আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিস্মৃত এক মশালবাহক- ইবনে খালদুন

নয়া যামানার নয়া পথিক,পথ হারিয়ে ছুটনা দিক্বিদিক জিব্রাল্টার প্রণালীর দক্ষিণ পাড়ের আফ্রিকার দেশটির নাম হলো মরক্কো। এ দেশের 'ফেজ' নগরী বোধ হয় আমাদের কাছে তার রাজধানী রাবাতের চাইতে বেশি পরিচিত। এর কারণ হলো 'ফেজ' টুপির দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। ৭৫৫ হিজরি মোতাবেক ১৩৫৫ খ্রিস্টাব্দে ফেজের উলামা পরিষদে যোগদান করেন একজন নতুন সদস্য। নাম তার ইবনে খালদুন।

তার আসল নাম ওয়ালি উদ্দিন আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মাদ। তিনি ১৩৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৭মে, ৭৩২ হিজরির ১লা রমজানে তিউনিসে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে উঠা সেখানেই,কিন্তু জীবনের পূর্ণতাপ্রাপ্তি হয় কখনো ফেজে,কখনো আন্দালুসিয়া তথা স্পেনে কখনো কায়রোয়। পুরো উত্তর আফ্রিকা চষে বেড়িয়েছেন তিনি। ইসলামি সংস্কৃতিকে ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভাজিত করা হলে ইবনে খালদুন সমৃদ্ধতম অংশ উত্তর আফ্রিকার ভাগে পড়েন।

প্রণালীর অপর পারের দেশ স্পেনকে এই সাংস্কৃতিক বিভাজনে উত্তর আফ্রিকার সাথে মিলিয়ে দেওয়া যায় কিনা সে মত দেবেন পণ্ডিতজনেরা। তার প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন শুরু হয় তার বাবার কাছ থেকে। তারপর স্থানীয় তিউনিসীয় আলেমদের কাছে বিদ্যার্জন করেন। আন্দালুসিয়া থেকে হিজরত করে অনেক গুণী পণ্ডিত,বিশেষজ্ঞ এসে তিউনিসে বসতি স্থাপন করেছিলেন। বালক ইবনে খালদুন এদের সংশ্রব লাভ করেন।

আঠারো বয়স পর্যন্ত তার শিক্ষার্জনের কাল চলে। এ সময়েই মিসর থেকে মৌরিতানিয়া পর্যন্ত সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় ভয়াবহ প্লেগ রোগ দেখা দেয়। ইবনে খালদুন নিজেই এর বর্ণনা করেছেন এভাবে-"কার্পেটের মধ্যে যা ছিল সবসুদ্ধই কার্পেটকে জড়িয়ে নিয়েছে এই মহামারী.......ইন্তেকাল করেছিলেন আমার আব্বা এবং আমার মা ও। " তখন তিনি হিজরত করে মৌরিতানিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তবে বড় ভাই নিষেধ করায় আর যাননি।

এরপর ডাক পেয়েছেন সুলতানের মোহররক্ষী হিসেবে কাজ করার জন্য, যখন তার বয়স বিশ বছরের নিচে। ইবনে খালদুনের পরের জীবনকে অস্থিতিশীল বললে দোষের কিছু হবে না। সোনার তরীর মাঝির মত এই প্রবন্ধে আমরাও একটু নির্মম হতে পারি। এখানে আমরা ব্যক্তি ইবনে খালদুনকে নয়, বিশ্বসভ্যতায় তার অবদানকে জানার প্রয়াস পাব। ইবনে খালদুন ছিলেন মূলত একজন ঐতিহাসিক।

তার ইতিহাস গ্রন্থের 'মুকাদ্দামা' তথা ভূমিকা তাকে কালজয়ী এক ঐতিহাসিকের আসনে সমাসীন করেছে। তিন মুকাদ্দামা রচনা করেছিলেন ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যভাগে মাত্র পাঁচ মাসের পরিশ্রমের। আমরা আজ এই মুকাদ্দামাকে আলাদা একটি গ্রন্থের মর্যাদা দেই। এ মুকাদ্দামায় ইবনে খালদুনসমাজবিজ্ঞান জ্ঞানের এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিলেন। ইবনে খালদুনের মতে ইতিহাস শুধু ঘটনার সমষ্টি নয় বরং এটি গবেষণার উপযোগী একটি বিজ্ঞান।

তিনি ইতিহাসের মাঝে দর্শনকে খুঁজে বের করেছেন। ইতিহাস বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেছেন সমাজতত্বে। এই বৈশিষ্ট্যের গুণে তিনি স্বতন্ত্র হয়েছেন পূর্ববর্তী ইতিহাস রচনাকারদের থেকে। ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে ইবনে খালদুন উদ্ভাবন করেছেন নতুন একটি পদ্ধতির। এই পদ্ধতির মৌল তত্ত্বগুলো পরবর্তীতে সমাজবিজ্ঞানের তত্ত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

তিনি তার মুকাদ্দিমায় দাবি করেছেন-"এতে নতুন ভিত্তির খোঁজ পাওয়া যাবে এবং এর বিষয় বস্তু আগ্রহোদ্দীপক। ....কোন সমাজকে বিশ্লেষণ করতে হলে তার যে অবস্থাসমূহ বৈশিষ্ট্যসহ চিহ্নিত,সময়ে সময়ে যে সব ঘটনা বা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে এবং যেসব অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার প্রশ্নই উঠে না। ; এই তিনিটি অবস্থাকে পৃথক করতে হবে। " আবার তিনি তার সমাজতত্ত্বের পাঠ পরিক্রমার শুরুতে রেখেছেন নৃতত্ত্বের আলোচনা যা আধুনিক সমাজবিজ্ঞানের অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক। ইবনে খালদুন সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সমাজ সম্পর্কে অধ্যয়ন ও গবেষণায় নিজেকে ব্যাপৃত করেছিলেন।

নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের আলোকে তিনি মানব সমাজ ও তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে একটি নতুন জ্ঞানে রূপদান করেছিলেন। তিনি সমাজকে যাযাবর জীবনযাত্রা থেকে নগর ও রাষ্ট্রের পত্তনের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের অবস্থা পর্যন্ত সকল পর্যায়ে ব্যবচ্ছেদ করে বিচার করার চেষ্টা করেছিলেন। এ গবেষণায় তিনি মানব সমাজের দৃঢ়তা ও দুর্বলতা, নতুন ও পুরাতন যুগ, উত্থান ও পতনের দিকে সমান নজর দিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সমাজের সুপরিসর ভিত্তির উপর ইতিহাসকে দাঁড় করিয়ে গেছেন যা তার পূর্ববর্তীরা করেন নি। ইবনে খালদুনের ধারণায় ব্যক্তি মানুষের অভ্যাস এবং তার পুনঃপুন ব্যাবহার মানসিক তৃপ্তি -সামাজিক স্তরে প্রথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ ধরণের প্রথা একত্রিত হয়ে সামাজিক প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। সমাজ ও সভ্যতার উদ্ভব, বিকাশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি একটি সাধারণ তত্ত্বের ধারণা দেন। অনুমান নির্ভর ধারণাকে বাদ দিয়ে পর্যবেক্ষণ ভিত্তিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে তিনি গুরুত্ব দেন। তার মতে, ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণই উপযুক্ত পদ্ধতি। তিনি সাম্রাজ্যের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কে পাঁচ ভাগে ভাগ করেন- ভূ-খণ্ড বিজয়, সাম্রাজ্য গঠন, সর্বোচ্চ স্তরে আরোহণ, শক্তি হ্রাস এবং পতন।

ইবনে খালদুনের ধারণায় একটি রাষ্ট্র এই পাঁচটি পর্যায়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। তার মতে মানুষ যেমন শৈশব,কৈশোর,যৌবন, বার্ধক্য,জরা ও মৃত্যুর মধ্যদিয়ে জীবন শেষ করে তেমনি রাষ্ট্রের জীবনেও শৈশব,কৈশোর,যৌবন,বার্ধক্য,জরা ও মৃত্যু প্রক্রিয়ার মধ্যে অতিবাহিত হয়। 'মুক্কাদিমার দ্বিতীয় অংশে যাযাবর সমাজের স্থায়িত্ব ও শহুরে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর স্থায়িত্ব এবং শহুরে সমাজের সাথে যাযাবর সমাজের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। এখানেই আমরা ইবনে খালদুন প্রদত্ত নতুন মতবাদ সম্পর্কে অবগত হওয়ার সুযোগ লাভ করি। তিনি এখানে তার কথায়"আল আসাবিয়াহ" তথা রাষ্ট্র বা বংশের স্থায়িত্বকাল সম্পর্কে বক্তব্য রেখেছেন।

তাছাড়া এই অধ্যায়ে তিনি পরিবার ও অনুরূপ কোন সংস্থার উপর ভিত্তি করে পারিবারিক ও উপজাতীয় শক্তি ও প্রভাব গড়ে উঠেছে বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। ইবনে খালদুন সমাজকে দু'ভাগে ভাগ করেছিলেন, শহুরে সমাজ ও যাযাবর সমাজ। এ দু'সমাজের মধ্যকার দ্বন্ধ ও বিরোধকে তিনি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে উপজাতীয় সমাজের সদস্যরা মরুভূমি এলাকা ত্যাগ করে উর্বর ভূমিতে বসতি স্থাপন করে। প্রয়োজনের তাগিদে যাযাবর সম্প্রদায় নগর জয় করে এবং প্রতিষ্ঠিত সভ্যতাকে গ্রহণ করে।

ইবনে খালদুন এমন এক যুগে জন্মেছিলেন যে যুগে ইসলামের শক্তি ও আধিপত্যে ভাঙ্গন শুরু হয়েছিল। ইসলামি চিন্তা ধারা হয়ে পড়েছিল অনাহুত, অবহেলিত। এজন্যে ইবনে খালদুনের রচনাবলী সাধারণের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। পাশ্চাত্যে ইবনে খালদুন পরিচিত হন ১৬৯৭ সালে। এর প্রায় শতাব্দী পরে ১৮০৬ সালে ফরাসী প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ স্যাল ভেল্টার দ্য সাকি মুকাদ্দামার কয়েকটি পরিচ্ছেদ অনুবাদ সহ তার জীবনী ছাপেন।

এরপর একজন অস্ট্রীয় প্রাচ্য বিশেষজ্ঞ ভন হ্যামার পার্গস্টল (Von Hammer Purgstall: Thar Hunderten der Hidschort) ইসলামি শক্তির পতন সম্পর্কে ১৮১২ সালে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। এ পুস্তকে লেখক ইবনে খালদুনের রাষ্ট্রের পতন সম্পর্কীয় মতবাদ উল্লেখ করে তাকে 'আরবীয় মন্টেস্কু' বলে অভিহিত করেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপের গবেষকদের কাছে ইবনে খালদুন পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করেন। এবার পাশ্চাত্য জানতে পারল ইসলামের ক্ষয়িঞ্চু সভ্যতার এই মহান গুণী সম্পর্কে; কারণ তিনি ইতিহাস রচনা করতে গিয়ে এমন সব অর্থনৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন যা পাশ্চাত্য জানতে পেরেছিল আরও কয়েক শতাব্দী পরে। তারা দেখতে পান ইবনে খালদুনের তত্ত্বগুলোই আলোচিত হয়েছে তার এক শতাব্দী পরে ম্যাকিয়ভেলির(১৪৬৯-১৫২৭) রচনায় এবং আরো তিন চার শতক পরের ভিকো(১৬৬৮-১৭৪৪),মন্টেস্কু (১৬৬৯-১৭৫৫),এ্যডাম স্মিথ(১৭২৩-১৭৯০), অগাস্ট ক্যোঁৎ (১৭৯৮-১৮৫৭) প্রমুখের রচনায়।

প্রথমে মনে করা হত পাশ্চাত্যের গবেষকরাই এ সব তত্ত্বগুলোর আবিষ্কর্তা। কিন্তু পরে গবেষণায় গেল গামবাতিস্তা ভিকোর পূর্বেই আরবীয় পণ্ডিত ইবনে খালদুন ইতিহাসের দর্শন ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ভিকো নব বিজ্ঞান বা The new science বলে যে দাবি করেছেন তা আসলে উত্তর আফ্রিকার সেই রাজকর্মচারীর মাথায় ঢুকেছিল অনেক আগেই। অগাস্ট ক্যোঁৎ Sociology নামে একটি শব্দ পাশ্চাত্যের অভিধানে সংযোজন করেন। কিন্তু তার পাঁচ শতাব্দী আগে প্রাচ্যের অভিধানে তা শোভা বর্ধন করেছিল।

'আল উমরান' নামে একটি পরিভাষা। ইবনে খালদুন তার মতবাদসমূহ শুধু উপস্থাপন করেই ক্ষান্ত হননি, যুক্তিতর্কের মাধ্যমে সেসবকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। জার্মানির স্টুটগার্ট শহর থেকে ১৯০১ সালে T.J de Boer একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন যার নাম 'Gesehicher Der philosophie in Islam' বইটিতে তিনি আরো তিনি লিখেছেন," কতিপয় কারণ ও পরিস্থিতির আলোকে সমাজের অগ্রগতি ও উত্তরণ ব্যাখ্যায় ইবনে খালদুন নিঃসন্দেহে প্রথম। তিনিই প্রথম ইতিহাস রচনাকালে বর্ণ, গোত্র, আবহাওয়া, উৎপাদনের অবস্থা ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন এবং মানুষের মনন ও ভাবপ্রবণতা গঠন,এমনকি সমাজ গঠনে পরিবেশের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছেন। ইবনে খালদুন সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশ করে দ্য বোয়ের উপসংহারে বলেছেনঃ গবেষণার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে পরবর্তীকালে অন্য কেউ গবেষণা শুরু করুক, ইবনে খালদুনের সে ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে, তবে মুসলমানদের দ্বারা তা সম্ভব হয়নি।

কোন পূর্ববর্তী মনিষীকে অনুসরণ না করেই যে প্রতিভাটির আবির্ভাব ঘটেছিল, সে প্রতিভাকে অনুসরণ করতে মুসলিম সমাজে কেউ এগিয়ে আসে নি। অধ্যাপক লুডউইগ গুমপ্লায়িজ বলেন যে, ইবনে খালদুন কোন পরিবারের উত্থান-পতন সম্পর্কে 'তিন বংশ স্তরের' যে ধারণা দেন তা এখন অটোকার লরেঞ্জের কৃতিত্বের ভাণ্ডারে। অথচ লরেঞ্জের অনেক আগেই আরব দার্শনিক এই তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। হায়কলের তত্ত্ব যে প্রকৃতি পশুকুলকে কার্যকরীঃ এটিও ইবনে খালদুন বর্ণনা করেছিলেন। বিস্ময়কর ব্যাপার ইবনে খালদুন সমর বিজ্ঞানের যেসব রীতি পদ্ধতি আলোচনা করেছিলেন ইউরোপীয়দের উত্থানের পুরো যুগে তাদের সেনাপতিরা সেসব রণকৌশল প্রয়োগ করেছেন।

এছাড়া ম্যাকিয়াভেলি শাসকদের যেসব উপদেশ দিয়েছিলেন শতবর্ষ আগে ইবনে খালদুনও তা-ই লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। অথচ তা কেউ জানত না। গ্রমপ্লায়িজ তার উপসংহারে বলেন-"আমি দেখাতে চাচ্ছি'শুধু অগাস্ট কোঁতেরই বহু বছর আগে নয় বরং ইতালীয়গণ যে ভিকোকে জোরজবরদস্তি করে প্রথম সমাজতত্ত্ববিদদের আসনে বসাবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছেন,তারও বহু বছর আগে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান সাফল্যের সাথে সমাজতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করেছেন, এবং এ বিষয়ে নিজের মতবাদ প্রকাশ করে গেছেন। তিনি যা লিখে গেছেন আজ সেটাই আমরা সমাজতত্ত্ব বলে মনে করি। " এতসব তথ্য উপাত্ত প্রদান করার পর আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি ইবনে খালদুনই প্রথম ব্যক্তি যিনি সমাজবিজ্ঞান নামে একটি নতুন প্রত্যয় উদ্ভাবন করেছেন এবং তিনিই সমাজবিজ্ঞানের জনক।

কিন্তু ইবনে খালদুনের জ্ঞান কি আমরা মুসলমানেরা কাজে লাগাতে পেরেছি কখনো? 'দি প্রিন্স' কে অবলম্বন করে যদি খ্রিস্টানরা তাদের সাম্রাজ্য গুছিয়ে নিতে পারে তাহলে তারও শতাব্দীকাল আগে পাওয়া জ্ঞানকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি! এ জবাব দেবে কে? আমাদের মুসলমানদের সবচাইতে বড় ব্যর্থতা যা দেখিয়ে দিয়েছেন দ্যা বোয়ের যে, আমরা মুসলমানেরা ইবনে খালদুনের মতাদর্শের যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারিনি। পারিনি তার আবিষ্কারকে বিশ্বমানুষের দরবারে কাছে তুলে ধরতে। শুধু একজন ইবনে খালদুনই কি এমন অন্যায়ের শিকার হয়েছেন? যুগে যুগে আমাদের জ্ঞানভাণ্ডার শত্রুরা ধ্বংস করে দিয়েছে। সেটা তাতার আক্রমণ হোক কিংবা স্পেনের গল্প হোক অথবা সেদিনের বাগদাদ সবক্ষেত্রেই আমরা আমাদের সামনেই আমাদের শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অর্জনগুলোর নির্মম মৃত্যু হতে দেখি। দুর্ভাগ্য আমাদের ইবনে খালদুনের।

সব যুগেই আমাদের ইবনে খালদুনরা এমন নির্মমতার শিকার হয়েছেন। আমাদেরকে যখন বলা হয় আরবীয় মন্টেস্কু, অথচ বলা উচিৎ ছিল ইউরোপীয় ইবনে খালদুন। আমারা মুসলমানরা না বুঝে মেগনা কার্টারের সাথে আমাদের মদিনা সনদকে তুলনা করে মেগনা কার্টারকে একটা মানদণ্ডে তুলে দিচ্ছি। আমারা আজ নিজেদের অজান্তে নিজের গৌরবের মুকুট আরেকজনের মাথায় পরিয়ে দিচ্ছি অহরহ। অমূল্য সম্পদ আগেভাগে পেয়েও আমরা তার কদর করি না।

পরে আরেকজন খুঁজে বের করে আনলে আমাদের কেউ কেউ বলে উঠে আরে এটা তো আমাদের ঘরে অনেক আগে থেকেই পড়ে আছে, এটার বুঝি এত দাম!! কিন্তু ততক্ষণে আমাদের তটরেখায় সূর্য অস্তায়মান। উই আর সরি টু ইসলাম। উই আর সরি টু আল আওয়ার হিরোজ অব সিভিলাইজেশন। পাশ্চাত্যের শক্তি সে নয় রোবাব অথবা বেহালাতে, নাই সে শক্তি পর্দাবিহীন নারীর নৃত্য জলসাতে, নাই সে শক্তি পুষ্পমুখী ও যাদুকরীদের মায়াজালে, নাই অভিনব কেশ-কর্তনে,নগ্ন উরুর তালে তালে, নাই সে শক্তি নাস্তিকতায়-ধর্মবিহীন মতামতে নাই সে শক্তি লাতিন হরফে-প্রাচীন লিপির শরাফতে, জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প থেকে সে পেয়েছে বিশ্বে বিপুল বল, এ আগুন থেকে চিরাগ যে তার হ'ল রওশন-সমুজ্জ্বল। নাই হিকমত পোশকের ছাটে, পাবে না জামার বদৌলতে; প্রতিবন্ধক নয় জেনো কভু পাগড়ি আমামা জ্ঞানের পথে।

(ইকবাল)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।