এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় by অপ্রিয় যত সত্য সহ্য করার ক্ষমতা আছে কি ?
ট্রানজিট। আসলে ট্রানজিট কি ??
ট্রানজিট বলতে বুঝায় এক দেশ থেকে দ্বিতীয় দেশের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে যাওয়া।
করিডোর ??
ভারত যেটা নিচ্ছে তা হল, ভারত থেকে আমাদের দেশের মধ্যদিয়ে সোজা পথে ভারতের আরেকটা অংশে যাওয়ার সুযোগ। ভারত কিন্তু বাংলাদেশ হয়ে অন্য কোন দেশে যাচ্ছে না। এই কারণেই এটা ট্রানজিট নয় এটা করিডোর।
এখন মূল কথায় আসি...
ট্রানজিট-করিডোর দেয়ার বিষয়টি আংশিক কোন বিবেচনা বা সরকারের একক কোন সিদ্ধান্তের ফল হতে পারে না। দেশ ও জাতির এমন কিছু বিষয় আছে, যেসব ব্যাপারে সরকার এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, নেওয়া উচিত নয়। এসব সিদ্ধান্ত জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে নেয়া উচিত। ট্রানজিট-করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত এ ধরনেরই বিষয়। কিন্তু সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে এখনও আমল নেননি।
মনে করা হচ্ছে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশে আসছেন করিডোর, বন্দরের মতো বিষয়গুলো নিয়ে চুক্তি সম্পন্ন করতেই। ভারতের পত্রপত্রিকা এ কথাই বলছে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের খবর, ‘'‘বাংলাদেশের দু'টি সমুদ্রবন্দরসহ সড়ক ও রেলপথের ১৫টি স্থান দিয়ে পণ্য পরিবহনের সুবিধা চেয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ’’
ট্রানজিট দুনিয়াতে নজিরবিহীন নয়। ট্রানজিট দিলে সব শেষ হয়ে যাবার কথা নয়।
আবার ট্রানজিট খাল কেটে কুমির আনার মাধ্যম হতে পারে, এটাও ঠিক। কথায় বলে, ‘'ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না। ''
আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি, ট্রানজিট দেয়াকে সঙ্গত, স্বাভাবিক ও লাভজনক প্রমাণের জন্য সরকার নানা কথা বলে চলেছেন এবং নানা কাজ করে চলেছেন। সরকার বলছে বাংলাদেশের উন্নয়নের সীমাবদ্ধতাগুলোকে ট্রানজিট দূর করবে। যেমন- শ্রমিকদের নিম্ন উৎপাদনশীলতা, বাণিজ্যিক অনুসঙ্গগুলোর ক্ষেত্রে দুর্বলতা, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং পানি ও জলবায়ুর পরিবর্তন ইত্যাদির ক্ষেত্রে ট্রানজিট বিরাট সুফলদায়ক হবে।
কিন্তু তাদের কথায় পরিষ্কার হয়নি যে, ভারতের দুই অংশে গাড়ি যাবার জন্য রাস্তা তৈরি হলে এবং সেই রাস্তা দিয়ে ভারতের গাড়ি দিনরাত যাতায়াত করলে তাতে ভারতের বিশাল লাভ হবে, তাদের অন্তঃঅঞ্চল বাণিজ্য বাড়বে, কিন্তু বাংলাদেশের কী লাভ হবে? ভারতে বাংলাদেশের পণ্য যাচ্ছে না, সেটা কী রাস্তার অভাবে নাকি ভারতের মানসিকতার কারণে? সবারই জানা ভারতের সাথে আমাদের যে আকাশচুম্বী বাণিজ্য ঘাটতি তার কারণ ভারতের স্বার্থপর মানসিকতা। ট্রানজিট হলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যে ঘাটতির পরিমাণ আরো বাড়বে। এখন যেটুকু শিল্পপণ্য ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ সেভেন সিস্টারে যেতে পারে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এইসব পণ্যের যোগান তারা ভারতের অন্য অঞ্চল থেকে নিয়মিত পাবে।
সবচেয়ে বড় কথা হলো ট্রানজিটের উপকার ও সুবিধার কথাগুলো বাংলাদেশ বলছে।
কিন্তু যে ট্রানজিট নিচ্ছে সে ভারত কিন্তু এসব ব্যাপারে একটি কথাও বলেনি। ভারত যেখানে কথা বলছে না সেখানে ভারতের হয়ে এত কথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কেন বলছে সেটা বিরাট রহস্যের।
ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার যুক্তি হিসেবে ভারতের পক্ষে এ ধরনের কথা বাণিজ্যমন্ত্রণালয় আরও বলেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের খসড়া ঐ রিপোর্টে ভারতের সেভেন সিস্টার অঞ্চলকে অনেকটা ল্যান্ড লক্ড হিসেবে দেখিয়ে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পক্ষে যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে। বলেছে বাংলাদেশ মাঝখানে থাকায় ভারতের ত্রিপুরাকে প্রায় ১৬শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা বন্দরে যেতে হয়, সেই কারণেই নাকি ভারতকে ট্রানজিট দেয়া অপরিহার্য।
কিন্তু আমাদের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জানা নেই ইতিহাস। ভারতের ত্রিপুরা মিজোরামের সাথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ও লেনদেনের সুবিধার জন্য '৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাংলাদেশের প্রাপ্য করিমগঞ্জকে করিডোর হিসেবে ভারতের দিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং দেশ বিভাগের সময়ই ত্রিপুরা মিজোরামের সাথে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষার ব্যবস্থা বাংলাদেশ করে দিয়েছে। ত্রিপুরাকে কলকাতা বন্দরে যাবার জন্য অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হয় একথা সত্য। কিন্তু এই সমস্যাটা কি ত্রিপুরা মিজোরামের একার? ভারতের অন্য অঞ্চলের কি নেই? কলকাতা বন্দরে যাবার জন্য ত্রিপুরাকে ১৬শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়, কিন্তু ভারতের হিমাচল প্রদেশকে তার নিকটবর্তী মুম্বাই বন্দরে যেতে ১৭৪২ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়।
আর জম্মুকে মুম্বাই বন্দরে যেতে পাড়ি দিতে হয় ২২৭৫ কি. মি. ,দেখা যাচ্ছে ত্রিপুরার চেয়ে আরও খারাপ অবস্থায় আছে ভারতের কিছু প্রদেশ। সুতরাং দূরত্ব কোনো বিষয় নয়।
ভারত আসলে তার পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ সেভেন সিস্টারের সঙ্গে বহুমুখী ট্রানজিট চায় অর্থনৈতিক কারণে নয় সামরিক কারণে। বহুমুখী ট্রানজিটের নামে বহুমুখী করিডোরের পথে ভারত দ্রুত সৈন্য অস্ত্র আনা-নেয়া করতে যেতে চায় তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। টার্গেট উলফা দমন এবং স্বাধীনতাবাদীদের দমন করা।
পণ্য পরিবহন আসলে একটা প্রাথমিক মুখোশ এবং অজুহাত।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যখন তাদের গাড়ী যাবে, তখন ভারতীও আর্মির একটা টিম সাথে থাকবে... একবার চিন্তা করুন, একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে দিয়ে আরেকটা দেশের আর্মি কিভাবে যায় ??? বাংলাদেশ কি ইরাক-আফগানিস্তান?? ধরুন ভারতীও আর্মি যাওয়ার পথে কাউকে গুলি করে বসলো ডাকাত "সন্দেহে" তখন? আমাদের সরকার তো সেই মানুষটিকে ডাকাত বানাতে মরিয়া হয়ে উঠবে! যেমনটা হয়েছে লিমনের ক্ষেত্রে! আর খোদা না করুক, বাংলাদেশের কোন জঙ্গি সংগঠন সেই গাড়ির উপর আঘাত চালাল, তখন বাংলাদেশকে তো পাকিস্তানের মতই টেরোরিষ্ট দেশ বলা হবে! বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন তো বাদই দিলাম! পূর্ব ভারতের উলফা বাঁ এরকমই কোন স্বাধীনতাবাদি দল আক্রমন করলো, সেই দায় দায়িত্ব কে নিবে?? তখন যদি ভারতীও আর্মি সামনে যাকে পায় তাঁকে গুলি করে রেখে যায়, তখন কারোই কিছু করার থাকবে না!
শুল্ক কত হবে তা নিয়ে সরকার গরিমশি করছে। সরকারের বেস্ট ফ্রেন্ড ভারতের কাছ থেকে যে উচ্চ হারে শুল্ক নিবে, তা ভাবার রাস্তা নেই! অর্থমন্ত্রী বলেছেন, "শুল্ক নিবো না, তবে কিছু একটা নিবো !!!!!"
এইতো গেলো ট্রানজিটের কথা... এখন আসি চট্রগ্রাম পোর্ট বাবহারের বিষয়ে।
কিছুদিন আগে ভারত বাংলাদেশকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়, তা কি মনে আছে? এখন বলতে পারবেন কেন সেই ঋণ দেয় ভারত? বাংলাদেশের পূর্বের ভারতের ৫টি রাজ্য পুরপুরি সাগর থেকে বিচ্ছিন্ন। সুতরাং, আমদানিকৃত পণ্য যেন দ্রুত সেই রাজ্য গুলোতে পৌছুতে পারে সেজন্য আমাদের পোর্ট ব্যবহার করতে চায় ভারত।
চট্রগ্রাম পোর্টের অবস্থান ভারতের অনেক কাছে। এখন কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য খালাশ করতে মাসের পর মাস লেগে যায়। সেখানে ভারতকে কিভাবে চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহার করতে দেওয়া হয় !!! ভারত তো অবশ্যই চাইবে যাতে তাদের মাল আগে খালাশ হোক... আর যদি তাই হয়, বাংলাদেশের মালগুলো খালাশ হতে আরও দেড়ি হবে। একবার চিন্তা করুন, বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে পরবে তখন !! এখন খালাশ হতে এক মাস লাগে সময়, তখন লাগবে দেড়-দুইমাশ! পুরো দেশই ক্রমশে পিছিয়ে পরবে!
এইতো শুনলেন ভারতের পোর্ট ব্যাবহারের কথা... এখন শুনুন ১০০ কোটি টাকার কথা... চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে যেন সহজেই মাল ভারতের ভূখণ্ডে ঢুকতে পারে, সেজন্য একটি রোড হবে চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে ভারতের ভূখণ্ড পর্যন্ত। এবং এই ১০০ কোটি টাকা সেই রোডের পিছনে বায় করার জন্য দেওয়া হয়েছে! শুধু তাই নয়! চুক্তিতে আছে, রাস্তা করার জন্য যত কাঁচা মালের প্রয়োজন, সব ভারত থেকে আমদানি করতে হবে!!! তাও শেষ কথা নয়, রাস্তা নির্মাণের প্রোজেক্টও কোন ভারতীও কোম্পানিকে দিতে হবে!!! মোট কথা, এই ১০০ কোটি টাকা তো ভারতে ফিরে যাচ্ছেই, তার উপর আমাদের সুদ দিয়ে পরবর্তীতে আরও ১০০ কোটি টাকা দেয়া লাগছে!!
আমাদের দেশের রাস্তার কি হাল জানেনই তো।
এই জায়গায় আমাদের দেশের সরকার উঠে পরেছে লেগেছে ভারতের জন্য রাস্তা সংস্কার এবং তৈরির কাজে। এখানে আমি শুধু পণ্যই বলেছি... সেখানে যেকোনো জিনিসই থাকতে পারে! অস্ত্র, কাঁচা মাল, যেকোনো প্রকার মেশিন!
আমরা ভারতকে ট্রানজিট দিচ্ছি একটা একতরফা ব্যবস্থা হিসেবে/ তারা তাদের স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে এবং তাদের সব দাবি আমরা মাথা পেতে নিচ্ছি। এমনকি ট্রানজিটের ফি'কে অসভ্যতা বলছি। তৃতীয় পক্ষ বা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধান থাকলে এটা হতো না।
আমাদের সরকারও মানুষকে বোকা বানাবার জন্য করিডোরকে ট্রানজিট নামে চালিয়ে দিচ্ছে।
ট্রানজিট অর্থনৈতিক বিষয় এই অর্থে, যে পণ্য এবং মানুষ ট্রানজিট সুযোগ ব্যবহার করে। কিন্তু ট্রানজিট দেয়া এবং না দেয়ার বিষয়টি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দেশের নিরাপত্তা এবং পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। পারস্পরিক বিশ্বাস না থাকলে এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত ভীতি থাকলে কোনো দেশই ট্রানজিট দিতে রাজি হয় না। ইউরোপেও পারস্পরিক ট্রানজিট হতে শুধু বছর নয়, কয়েক শতাব্দী লেগেছে।
চুক্তি লংঘন, প্রতিশ্রুতি পালন না করা ভারতীয় কূটনীতির যেন অংশ। চুক্তি অনুসারে ভারতকে আমরা বেরুবাড়ি দিয়েছি ভারত আমাদের তিনবিঘা করিডোর দেয়নি। দ্বি-পাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতি লাঘবের ক্ষেত্রে ভারত যত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তার কোনোটাই পালন করেনি। বাংলাদেশের সাথে প্রতারণা করে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করেছে। বাংলাদেশের স্বার্থকে গলা টিপে মেরে আমাদের নদীগুলোর প্রাণহরণ করে ভারত আমাদের নদীর উজানে আড়াই-তিন ডজনের মতো বাঁধ দিয়েছে।
সীমান্তে শান্তিরক্ষার কোনো চুক্তি, কোনো প্রতিশ্রুতিই ভারত রক্ষা করেনি। এ পর্যন্ত সীমান্তে কয়েক হাজার বাংলাদেশিকে ভারত হত্যা করেছে। শুধু দ্বি-পাক্ষিক নয় বহুপক্ষীয় চুক্তির ক্ষেত্রেও ভারত কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেনি। ভারতের কারণে সার্ক আজ অকেজো। ভারতীয় স্বার্থবাদিতার কারণেই সার্কের অধিনে SAPTA চুক্তি (South Asian Prefearential Trade Agrement) কার্যকরী হয়নি।
SAFTA (South Asian Free Trade Agrement) চুক্তিও কার্যকরী হতে পারছে না। ভারত আসলে দ্বি-পাক্ষিক ফ্রি-ট্রেড চায়। সার্কের অধীনে SAFTA-র মাধ্যমে বহুপক্ষীয় হিসেবে নয়। এই হলো ভারতের স্বার্থপরতা ও অবিশ্বস্ততার কিঞ্চিত ইতিহাস।
এই অবস্থার কারণেই ভারতের সঙ্গে আমাদের কিংবা প্রতিবেশী কারোরই আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে ওঠতে পারেনি।
আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক যেহেতু নেই সেহেতু ভারতের দিক থেকে নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কে আমরা ভুগছি, সেখানে হুট করে ট্রানজিট দেয়া কোনো ক্রমেই স্বাভাবিক নয়। এই কথা কে বুঝাবে সরকার কে ?? ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি বাংলাদেশের এখানেই। আস্থা ও বিশ্বাস এবং নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করা ছাড়া কেউ কাউকে ট্রানজিট কখনো দেয় না। ইউরোপ লিথুনিয়ার মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে ট্রানজিট দিয়েছে ২০০২ সালে। এই ট্রানজিট অনেক পর্যবেক্ষণ, অনেক আলোচনার ফল।
বাংলাদেশ ট্রানজিট দেয়ার ক্ষেত্রে ট্রানজিটের Economics দেখছে, আস্থা, বিশ্বাস ও নিরাপত্তার বিষয় নয়।
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক হলো দুই অসমানের। অসমান হওয়া কোন সমস্যা নয়। কিন্তু এর সাথে যুক্ত রয়েছে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাসের সম্পর্ক। এর পেছনে রয়েছে দেশ বিভাগের ইতিহাসও।
ভারত রাষ্ট্রের প্রণেতারা অখন্ড ভারতের পক্ষে ছিল। আর বাংলাদেশ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র চিন্তার উত্তরাধিকার। ভারতের রাজনীতি, ভারতের মিডিয়া এই ইতিহাস ভোলেনি, সুযোগ পেলেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কারণে বাংলাদেশও ভুলতে পারেনি। ভুলতে পারছে না এখনও এই কথা যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি ভারতীয় রাজনীতির বৈরিতা না হোক, সংগোপন বিতৃষ্ণা আছে।
গত তিন দশক ধরে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতীয় এই মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। এর ফলেই ভারতের সাথে বাংলাদেশের ভালোবাসার বদলে ভয়ের সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতকে আমরা যে ট্রানজিট দিতে চাচ্ছি তা দৃশ্যত অর্থনৈতিক মনে হলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি এখানে বড়। পর্যবেক্ষকদের মতে অনেক বিষয় এখানে ভাববার রয়েছে। আমরা যত সহজে ট্রানজিট দিচ্ছি তত সহজে কি আমরা এটা বন্ধ করতে পারবো।
কোনো কারণে যদি তাদের সাথে মতবিরোধ ঘটে আমরা যদি ভারতকে দেয়া এ সুযোগ বন্ধ করতে চাই তাহলে তা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না এটা এখনি ভাবতে হবে। কথায় আছে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। ল্যান্ড লক্ড নেপাল ভারতের মধ্যদিয়ে বিদেশ থেকে তাদের অনেক পণ্য আনা-নেয়া করে। নেপালের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ভারত এ ট্রানজিট একাধিকবার বন্ধ করে দিয়েছে এবং নেপালকে অবরুদ্ধ করেছে। ভারত বড় দেশ বলে নেপালকে দেয়া সুযোগ বন্ধ করতে পেরেছে।
কিন্তু আমরা কি বড় দেশ ভারতকে দেয়া ট্রানজিটের সুযোগ প্রয়োজন হলেই বন্ধ করতে পারবো? পারবো না। ভারতের মধ্যদিয়ে নেপাল বাংলাদেশ ট্রানজিট চালু হবার পর ভারত তা বন্ধ করে দেয়। ছোট দেশ নেপাল এবং ছোট রাষ্ট্র বাংলাদেশ এর প্রতিকার তো দূরের কথা, প্রতিবাদও করতে পারেনি। ভারতকে দেয়া ট্রানজিট সুযোগ কোনো কারণে বন্ধ করা যদি আমাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে, তখন ভারত তা অবশ্যই বন্ধ করে দিতে চাইবে না। বলবে যে বাংলাদেশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভারতের অর্থনীতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
এই ষড়যন্ত্র বাঞ্চালের জন্য তখন যেকোনো উপায় সে গ্রহণ করতে চাইবে। আরেকটা বিষয়, ভারত যদি অর্থনৈতিক প্রয়োজনে নেয়া ট্রানজিট চালু হবার পর এই ট্রানজিটকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে ভারতের অস্ত্রশস্ত্র, সৈন্য আনা-নেয়া করতে চায়, তাহলে কি আমরা বাধা দিতে পারবো? পারবো না। ভারত আমাদের মতো একটি ছোট দেশ হলে এ সমস্যা হতো না। সেক্ষেত্রে নির্ভয়ে আমরা হয়তো এ ধরনের ট্রানজিট চুক্তি করতে পারতাম। কিন্তু ভারত অনেক বড় দেশ হওয়ায় আমরা তা পারবো না বলেই আমাদের সাবধান হওয়া দরকার।
আমরা নিশ্চিত ট্রানজিট চুক্তিতে এ ধরনের কোনো ধারা বা শর্ত থাকছে না, যাতে আমরা প্রয়োজনে এ চুক্তি বাতিল করতে পারবো। আমাদের ট্রানজিট চুক্তি যদি জাতিসংঘ ধরনের কোনো তৃতীয় পক্ষের তত্ত্বাবধানে হতো এবং তাতে যদি এ ধরনের সুস্পষ্ট শর্ত থাকতো যে আমরা চাইলেই ভারতকে দেয়া ট্রানজিটের সুযোগ বন্ধ করতে পারবো, তাহলেও তৃতীয় পক্ষ সাক্ষী থাকায় নিরাপত্তার একটা নিশ্চয়তা আমাদের জন্য থাকতো। কিন্তু ট্রানজিট চুক্তিটা ভারতের সাথে দ্বি-পাক্ষিক হওয়ায় এই সুযোগ থাকার এখন প্রশ্ন নেই।
ট্রানজিটের আরও একটি বিষয়কে পর্যবেক্ষকমহল খুব উদ্বেগের সাথে দেখছেন। এই সরকারের আমলে এখনই যাতে ভারত ট্রানজিট পেতে পারে, এ জন্য ভারত এবং বাংলাদেশ সরকার যেন উঠেপড়ে লেগেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তৈরি 'Economic of Transit' রিপোর্টের তৃতীয় চ্যাপ্টারে পরিষ্কার বলা হয়েছে, "দুই দেশের বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এটা না করলে বিষয়টা ব্যর্থ হবার ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে, বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে। " এর অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের সাথে ট্রানজিট চুক্তি করতে চাচ্ছেন তার পক্ষ থেকে, দেশের পক্ষ থেকে যেন নয়। দেশের পক্ষ থেকে করলে ট্রানজিটের বিষয়টাকে একটা সরকারের মেয়াদীনির্ভর হিসাবে দেখা হতো না। একটা দেশে সরকার স্থায়ী নয়, আসে-যায়, কিন্তু দেশ থাকে। সুতরাং ট্রানজিটের মতো দেশ ও জনগণের সাথে সংশ্লিষ্ট যা কিছুই বিদেশের সাথে করা হোক তা সরকারের স্বার্থ নয়, দেশ ও জনগণের স্বার্থে করতে হবে।
পর্যবেক্ষকমহল এই বিষয়টিকেও খুবই গুরুত্বের সাথে দেখছেন এবং বলছেন, কোনো তাড়াহুড়া নয়, দেশের সবরকম স্বার্থ বিবেচনা করে ভারতের উপর আস্থা রাখার বিষয়টি দেখে, দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং উপযুক্ত দর কষাকষির মাধ্যমে বাংলাদেশের নদ-নদীর পানি ও বাণিজ্য ঘাটতি সমস্যার উপযুক্ত সমাধান এনে ‘চেক এ্যান্ড ব্যাল্যান্স'-এর ব্যবস্থাসহ একটা সামগ্রিক প্যাকেজ হিসেবে ট্রানজিট আলোচনাকে সামনে অগ্রসর করাতে হবে। বড় প্রতিবেশী ভারতের নীতি ও আচরণের প্রেক্ষাপটে ছোট রাষ্ট্র বাংলাদেশের এই সতর্কতার প্রয়োজন আছে।
সূত্র : Economic of Transit ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।