গণমানুষের চেতনার ধারক ও বাহক
ফ কি র ই লি য়া স
========================================
জানতে চাইলাম, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমাদের নির্মূল কমিটিতে কে সমন্বয় করবেন? মা বললেন, আবদুর রাজ্জাক। মা, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের জবাবে আশ্বস্ত হই। ১৯৯২ সালের সেই উত্তাল দিনগুলো। জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছে। আমাদের তখন রাজনৈতিক সমর্থন দরকার।
বিদেশে আমরা অনেকেই উৎকণ্ঠিত। কী হবে, কী হতে যাচ্ছে। গণ-আদালতের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করে জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। জামায়াতের সাবেক আমীর প্রফেসর গোলাম আযমের বিচারের লক্ষ্যে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১৯৯২ সালে গঠন করা হয় গণ-আদালত। এ তদন্ত কমিশন বর্তমানে কারাবন্দি মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ মোট ১৬ জনের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্ত করে।
গণতদন্ত কমিশনের মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ৪০। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে তদন্ত কমিশন তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করে।
১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্রথম দফায় কমিশন আটজনকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তারা হলেন- আব্বাস আলী খান, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল আলীম (বর্তমানে জামিনে মুক্ত), মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা আবদুল মান্নান, আনোয়ার জাহিদ এবং আবদুল কাদের মোল্লা। ১৯৯৫ সালের ২৬ মার্চ কমিশন তাদের দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
এখানে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত করা হয় তারা হলেনÑ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মাওলানা একেএম ইউসুফ, মাওলানা আবদুস সোবহান, এএসএম সোলায়মান, মোহাম্মদ আয়েন উদ্দিন, এবিএম খালেক মজুমদার এবং ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন।
এর কিছুদিন পরই নিউইয়র্ক সফরে আসেন জননেতা আবদুর রাজ্জাক। তার সঙ্গে কথা হয় নানা বিষয়ে। তিনি জানান, ঘাতক দালালদের বিচার বাংলার মাটিতে হবেই। বললাম, কবে হবে, কিভাবে হবে লিডার! হেসে দিলেন।
বললেন, এই বাঙালি জাতি শত নিষ্পেষণ উজিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। এই রাজাকারদের বিচারও করবে। তরুণ প্রজন্ম একদিন ঘুরে দাঁড়াবেই। তার কথায় অঙ্গীকার ছিল। আশা ছিল।
তিনি প্রজন্মকে আশাবাদী হওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। যেমনটি দেখাতেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
তার রাজনীতির শুরু সেই পঞ্চাশের দশকে। ছাত্ররাজনীতি দিয়েই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। এরপর পেরিয়ে গেছে সুদীর্ঘ সময়।
পদ্মা-মেঘনায় গড়িয়ে যাওয়া জলের মতোই অন্তহীন ছুটে চলা জীবনে তিনি থেকেছেন রাজপথের লড়াকু সৈনিক। দেশমাতৃকার জন্য জীবনবাজি রেখে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ করেছেন। আবার কখনও কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে জীবনযাপন করেছেন। বাঁধাধরা জীবনের সব আগল ছিন্ন করা মুখরিত রাজনৈতিক জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন মানুষের জন্য।
মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আবদুর রাজ্জাক আজীবন সংগ্রাম করেছেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে।
মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তার কণ্ঠ ছিল সদা সোচ্চার। অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুম তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবনবাজি রাখা সংগ্রামী নেতা আবদুর রাজ্জাক নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতার পর সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে। সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামে। ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবদুর রাজ্জাক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অন্যতম রূপকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষক আবদুর রাজ্জাক, ভারতের মেঘালয়ে মুজিব বাহিনীর ৪ সেক্টর কমান্ডারের একজন ছিলেন তিনি।
জাতির জনক তাকে ডাকতেন ‘আমার রাজ্জাক’।
আবদুর রাজ্জাক মহান মুক্তি সংগ্রামের ‘নিউক্লিয়াস’ শক্তির অন্যতম পুরোধা; তা ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে। আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে একই ফোরামে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ যুক্তরাষ্ট্র শাখার আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সহকারী সদস্য সচিব। আবদুর রাজ্জাক ছিলেন এ কমিটির অন্যতম সমন্বয়কারী। তিনি সব সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সঙ্গে পাশাপাশি ছিলেন ছায়ার মতো। আওয়ামী লীগ দলটির পক্ষে আবদুর রাজ্জাক ছিলেন জাতীয় সমন্বয় কমিটির অন্যতম প্রবক্তা ও প্রতিনিধি। তিনি যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসে প্রবাসীদের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেছিলেন।
তার অমিত তেজ ও সাহসী বক্তব্য হাজারও তরুণকে সেদিন শাণিত ও অনুপ্রাণিত করেছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠক সেদিন অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত করার ডাক দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি তিনি কত সৎ, কত মহৎ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে মন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ছিলেন অত্যন্ত সোচ্চার। জাতীয় সমন্বয় কমিটিতে তার কর্মপরিধির কোন ব্যত্যয় ছিল না মন্ত্রী হওয়ার পরও।
খুবই দুঃখের কথা, বর্তমান সরকারের বেশ ক’জন মন্ত্রী লন্ডন সফরে গেলেও অসুস্থ আবদুর রাজ্জাককে দেখতে যাননি। তার খোঁজখবর নেননি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দেখতে গিয়েছিলেন। অবশ্য তা মন্ত্রী হওয়ার আগেই।
বাংলাদেশে অনেক ত্যাগী নেতা আছেন, যারা নিজ নিজ দলে অক্ষম।
আবদুর রাজ্জাক শেষ জীবনে তেমনি একটি পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। কেন হয়েছিলেন? তাদের অক্ষমতা গোটা জাতির জন্য পীড়াদায়ক। তারা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের কাছে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার পরও নিজ নিজ দলের সাবেক আমলা রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, কালো টাকার মালিক রাজনীতিকদের কাছে চরমভাবে পরাজিত। তস্করবৃত্তি এবং কালো টাকার দাপটই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশে রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। পুনর্বাসিত হচ্ছে কালো শক্তি।
ত্যাগী নেতাকর্মীরা মুখ লুকাচ্ছেন লজ্জায়। সে লজ্জা আমাদের দিকে ছুড়ে দিয়েই চির বিদায় নিয়েছেন জননেতা আবদুর রাজ্জাক।
কোন সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে মেধাবৃত্তিক রাজনীতির গলা টিপে ধরার নজির নেই। তাহলে বদলের মানসিকতায় বাংলাদেশ এগোচ্ছে না কেন, ভাবা দরকার। প্রজন্মকে দাঁড়ানো দরকার সত্যের অন্বেষণে।
আবদুর রাজ্জাক বেশ অভিমান নিয়েই চলে গেলেন। কিন্তু তার চেতনা আছে আমাদের পাশে সতত। তিনি বজ্র মুষ্ঠি উঁচু করে বলেছিলেন- প্রজন্মের জয় হবেই। তার সেই শাণিত মনন আমাদের ধারণ করতে হবে। ভোগ নয়, ত্যাগের আদর্শে বলীয়ান হতে হবে তার মতোই।
তার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক।
নিউইয়র্ক / ২৪ ডিসেম্বর ২০১১
===========================================
দৈনিক যুগান্তর / ঢাকা / ২৫ ডিসেম্বর ২০১১ রোববার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।