চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি ‘রাইট টু এডুকেশন’(RTE) আইন ২০০৯ : একটি পর্যালোচনা
আর টি ই বা রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট (শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯) ১লা এপ্রিল ২০১০ থেকে জম্বু ও কাশ্মীর ছাড়া ভারতের সমস্ত রাজ্যে এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে চালু হয়েছে। এই আইনের মূল বিষয়বস্তুগুলোর দিকে নজর দিয়ে আমরা এই আইনটি সংক্রান্ত কিছু আলোচনায় প্রবেশ করতে পারি।
এই আইন অনুযায়ী
• ৬ বছর থেকে ১৪ বছর বয়সি সমস্ত শিশু প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে বিদ্যালয় শিক্ষা (বুনিয়াদী শিক্ষা) পাবার অধিকারী। কোনো শিশুর কাছ থেকে এমন অর্থ কেউ নিতে বা দাবী করতে পারবেন না, যা দিতে না পারায় তার বুনিয়াদী শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাবে।
• শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুরাও অন্যান্য শিশুদের মত সমানভাবে বিনামূল্যে বুনিয়াদী শিক্ষা পাবে।
• বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ক্যাপিটেশন ফি (বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনুদান) নেওয়া যাবে না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
• বুনিয়াদী শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোন শিশুকে কোন শ্রেণিতে এক বছরের বেশি রাখা যাবে না এবং কোন কারণেই বিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া যাবে না।
• কোন বিদ্যালয়ে কোন শিশুকেই শারীরিক শাস্তি দেওয়া যাবে না বা তার ওপর মানসিক অত্যাচার করা যাবে না।
• কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, নবোদয় বিদ্যালয় এবং সৈনিক বিদ্যালয় ছাড়া সরকার দ্বারা স্থাপিত ও পরিচালিত সমস্ত বিদ্যালয়ে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী সমস্ত শিশুরা বিনামূল্যে বুনিয়াদী শিক্ষা পাবে।
• সরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলি তাদের প্রাপ্ত সরকারী সাহায্যের পরিমাণের অনুপাতে তাদের মোট ছাত্রসংখ্যার একটি নির্দিষ্ট অংশকে বিনামূল্যে বুনিয়াদী শিক্ষা দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু প্রাপ্ত সাহায্যের পরিমাণ যাই হোক না কেন, ঐ সমস্ত বিদ্যালয় তাদের মোট ছাত্রসংখ্যার কম করে ২৫ শতাংশকে বিনামূল্যে বুনিয়াদী শিক্ষা দেবে।
• বেসরকারী বিদ্যালয়, যারা কোনরকম সরকারী সাহায্য পায় না, প্রতি বছর প্রতি শ্রেণিতে মোট যে পরিমাণ ছাত্রছাত্রী ভর্তি করবে, কমপক্ষে তার ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীকে সমাজের দুর্বলতর বা পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে নেবে এবং ঐ ছাত্রছাত্রীদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা দেবে। ঐ ২৫ শতাংশ ছাত্রছাত্রীর সবাই আসবে ঐ বিদ্যালয়ের প্রতিবেশি এলাকা থেকে। একটি সরকারী বিদ্যালয়ে প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রীর জন্য যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়, সরকার সেই পরিমাণ অর্থ দুর্বলতর এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণি থেকে আসা প্রতিটি ছাত্রছাত্রী, যারা ঐ বেসরকারী বিদ্যালয়ে বুনিয়াদী শিক্ষা পাচ্ছে, তাদের জন্য বেসরকারী বিদ্যালয়কে প্রতি বছর দেবে।
• এই আইন চালু হবার তিন বছরের মধ্যে রাজ্য/স্থানীয় সরকার প্রতিটি জনবসতির এক কিমির মধ্যে একটি করে প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং তিন কিমির মধ্যে একটি করে উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করবে (যদি তা না থাকে)।
• এই আইন চালু হবার ছয় মাসের মধ্যে রাজ্য/স্থানীয় সরকার সমস্ত বিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ৩০ : ১ করবে। অর্থাৎ সমস্ত বিদ্যালয়ে ৩০ জন ছাত্রছাত্রী পিছু একজন করে শিক্ষক বা শিক্ষিকা থাকবেন।
• রাজ্য সরকার প্রতিটি এলাকায় নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করবে, প্রতিটি বিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো, শিক্ষক শিক্ষিকা এবং পড়াশুনোর জিনিসের ব্যবস্থা করবে। শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে রাজ্য সরকার।
• এই আইন প্রয়োগের জন্য অর্থের ব্যবস্থা করা কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের যৌথ দায়িত্ব। কেন্দ্রীয় সরকার নির্দিষ্ট সময় অন্তর রাজ্য সরকারের সাথে আলোচনা করে স্থির করবে যে মোট প্রয়োজনীয় অর্থের ঠিক কত অংশ কেন্দ্রীয় সরকার দেবে আর কত অংশ রাজ্য সরকার দেবে।
• বেসরকারী বিদ্যালয় ছাড়া প্রতিটি বিদ্যালয়কে বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি তৈরি করতে হবে। ঐ বিদ্যালয়ের শিক্ষক, এলাকার কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত সদস্য, এবং ঐ বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবক এই কমিটির সদস্য হবেন। পরিচালন সমিতির সদস্যদের অন্তত অর্ধেককে মহিলা হতে হবে।
অন্তত ৭৫ শতাংশ সদস্য হবেন ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকেরা।
• প্রতিটি বিদ্যালয় পরিচালন কমিটি ঐ বিদ্যালয়ের জন্য উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করবে। এই উন্নয়ন পরিকল্পনার ভিত্তিতেই রাজ্য সরকার এবং স্থানীয় সরকার ঐ বিদ্যালয়ের উন্নয়নের অর্থ বরাদ্দ করবে।
• প্রত্যেক শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়মমত এবং সময়মত বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে হবে, সময়মত নির্দিষ্ট পাঠক্রম পড়ানো শেষ করতে হবে, ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিতি, শিক্ষায় উন্নতি এবং অন্যান্য বিষয়ে তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করতে হবে, শিক্ষাদান ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে শিক্ষককে নিয়োগ করা যাবে না। (কেবলমাত্র সরকারি জনগণনা, নির্বাচনের কাজ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্যে শিক্ষকদের নিয়োগ করা যাবে)।
কোন শিক্ষক শিক্ষিকা প্রাইভেট টিউশন করতে পারবেন না।
• বাধ্যতামূলক বুনিয়াদী শিক্ষা শিশুর মৌলিক অধিকার। তাই এর প্রয়োগ না হলে বা অপপ্রয়োগ হলে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে সরাসরি জনস্বার্থ মামলা করা যাবে।
এই আইনের বহিরঙ্গে শিক্ষায় সরকারের দায়বদ্ধতার কথা থাকলেও বেশ কিছু মৌলিক প্রশ্নে এই আইনটি শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকদের অনেকের কাছে ভয়াবহ মনে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আসে শিক্ষার গুণমানের প্রসঙ্গটি।
এই আইনটি সর্বশিক্ষা অভিযানের ধারাবাহিকতাতেই সৃষ্ট আর ঘোষিতভাবেই এর লক্ষ্য কেবলমাত্র বুনিয়াদী শিক্ষা। এর মাধ্যমে মূলত সাক্ষরতা কর্মসূচীর দিকেই নজর দিতে চেয়েছে সরকার আর সেই বুনিয়াদী সাক্ষরতা শিক্ষাতেই মূলত নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখছে সে। সাক্ষরতা কর্মসূচীর বাইরে প্রচলিত সাধারণ বা বৃত্তিমুখী শিক্ষা থেকে সরকারী দায় সরিয়ে নিয়ে সে দায় পরোক্ষে বেসরকারী হাতে তুলে দেবার আয়োজনই এখানে নানা আলঙ্কারিক কথার আড়ালে তৈরি করা হয়েছে। এই আইনে পাশ ফেল প্রথা তুলে দেবার যে কথা রয়েছে, পছন্দের স্কুলে লটারির মাধ্যমে ভর্তির যে ভাগ্যভিত্তিক পদ্ধতির কথা উঠছে, তাতে সরকারী বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার মান নিয়ে ইতোমধ্যেই বিরক্ত অভিভাবকেরা বাধ্য হবেন আরো বেশি করে বেসরকারী বিদ্যালয়মুখী হতে। এই আইন সাক্ষরতা কর্মসূচীর ওপরের স্তরের সাধারণ শিক্ষাকে বেসরকারী ও পণ্যমুখী করে তুলবে, পুঁজিকে শিক্ষার মৃগয়াক্ষেত্রে আরও অবাধ বিচরণের জায়গা করে দেবে।
সরকার বেসরকারী বিদ্যালয়গুলিকে নজিরবিহীনভাবে এবার ২৫ শতাংশ পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীর জন্য ভরতুকি দানের যে নীতি নিয়েছেন, তা ইঙ্গিত দেয় আগামী দিনে সাধারণ শিক্ষার অঙ্গন থেকে সরে আসার রাস্তাই সে তৈরি করছে। রেশনিং ব্যবস্থাকে কার্যত বি পি এল স্তরে সীমাবদ্ধ রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় সব কিছুকে খোলাবাজারে নিয়ে আসা ও সে সূত্রে সেসব জিনিসের অগ্নিমূল্যের যে অভিজ্ঞতার সাক্ষী মানুষ, আগামী দিনে শিক্ষার ক্ষেত্রেও তাই হতে চলেছে। সাক্ষরতার, সর্বশিক্ষার যে দায়িত্ব সরকারের বহু আগেই পালন করার কথা ছিল (এই সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়টি ১৯৯৩ সালের), তার বহু বিলম্বিত আয়োজনের আছিলায় সরকার তার দায়কে শিক্ষার মূল অঙ্গন থেকেই সরিয়ে নিতে চাইছে। সাক্ষরতা/সর্বশিক্ষা নিয়ে ব্যাপক প্রচার এর আড়ালে সাধারণ শিক্ষার অঙ্গন থেকে তার দায়মুক্তির চেষ্টার দিকটি ক্রমশই সামনে আসছে।
আমাদের রাজ্যের সরকার কেন্দ্রীয় নির্দেশিকার আড়ালে এই বিষয়ে নিজেদের যাবতীয় সিদ্ধান্তহীন দোলাচলতাকে প্রতিদিন প্রকাশ করে চলেছেন, এক একবার একেকরকম নির্দেশিকা আসছে আর সেই সূত্রে ছাত্রভর্তি সহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিদ্যালয়গুলিতে ক্ষোভবিক্ষোভ, হাতাহাতি, শিক্ষকনিগ্রহর মত আরাজক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে।
আর প্রতিটি ঘটনাই সরকারী শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে আরো তলানিতে ঠেলে দিয়ে সরকারের মৌন উদ্দেশ্যকে ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।