আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গান্ধীর অন্য এক জীবন

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনকালে তাঁর অদ্ভুত যৌনজীবন নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছিল। তিনি নিজেও এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলতেন, অনেক সময় প্ররোচনাও দিতেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর এ বিষয়ে খুব বেশি আলোচনা হয়নি।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মোহনদাস গান্ধীর যৌনাচারকে ‘অস্বাভাবিক ও অপ্রাকৃতিক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তবে এ নিয়ে গান্ধী ছিলেন অবিচল।

কারণ, তিনি একে তাঁর নীতি-আদর্শ ও ধর্মাচরণের অংশ বলেই বিশ্বাস করতেন।
‘গান্ধী: ন্যাকেড অ্যাম্বিশন’ বইয়ের লেখক জাড অ্যাডামসের মতে, যখন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীকে ‘মহাত্মা’ ও ‘জাতির পিতা’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজন দাঁড়াল, তখন তাঁর বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ড তো বটেই, ‘অদ্ভুত খেয়াল’ নিয়েও আলোচনার দ্বার সংকুচিত হয়েছে।
গান্ধীজির যৌনাচার বর্জনের এ চর্চার শুরু কোথা থেকে, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। তবে ১৯০৬ সালে যখন তাঁর বয়স ৩৮, তখন থেকে তিনি ব্রহ্মাচর্য গ্রহণ করেন এবং তেমন জীবনযাপন শুরু করেন। এ জীবনের একান্ত অনুষঙ্গ হলো ওই কৌমার্যব্রত বা যৌনাচারহীন জীবনযাপন।


সম্প্রতি গান্ধীর কৌমার্যব্রত-চর্চার সঙ্গী মানু গান্ধীর ডায়েরির কিছু তথ্য প্রকাশিত হয়েছে ‘ইন্ডিয়া টুডে’ সাময়িকীতে। এসব ডায়েরির প্রকাশ এত দিন ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। গান্ধীর পরিবার কখনোই চায়নি এসব তথ্য বাইরে প্রকাশিত হোক। এমনকি মানু গান্ধী যেন এসব তথ্য বাইরের কাউকে না জানান, সেজন্য গান্ধীর পরিবারের লোকেরা তাঁকে বিশেষভাবে ‘আদেশ’ করেছিলেন।
কিন্তু কেন এমন আদেশ? কেমন ছিল গান্ধীর কৌমার্যব্রত? যে চর্চা গান্ধী সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেটি নিয়ে প্রচার দূরে থাক, আলাপ করাই নিষিদ্ধ হয়ে দাঁড়াল কেন?
মানুর ডায়েরি থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।

তবে গান্ধীর কৌমার্যব্রতের চর্চা কিশোরীদের ওপর কী ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছিল, তা কিছুটা হলেও বোঝা যায়। এ ছাড়া, তা গান্ধীর সঙ্গী নারীদের মধ্যে যে রেষারেষি তৈরি করেছিল, তা-ও বেরিয়ে আসে।
মানু গান্ধীর আসল নাম মৃদুলা গান্ধী। মানু ছিল তাঁর ডাকনাম। এখন পর্যন্ত তাঁর ১০টি ডায়েরির সন্ধান মিলেছে।

গুজরাটি ভাষায় লেখা ডায়েরির প্রথম অন্তর্ভুক্তি ১৯৪৩ সালের ১১ এপ্রিল। মানু ছিলেন গান্ধীর ভাতিজা জয়সুখলালের কন্যা। মানু তাঁর ডায়েরি গান্ধীকে নিয়মিত দেখাতেন। তিনি প্রয়োজনে ডায়েরির পাশে মন্তব্য লিখতেন।
১৯৪২ সালে গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবাকে দেখভালের জন্য মানু পুনে শহরের আগা খান প্রাসাদে যান।

গান্ধী তখন তাঁর পরিবার নিয়ে ওই বাড়িতে বাস করতেন। মানুর কাজ ছিল অসুস্থ কস্তুরবার সেবা করা। ১৯৪৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কস্তুরবার মৃত্যুর পর গান্ধীর সঙ্গে থেকে যান মানু। গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের বিষয়ে মানু ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘বাপু (মোহনদাসকে এ নামে ডাকা হতো) আমার মা। তিনি তাঁর চরিত্র গঠনের মহাযজ্ঞের ব্রহ্মাচর্য পালনের অংশে আমাকে সঙ্গী করে মানবজীবনের এক উচ্চতায় উন্নীত করেছেন।

এই চর্চার বিষয়ে যেকোনো চটুল আলাপ নিষিদ্ধ। ’
মহাত্মা গান্ধীর সচিব ছিলেন পিয়ারেলাল। তিনি তাঁর ‘মহাত্মা গান্ধী: দ্য লাস্ট ফেজ’ বইয়ে লিখেছেন: ‘একজন মা তাঁর মেয়ের জন্য যা কিছু করেন, তিনি (মোহনদাস) তাঁর (মানু) জন্য তা-ই করতেন। তিনি তাঁর পড়াশোনার খবর রাখতেন; খাবার, পোশাক, বিশ্রাম ও ঘুমের তদারক করতেন। ভালোভাবে দেখভালের জন্য তিনি তাঁর সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতেন।

একজন পরিণত নারী হিসেবে (যদিও সে নির্মল) মায়ের সঙ্গে ঘুমাতে সে লজ্জা বোধ করত না। ’ ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে মানু তাঁর (মোহনদাসের) দেহ মালিশ করে দিত, গোসল করিয়ে দিত এবং তাঁর জন্য রান্নাও করত। ’
মানুর ডায়েরিতে গান্ধীর অন্যান্য নারী সঙ্গীর প্রসঙ্গও এসেছে। তাঁদের অন্যতম ডাক্তার সুশীলা নায়ার। তিনি ছিলেন গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিত্সক এবং পিয়ারেলালের বোন।

পরে সুশীলা স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। আরেকজন নারী হলেন বিবি আমাতুসসালাম।
গান্ধীর কৌমার্যচর্চার অংশ কে হবেন, তা নিয়ে এই নারীকূলের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল তীব্র।
১৯৪৭ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মানু তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন: ‘আজ বাপু আমাতুসসালামকে খুব শক্ত ভাষায় এক চিঠিতে জানিয়েছেন, কৌমার্যচর্চার অংশ হতে না পেরে আমাতুসসালামের যে অনুতাপ হচ্ছে, তা তাঁর চিঠি থেকে স্পষ্ট বোঝা গেছে। ’
মানুর এসব ডায়েরি ২০১০ সালে জাতীয় সংগ্রহশালায় পাঠানো হয়েছে।

গান্ধীর কৌমার্যচর্চা নিয়ে দলের নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধের বিষয়টিও এসব ডায়েরি থেকে পরিষ্কার হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ৩১ জানুয়ারি বিহারের নবগ্রাম থেকে মানু লিখেছেন, গান্ধীর অনুসারী কিশোরীলাল মাসরুওয়ালা গান্ধীজিকে লেখা এক চিঠিতে মানুকে ‘মায়া’ (মায়াবি নারী) হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং গান্ধীজিকে এ থেকে মুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এর জবাবে গান্ধী কিশোরীলালকে লিখেছিলেন, ‘তোমার যা ইচ্ছে করো। কিন্তু আমি আমার পরীক্ষা নিয়ে নিঃশঙ্ক। ’
গান্ধীর কৌমার্যব্রত নিয়ে একই রকম আপত্তি করেছিলেন তাঁর সচিব আর পি পরশুরাম ও নির্মল কুমার বসু।

নির্মল বসু পরে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক সমাজের পরিচালক হয়েছিলেন। গান্ধী যখন মানুকে সঙ্গে নিয়ে নোয়াখালী আসেন, তখন এ দুজন গান্ধীর চর্চা নিয়ে তীব্র আপত্তি তোলেন। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। ১৯৪৭ সালের ২৫ জানুয়ারি লেখা এক চিঠিতে তিনি গান্ধীজিকে তাঁর এসব চর্চা পরিত্যাগ করতে বলেন। তিনি আরও বলেন, এসব চর্চা হলো ‘পুরোপুরি কেলেঙ্কারি’ এবং এতে গান্ধীর অনুসারীরা ‘যারপরনাই ব্যথিত’ হবেন।


গান্ধীর এ চর্চা মানুর ওপর কতখানি প্রভাব ফেলেছিল এবং এ জন্য দেশের বড় নেতারাও কতখানি উত্কণ্ঠিত ছিলেন, তার প্রমাণ মেলে মোরারজি দেশাইয়ের এক চিঠিতে। বোম্বে হাসপাতালে চিকিত্সাধীন মানুকে দেখে ফেরার পর ১৯৫৫ সালের ১৯ আগস্ট তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে লেখা চিঠিতে দেশাই বলেন, ‘মানুর সমস্যা যত না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক। জীবন নিয়ে তাঁর এক নৈরাশ্য তৈরি হয়েছে এবং কোনো ওষুধই তাঁর ওপর ক্রিয়া করছে না। ’
১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লিতে গান্ধীজি উগ্র হিন্দুত্ববাদী নথুরাম গডসের গুলিতে মারা যান। এ সময় তাঁর পাশে ছিলেন মানু।

অন্য পাশে ছিলেন আভা গান্ধী। গান্ধীর ভাতিজা কানুর স্ত্রী ছিলেন আভা। এর পরের দিন মানু লিখেছেন, ‘চিতার আগুন যখন বাপুর শরীরটা গিলে ফেলছিল, আমি নিশ্চুপ বসে ছিলাম আগুন না নেভা পর্যন্ত। সরদার প্যাটেল আমাকে সান্ত্বনা দিলেন; বাসায় নিয়ে গেলেন। আমি পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম।


মানু শেষ ডায়েরি লিখেছেন ১৯৪৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এদিন তিনি দিল্লি ছেড়ে চলে যান। তিনি লিখেছেন: ‘ডায়েরির কথা কাউকে বলতে নিষেধ করেছেন কাকা (গান্ধীর ছোট ছেলে দেবদাস) এবং গুরুত্বপূর্ণ চিঠিগুলো ফাঁস করতে বারণ করেছেন। তিনি বলেন, “তুমি এখনো ছোট, কিন্তু তোমার কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখালেখি থাকল। আর তুমি অনেক সহজ-সরল।

”’
মানু তাঁর ৬৮ পৃষ্ঠার স্মৃতিকথার কোথাও গান্ধীর যৌনাচার নিয়ে কথা বলেননি। গান্ধীর এসব আচরণে কেমন বোধ করেছিলেন, তাও তিনি কখনো বলে যাননি। ‘বাপু: মাই মাদার’ শিরোনামের বইটিতে তিনি লিখেছেন, কস্তুরবার মৃত্যুর ১০ মাস পর গান্ধীজি তাঁকে চিঠি লেখেন। সেটিতে তাঁকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বলেন তিনি। মানুর ভাষায়, সেদিন থেকে ‘বাপু তাঁর মা’ হয়ে গেছেন।

ছোটবেলায় মানু যে মাকে হারিয়েছিলেন, তাঁকেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন গান্ধীর মধ্যে।
জীবনের বাকিটা সময় মানু কাটিয়েছেন খুব নীরবে। গান্ধীর মৃত্যুর পর ২১ বছর তিনি গুজরাটের ভাবনগরের কাছে মাহুভায় থাকতেন। এ সময় তিনি শিশুদের একটি স্কুল চালাতেন। এ ছাড়া তিনি ‘ভগিনি সমাজ’ নামের একটি নারীসংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।

এ সময় তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী ছিলেন ভানু লাহিড়ী। ভানু জানিয়েছেন, মানু প্রায়ই তাঁকে নিজের অনুভূতির কথা বলতেন। মানু বলতেন, ‘নিজেকে আমার মিরাবাঈয়ের (মধ্যযুগের কৃষ্ণভক্ত এক বিখ্যাত নারী সন্ন্যাসিনী) মতো মনে হয়, যে কেবল শ্যামকে (কৃষ্ণ) ভালোবাসার জন্য জন্মেছিল। ’
মানুর ডায়েরিগুলো পর্যবেক্ষণ করে মনস্তাত্ত্বিক সুধীর কর লিখেছেন, ‘নিজের পরীক্ষা নিয়ে মহাত্মা এতটাই অনুরক্ত ছিলেন যে, এতে বাকি নারীদের ওপর কী প্রভাব পড়ছে, তা তিনি চেয়ে দেখেননি। কয়েকজন নারীর মধ্যে তীব্র রেষারেষি ছাড়া এসব পরীক্ষা নারীদের ওপর কোনো মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলেছিল কি না, তা আমরা জানতে পারি না।

’।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.