আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ট্রানজিটের পয়লা মাশুল :: তিতাস একটি খুন হয়ে যাওয়া নদীর নাম!

নিজ চোখেই দেখে এলাম নদীর উপর দিয়ে অভিনব ডিজিটাল রাস্তা। এখন থেকে নদীর উপর ব্রিজ আর খালের উপর কালভার্ট নির্মাণের কোন দরকার নেই। পদ্মা সেতু’র আলাপ বাদ। কারণ সহজ বুদ্ধি পাওয়া গেছে- নদী কিংবা খালের উপর ইট, বালু, সিমেন্টের বস্তা ফেলে পানি চলাচলের জন্য নীচে কয়েকটা কংক্রীটের পাইপ বসিয়ে দিলেই হলো, কয়েকশো টনি লরি চলাচল শুরু করে দেয়া যায়। তাতে নদীর স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বাধা পেলে, স্রোত থেমে গেলে, দুই পাশের পানির উচ্চতার তারতম্য হলে অথবা মৎস কিংবা নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে কিছু যায় আসে না বরং “বন্ধুত্ব” রক্ষা হয়।

এইভাবেই আশুগঞ্জ থেকে আখাউরা পর্যন্ত রাস্তার নির্মিত সেতু ও কালভার্টের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী ও তার খালগুলোর উপর দিয়ে বাইপাস রাস্তা তৈরী করে আগ্রাসী প্রতিবেশী ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছে বাংলাদেশ। অথচ নদীর বুকের উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হলে, যতই রাস্তার নীচ দিয়ে কংক্রীটের পাইপ বসানো হউক, নদী আর “একটি নদী” থাকেনা, “দুইটি খাল” হয়ে যায়, নদী মরে যায়, খাল মরে যায়। এমনিতেই আধমরা তিতাস এই রাস্তাগুলোর ফাঁসে তার খালগুলোসহ একেবারে খুন হয়ে গেছে। অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রিয় তিতাস এখন একটি খুন হয়ে যাওয়া নদীর নাম, ভারতকে ট্রানজিট দিতে গিয়ে বাংলাদেশের নতজানু শাসকশ্রেণী তাকে খুন করেছে। দুনিয়ার আর কোন দেশের শাসক শ্রেণী এইভাবে নিজ দেশের নদী-খালের মাঝখান দিয়ে বাধ নির্মাণ করে আরেক দেশের মালামাল পরিবহনের ব্যবস্থা করেছে বলে আমাদের জানা নাই, যেটা বাংলাদেশের নতজানু শাসকশ্রেণী ভারতের মালামাল পরিবহনের জন্য করেছে তিতাস হত্যার ইতিবৃত্ত ভারতের ত্রিপুরার পালাটানায় ৭২৬ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রয়োজনীয় ভারী যন্ত্রপাতি ৯৬টি ওভার ডাইমেন্সনাল কার্গো’র (ওডিসি) মাধ্যমে পরিবহনের জন্য ৩০ নভেম্বর ২০১০ এ ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

সমঝোতা অনুসারে অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন প্রটোকল, ১৯৭২ অনুসারে কোন ধরণের ট্রানজিট ফি ছাড়াই কনটেইনার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রায় মঙ্গল থেকে নদী পথে সাতক্ষীরা হয়ে আশুগঞ্জ নদী বন্দরে আসবে এবং তার পর আশুগঞ্জ থেকে সড়ক পথে আখাউরা স্থলবন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় যাবে। কিন্তু আশুগঞ্জ বন্দর আর আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া সড়ক পথ ওডিসি পরিবহনের অনুপযুক্ত হওয়ায় বন্দর উন্নয়ন, ৪৯ কিমি রাস্তা মেরামত ও ১৮ মিটার পর্যন্ত প্রশস্ত করার জন্য ভারত এককালীন ২৫.৫০ কোটি টাকা প্রদান করবে বলে ঠিক হয়। সূত্র: Click This Link কিন্তু শুধু রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করলেই ৩২৫ টন ওজনের ওডিসি পরবহনে সক্ষম ১২০ ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল লরি চলাচল সম্ভব ছিল না ঐ পথে, কারণ এই রাস্তায় তিতাস নদী ও বিভিন্ন খালের উপর যেসব ব্রীজ ও কালভার্ট রয়েছে সেগুলো এত ভারী কার্গোর ভার বহনের সক্ষম নয় (সর্বোচ্চ ভারবহন ক্ষমতা ১৫ টন)। তাই রাস্তা মেরামত ও প্রশস্ত করণের পাশাপাশি ভারতের আসাম বেঙ্গল কেরিয়ার বা এবিসি ইন্ডিয়াকে দ্বায়িত্ব দেয়া হলো ব্রীজ ও কালভার্টগুলোর পাশ দিয়ে “বিকল্প রাস্তা” তৈরী করার। এবিসি তাদের বাংলাদেশী সাবকন্ট্রক্টর গালফ ওরিয়েন্ট সিওয়েজ এর মাধ্যমে ব্রীজ ও কালভার্টের নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া তিতাস নদী ও তার খালগুলোর মধ্য দিয়েই বালু ও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে রাস্তা তৈরী করে।

পানির প্রবাহ ঠিক রাখার জন্য রাস্তার নীচ দিয়ে কংক্রীটের পাইপ বসানো হয়। কংক্রীটের পাইপ গুলোর ব্যাস ৩ ফুট। কিন্তু নদী/খালের মধ্যে দিয়ে বানানো রাস্তার নীচে ৩ ফুট ব্যাসের কয়েকটি কংক্রীটের পাইপ কখনও নদী/খালের স্বাভাবিক চ্যানেলের বিকল্প হতে পারেনা। এটা অনেকটা সুইয়ের ফুটো দিয়ে কম্বল গলানোর চেষ্টার মতো অসম্ভব একটা ব্যাপার। তাছাড়া পলি ও আবর্জনা জমে কংক্রীটের পাইপের মধ্যে দিয়ে যতটুকু পানি প্রবাহ সম্ভব ছিল তাও একসময় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

আমরা ঘাটুরা খাল, দক্ষিণ পইরতলা, রামরাইল, সুলতানপুর কিংবা কড্ডা সেতু/কালভার্টের মতো সবখানেই এই বাস্তবতাই প্রত্যক্ষ করেছি। ফলে স্বাভাবিক সময়েই নদী/খালের মধ্যদিয়ে যাওয়া পথের দুই পাশে পানির উচ্চতার তারতম্য তৈরি হয়। আর বর্ষাকালে বাড়তি পানি প্রবাহ একপাশে আটকে থাকার কারণে আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের বিভিন্ন স্থানের কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়, চাষাবাদেও ব্যাঘাত ঘটে। শুধু তাই না, গত আগস্টে ত্রিপুরার পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢল ও বাড়তি বৃষ্টিপাতের পানি আখাউড়া স্থলবন্দর সড়কের আবদুল্লাহপুর ও নূরপুর জাজি সেতুর নিচের বিকল্প পথে আটকে যায়। এতে উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের আবদুল্লাহপুর, কালিকাপুর, বীরচন্দ্রপুর ও বঙ্গেরচর গ্রামের অনেক বাসিন্দা পানিবন্দী হয়ে পড়ে।

সুত্র: Click This Link পানি চলাচলের রাস্তার কয়েকটি সরু কংক্রীট ফলে একদিকে রাস্তার একপাশে তৈরী হয় জলাবদ্ধতা ও অন্যপাশে পানি সংকট এবং অন্যদিকে রাস্তাগুলোও দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় যে কারণে এমনকি দেশীয় ট্রাক পরিবহণ বন্ধ করে হলেও ১৫টন ভার বহনে সক্ষম এই সেতুগুলোর উপর দিয়ে ওডিসি সহ ভারী লরিও পরিবহন করা হয়েছে! সূত্র: Click This Link ভাগ্যহীন “ভাগ্যলক্ষী” আখাউড়া পৌরসভা এলাকায় ঢোকার ঠিক আগে কড্ডা নামক স্থানে তিতাস নদীর উপর একটি সড়ক সেতু ও একটি রেল সেতু রয়েছে। এই দুইটি সেতুর ঠিক মাঝখান দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে তিতাস নদীকে দ্বিখন্ডি করা হয়েছে। রাস্তার নীচে পানি চলাচলের জন্য কতগুলো কংক্রীটের পাইপ বসানো হলেও এর দুই পাশের মধ্যে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক হয়নি। গত বর্ষাকালে হঠাৎ ঢল এলে কংক্রীটের পাইপগুলো দিয়ে পানি দ্রুত রাস্তার একপাশ থেকে আরেক পাশে প্রবাহিত হতে না পারার কারণে দুইপাশের মধ্যে পানির উচ্চতার পার্থক্য হয়েছিল কয়েক ফুট। অর্থাৎ একপাশে জলাবদ্ধতা আর আরেকপাশে সেচের জলের অভাব।

এই শুকনা মৌসুমে আমরা দেখেছি এমনিতেই আধমরা তিতাস নদী এইখানটায় রাস্তার একপাশে তুলনামূলক সজীব আর অপর পাশে ক্রমশ মরে যাচ্ছে। আমরা জানলাম, ভাটির অংশের জেলেরা মাছ তুলনামূলক কম পাচ্ছেন উজানের অংশের জেলেদের চেয়ে, কারণ মাছ আর যাই হোক কংক্রীটের অপেক্ষকৃত সরু পাইপ দিয়ে সহজে চলাচল করেনা। এমনকি উজানের অংশের জেলেরাও আগের মৌসুমের তুলনায় এই মৌসুমে মাছ কম পেয়েছেন- এক জেলে জানালেন, আগের মৌসুমে এই সময়ের মধ্যে তিনি ৩ লাখ টাকার মাছ আহরণ করলেও, এই মৌসুমে এখনও পর্যন্ত ৩০ হাজার টাকার মাছও পাননি। মাছের মতো নৌকারাও কংক্রীটের পাইপের ৩ ফুট ব্যাসের মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে পারেনা! ফলে একদিকে রাস্তার একপাশের জেলেরা যেমন মাছ মারতে মারতে অন্য পাশে যেতে পারে না তেমনি, নৌকায় করে বড় বাজার থেকে গঞ্জের ছোট ছোট বাজারে মালামাল পরিবহনের যে সুবিধা ছিল, সেটাও নদীর উপর দিয়ে নির্মিত এই রাস্তার কারণে সম্ভব হচ্ছে না। নৌকায় রাস্তার একপাশ পর্যন্ত মালামাল এনে তারপর রিকশা-ভ্যান-ট্রাক্টরে করে বাড়তি খরচ ও ঝক্কি সামলে মালামাল বাজারে পরিবহন করতে হচ্ছে।

আমরা নিজ চোখেই দেখতে পাই এলাকার ‘ভাগ্যহীন’ মানুষগুলোর প্রতীক হিসেবে যেন রাস্তার একপাশে নোঙর করে রাখা আছে “ভাগ্যলক্ষী” নামের এই নৌকাটিকে, যে নৌকাটির নদীর মাছের মতই আর ঐ পাশে যাওয়ার কোন উপায় নেই! ট্রানজিটের প্রকৃত মাশুলের নমুনা ট্রানজিট নিয়ে বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী যতই খোয়াব দেখাক, যতই মাশুল কিংবা ফি’র নাটক করুক, ভারতের জন্য উপকারী হলেও ট্রানজিটের ফলে বাংলাদেশের পরিবেশ ও অর্থনীতি’কে যে ব্যাপক মাশুল গুণতে হবে, তার আগাম লক্ষণ দেখা গেল আশুগঞ্জ-আখাউড়া পথে ট্রানজিট দিতে গিয়ে নদী হত্যা, কৃষি জমি ধ্বংস, কৃষিকাজ, মৎস চাষ সহ গোটা এলাকার জনগণের জীবন ও পরিবেশ ধ্বংসের ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমরা দেখলাম, ভারতের শাসক শ্রেণী এবং বিভিন্ন ভারতীয় ও বাংলাদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার্থে দেশের জনজীবন ও পরিবেশের ক্ষতির নুন্যতম তোয়াক্কা করল না বাংলাদেশের শাসকশ্রেণী। আশুগঞ্জ বন্দর ভারী মালামাল পরিবহনের জন্য তৈরী নয়, রাস্তাঘাট-ব্রীজ-কালভার্ট ভারী যানবাহন পরিবহনে সক্ষম নয়, স্থল বন্দরেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নেই, ট্রানজিটের লাভ-ক্ষতির হিসেবে কষা হয়নি, পরিবেশগত সমীক্ষা হয়নি- তারপরও এখনই ভারতকে ট্রানজিট দিতে হবে। ভারতের স্বার্থ রক্ষায় অতি আগ্রহ এবং বিপরীতে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের প্রতি অবহেলার এই উদাহরণ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর জন্য নতুন নয়, ট্রানজিটের শুরুতেই তিতাস নদী হত্যার মধ্য দিয়ে তার নিদর্শন দেখা গেল, ট্রানজিট পুরোদমে চালু হলে যা আরো বেশি মাত্রায় দেখা যাবে- কৃষিজমি-নদী-খাল ধ্বংস করে ট্রানজিটের প্রয়োজনীয় রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও প্রশস্ত করা হবে, বাংলাদেশের নিজস্ব যানচলাচল বন্ধ রেখে ভারতীয় যান চলাচলের সুযোগ করে দেয়া হবে, বন্দরে আমাদের নিজস্ব মালামাল উঠানামা বন্ধ রেখে ভারতীয় মালামাল উঠানামার সুযোগ করে দেয়া হবে, ভর্তুকী মুল্যে ভারতীয় যানবাহনের জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে, বাড়তি তেলের বাড়তি ভর্তুকীর দায় আবার জনগণের উপরে চাপানো হবে, বন্ধুত্বের নিদর্শন রাখতে ট্রানজিটের সড়ক ও রেলপথ সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণে বাড়তি অর্থ খরচ করা হবে যখন দেশের জনগণের নিজস্ব চলাচল ও পরিবহনের প্রয়োজনীয় সড়ক ও রেলপথ উন্নয়ণ ও সম্প্রসারণের কোন খবর থাকে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.