ট কানিজ আলমাস খান, সাথে তার একটি পরামর্শমূলক মন্তব্য ‘সুস্থ সুন্দর চুলের জন্য আমি সাজেস্ট করি জুঁই’। এ বিজ্ঞাপনচিত্রের দ্বারা খুব সহজে বোঝা যাচ্ছে যে, চুলে ‘জুঁই’ নারকেল তেল মাখলে এ আলোকচিত্রের মেয়েটির চুলের মতো সুন্দর চুল হবে; আর চুল সুন্দর হলে মেয়েটির মত সুন্দর হওয়া যাবে। কারণ ফটোগ্রাফে আরো লেখা আছে, চুল সুন্দর, তো তুমি সুন্দর। আলোকচিত্রটির গূঢ় অর্থ ও এর সামাজিক সম্পর্ক : ঠোটে হাসি , গ্রীবা বাঁকিয়ে, রহস্যময় বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।

চোখে কত স্বপ্ন! সৌন্দর্যের স্বীকৃতিতো সে পেল, এবার সে জয় করবে। এখন প্রশ্ন উঠে কী জয় করবে সে? তার উত্তর হতে পারে এমন- যে সে ভবিষ্যৎ জীবনে জয়ী হবে। আমাদের দৃশ্যমান জগতের অভিজ্ঞতার আলোকে কল্পনা করা যাক তার ভবিষ্যৎ জীবনের গতিপথ কেমন হতে পারে... যেহেতু সে সুন্দরী সুতরাং দেখতে শুনতে খুব ভালো না হলেও মোটামুটি ভালো চাকুরীওয়ালা বা পয়সাওয়ালা একটি বর তার কপালে জুটে যাবে। তার পর! তার পর সে স্বামী ঘরে সুখের সংসার রচনা করবে,স্বামীর আদরে সোহাগে কিভাবে যে কেটে যাবে মধুময় সোনালী দিন গুলো! হয়তো টেরও পাবে না। তারপর শ্বশুর-শ্বাশুড়ীর সেবা যতœ করবে।

কিছুদিন পর দু’একটি সন্তানের মা হবে। আদর সোহাগ দিয়ে তাদের লালন পালন করবে। স্কুলে যাওয়ার উপযোগী হলে তাদের স্কুলে নিয়ে যাবে। তাদের জন্য অপেক্ষার সময়টিতে স্কুলের সামনে বসে অন্য মা’ দের সাথে গল্পের ফাঁকে নকশি কাঁথার ফুল তুলবে। বাসায় রান্না বান্না করে শশুর-শাশুড়ি, স্বামী সন্তান সবাইকে খাইয়ে সেও খাবে।

এভাবেই হয়তো হাসি আনন্দে তার জীবন এগিয়ে যাবে! নারী তোমার জীবনের গতিপথ এমন হতে পারে তখনই, যখন তুমি সুন্দরী হবে। আর সুন্দরী হতে হলে তোমাকে চুলে ‘জুুঁই’ নারকেল তেল মাখতে হবে । তাহলেই তুমি সুন্দরী হতে পারবে। এখন কল্পনা করা যাক তার নিকট অতীত হতে বর্তমান অবস্থা... হতে পারে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মেয়েটির চুলও যখন কিছুটা বড় হলো তখন তার চুল এমন সুন্দর ছিল না। চুল যেহেতু সুন্দর ছিল না দেখতেও সে সুন্দর না(বিজ্ঞাপনে এমনটিই বলা আছে যে, ‘চুল সুন্দর, তো তুমি সুন্দর’)।

সুন্দরী না হওয়াতে মেয়েটির মনে অনেক দুঃখ! স্কুল,কলেজ পার হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় বটে,কিন্তু সব সময় অন্যদের সাথে নিজের তুলনা করে আর অন্য মেয়েদের দেখে হীনমন্যতায় ভোগে। মনে তার সুখ নাই। ঘরের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নায় নিজেকে বার বার দেখে আর মনের দুঃখে নিরবে গোপনে দু’চোখের অশ্রু ঝরায়। সৃষ্টিকর্তার প্রতিও তার চরম ক্ষোভ; কেন তাকে এমন অসুন্দর করে সৃষ্টি করেছেন? আবার সব সময় প্রার্থনাও করে যে, তাকে যেন সুন্দর করে দেন; তিনি ইচ্ছা করলে তো সবই করতে পারেন। মা তার মেয়ের দুঃখ বুঝতে পারেন, কিন্তু তিনি কী করতে পারেন? নিজের মনের দুঃখ গোপন করে মেয়েকে শান্তনা দেন।

বাবাকেও বলেন তার মেয়ের দুঃখের কথা । বাবারও চিন্তায় চিন্তায় ঘুম হয় না, ঘরে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে এমন মেয়ে থাকলে কোন বাবার পক্ষেই কি শান্তিতে ঘুমানো সম্ভব? মেয়ের বয়স বেড়ে যাচ্ছে অথচ কোন ভালো ছেলে পাচ্ছেন না। কি করে এমন মেয়েকে বিয়ে দিবেন! তারপর একদিন তাদের জীবন মেঘের আড়াল থেকে উকি দেয়া সূর্যের আলোর সন্ধান পেলেন! জানতে পারলেন ‘জুঁই’ নারকেল তেল সম্পর্কে। বাবা বাজার থেকে মেয়ের জন্য নিয়ে এলেন ‘জুঁই’ এর একটি বোতল। নিয়মিত মাখার ফলে কিছু দিনের মধ্যেই মেয়ের চুল হলো ঘন,কালো ও লম্বা।

মেয়েটিও সুন্দরী হয়ে গেল। কেটে গেল তার চেহারা থেকে দুঃখের অমানিশা। হাসিতে সব সময় তার চেহারা জ্বল জ্বল করছে। এখন কত ছেলে লাইন দিয়ে তার পিছে ঘুরে! মা-বাবার আনন্দেরও আর শেষ নাই। এত ছেলে থেকে দেখে শুনে ভালো একটি ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দিবেন।

যা এখন খালি সময়ের ব্যাপার! ...উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি যে, বিজ্ঞাপনটির আলোকচিত্রের মেয়েকে জীবনে জয়ী(?) হতে হলে তাকে যে কোন ভাবেই হোক সুন্দরী হতে হবে। কারণ পুরুষ শাসিত সমাজে নারিকে সম্পূর্ণ মানুষ মনে করে না। তাইতো কবি বলেন- “আমি তোমার বাংলাদেশের মেয়ে। সৃষ্টিকর্তা পুরো সময় দেননি আমাকে মানুষ গড়তে রেখেছেন আধা আধা করে। ” (‘শ্যামলী’ কাব্যের ‘বাঁশিওয়ালা’ কবিতাতে ‘মালতি’র উক্তি) এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলবো যে, নারীর একমাত্র কাজ সুন্দরী হওয়া নয়।

সময় হয়েছে পুরুষের সাথে তারও এগিয়ে যাবার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।