ট্রানজিটের ভারী ট্রেইলর যাতায়াত : ভেঙ্গে গেছে বি.বাড়িয়া আখাউড়ার সড়ক ও ব্রিজ
আলাউদ্দিন আরিফ ও সাদেকুল ইসলাম সাচ্চু, আখাউড়া থেকে ফিরে
সরাইল বিশ্বরোড থেকে প্রায় দু’কিলোমিটার সামনে এগুলেই সুহিলপুর-মিরহাটি ব্রিজ। প্রায় ভেঙেপড়া ব্রিজের দু’পাশে শত শত বাঁশ গেড়ে তার ওপর ফেলা হয়েছে বালির বস্তা। ওইসব বস্তার ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন চলছে হাজার হাজার গাড়ি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভারী সরঞ্জাম নিয়ে ভারতীয় গাড়ি চলায় ভেঙে গেছে ব্রিজটি। এর পাশে যে বাইপাস করা হয়েছিল, সেটি আগেই ভেঙে গেছে।
ফলে ভাঙা ব্রিজটির ওপর দিয়ে এখনও চলছে ভারতীয় ট্রানজিটের গাড়িগুলো। যদিও পণ্য পরিবহনকারী সংস্থা ভারতীয় এবিসি কোম্পানির প্রতিনিধিরা বলছেন, তারা বাংলাদেশের কোনো ব্রিজ-কালভার্ট ব্যবহার করছেন না। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র।
‘ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো’ বা ওডিসির আওতায় শুল্কমুক্তভাবে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বিদ্যুেকন্দ্রের ভারী সরঞ্জাম বহন করছে ভারত। এসব পণ্য পরিবহনের জন্য সরাইল বিশ্বরোড থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সুলতানপুর-আখাউড়া সড়কে থাকা ব্রিজগুলোতে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে।
এর মধ্যে বেশক’টি বাইপাস বর্ষার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে পণ্যবাহী ভারতীয় ট্রেইলরগুলো এখন চলছে ব্রিজের ওপর দিয়েই। ভারী ট্রেইলর চলার কারণে রাস্তার কার্পেটিং উঠে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের।
সরেজমিনে দেখা গেছে, আশুগঞ্জ নৌবন্দর থেকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ওপর দিয়ে যাতায়াত করে ট্রেইলরগুলো। আশুগঞ্জ থেকে সরাইল বিশ্বরোড পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার সড়কে কোনো ব্রিজের পাশেই বাইপাস তৈরি করা হয়নি।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের কালভার্ট ও ব্রিজগুলোর ওপর দিয়েই চলছে ট্রেইলরগুলো। ফলে যে কোনো সময় ব্রিজ-কালভার্ট ভেঙে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
সরাইল বিশ্বরোড থেকে সিলেট-কুমিল্লা মহাসড়কের সুলতানপুর পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ২২ কিলোমিটার। অত্যন্ত ব্যস্ত এই সড়কটি এমনিতেই সরু। প্রতিদিন এ সড়কে চলে হাজার হাজার যানবাহন।
সড়কের পুরো অংশটিই খানাখন্দে ভরা। বেশ কয়েক স্থানে কার্পেটিং উঠে গেছে। সুহিলপুর মিরহাটি নামক স্থানে তৈরি করা একটি বাইপাস পানির তোড়ে আগেই ভেঙে গেছে। ফলে ভারতীয় গাড়িগুলো চলছে মিরহাটি কালভার্টের ওপর দিয়ে। স্থানীয় দোকানদার কামাল হোসেন, আবদুর রউফসহ ক’জন জানান, ভারতীয় গাড়িগুলোর চাপে ব্রিজটির দু’পাশ দেবে গেছে।
এটি ঠেকানোর জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগের লোকজন ব্রিজের দু’পাশে বাঁশের খুঁটি গেড়ে বালুর বস্তা ফেলেছে। তার ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে চলছে যানবাহন।
সুহিলপুর থেকে সামনে এগিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পরই কুরুলিয়া নদী বা এন্ডারসন খাল। এ খালের ওপর ব্রিজটির অবস্থা খুবই নড়বড়ে। এর নিচে বাইপাস তৈরি করে তার ওপর ফেরি বসিয়ে ভারতীয় গাড়িগুলো চলছে।
এই বর্ষায় পানি বেড়ে যাওয়ায় বাইপাসটিতে গাড়ি চলতে পারছে না। ব্রিজের ওপর ট্রেইলর উঠলে বড় দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। বাইপাস তৈরির কারণে কুরুলিয়া ব্রিজের দু’পাশের সড়কের মাটি সরে যাচ্ছে। বালির বস্তা ফেলে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা চলছে। কুরুলিয়া ব্রিজ থেকে সামনে এগিয়ে ফাটাপুকুরপাড়, রামরাইল, মাদানীনগর, রাধিকা চৌমুহনী এলাকায় দেখা গেছে ভাঙা সড়কের বেহাল চিত্র।
সিলেট-কুমিল্লা মহাসড়কের সুলতানপুর থেকে আখাউড়া সড়কের শুরু। সুলতানপুর থেকে আখাউড়া বন্দর পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার সড়কের পুরোটারই কার্পেটিং উঠে গেছে। কোথাও বিটুমিনের স্তর নেই। সব ধরনের যানবাহন চলছে ঝুঁকি নিয়েই। সুলতানপুর থেকে আখাউড়া সড়কে উঠলেই দেখা যায় সড়কের বেহালদশা।
চান্দি, বাসুদেব, কোড্ডা, ভাতশালাসহ সব এলাকায়ই সড়কটির বেহালদশা। কোড্ডা রেল ও সড়কব্রিজের নিচে একটি ট্রেইলর আটকা পড়ে আছে। এর থেকে সামনে এগিয়ে তিতাস ব্রিজ। তিতাস রেলব্রিজ ও সড়কব্রিজের মাঝখান দিয়ে ট্রেইলর যাতায়াতের জন্য বাইপাস তৈরি করা হয়েছিল। বর্ষায় পানির তোড়ে বাইপাসটি ডুবে গেছে।
ফলে আটকা পড়েছে ভারতীয় ট্রেইলরগুলো। বাইপাস ডুবে যাওয়ায় এখন কুরুলিয়া খালের ওপর বসানো ফেরি দিয়ে ট্রেইলরগুলো পার করার চেষ্টা করছে এবিসি কর্তৃপক্ষ। প্রায় মাসখানেক আগে তিতাসের মধ্যে একটি ট্রেইলরের ইঞ্জিন ডুবে গিয়েছিল বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। সেটি তুলে মেরামতের জন্য ভারতে পাঠানো হয়েছে।
এবিসির ভারতীয় প্রকৌশলী গণেশ চন্দ্র চাকু জানান, তিতাস ব্রিজের পাশে তৈরি বাইপাসটি ডুবে যাওয়ায় গত ৭ জুলাই থেকে ট্রেইলরগুলো আটকা পড়ে আছে।
এখন তারা জরুরি ভিত্তিতে বাইপাস মেরামত করে কুরুলিয়া খালের ওপর বসানো ফেরিটি সেখানে নিয়ে ট্রেইলরগুলো পার করার চেষ্টা করছেন। চলতি মাসের ৬-৭ তারিখ থেকে তারা পুনরায় ট্রেইলরগুলো পার করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, তারা ৯০টি প্যাকেজে পণ্য পরিবহন করবেন। এরই মধ্যে প্রায় অর্ধেক পণ্য পার করা হয়ে গেছে। অর্থাত্ দুটি বিদ্যুেকন্দ্রের মধ্যে একটির পণ্য পার করা হয়ে গেছে।
এদিকে এবিসি ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বাংলাদেশের কোনো ব্রিজ-কালভার্ট ব্যবহার করছেন না। কিন্তু সরেজমিনে দেখা গেছে অন্তত ২০টির বেশি ব্রিজ-কালভার্ট ব্যবহার করেই ভারতীয় ট্রেইলরগুলো যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে এবিসির প্রকৌশলী গণেশ চন্দ্র চাকু বলেন, দু’একটি ব্রিজ তারা সড়ক ও জনপথ বিভাগের অনুমতি নিয়েই ব্যবহার করছেন।
আখাউড়া স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের প্রধান শুল্ক কর্মকর্তা আবুল বাশার চৌধুরী জানান, এবিসি কোম্পানির প্রথম জাহাজটি গত ৯ মার্চ আশুগঞ্জ বন্দরে আসে। ২৭ মার্চ মধ্যরাতে ৩২৬ টন ভারী সরঞ্জাম নিয়ে ৪টি ট্রেইলর একযোগে আখাউড়া স্থলবন্দর পার হয়ে ত্রিপুরার পালাটানায় যায়।
২৭ মার্চের পর থেকে এ পর্যন্ত ৩৯টি ট্রেইলর আখাউড়া বন্দর দিয়ে ত্রিপুরায় গেছে। তারা গাড়ির নম্বর, কখন গেল—তার সময় লিখে রাখছেন। যেহেতু শুল্কমুক্ত চুক্তির আওতায় ট্রেইলরগুলো যাচ্ছে, তাই এগুলো থেকে কোনো শুল্ক আদায় করা হচ্ছে না। আবুল বাশার আরও জানান, তারা পণ্য খুলে পরীক্ষা করছেন না। যেহেতু বিদ্যুেকন্দ্রের সরঞ্জামগুলো প্রতিটি আলাদাভাবে রাখা, তাই সেগুলো খোলার প্রয়োজন হচ্ছে না।
এদিকে সুলতানপুর-আখাউড়া বন্দর সড়কের বেহাল অবস্থা প্রসঙ্গে আখাউড়া বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সড়কটি মেরামতের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কটির উন্নয়নে কাজ করছে। বর্ষা আসার পর তারা সড়ক উন্নয়নের কাজ স্থগিত রেখেছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৩ মে আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে কলকাতা থেকে আগরতলায় পণ্য পরিবহনের চুক্তি করে বাংলাদেশ। গত বছরের জানুয়ারিতে নয়াদিল্লি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের যৌথ ইশতেহারে বাংলাদেশ সরকার গত বছরের মে মাসে আশুগঞ্জকে পঞ্চম বন্দর ঘোষণা করে।
আশুগঞ্জে আন্তঃমহাদেশীয় ট্রান্সশিপমেন্ট কেন্দ্র চালুর ঘোষণাও দেয়া হয়েছিল। পরে সরকার ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড (আইডব্লিউটিটি) চুক্তিতে এক সংযোজনীর মাধ্যমে আশুগঞ্জ দিয়ে ত্রিপুরায় ভারতীয় কার্গো ট্রান্সশিপের অনুমোদন দিয়ে আশুগঞ্জকে দ্বিতীয় ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট ঘোষণা করে, যার প্রেক্ষিতে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানায় বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের জন্য ‘ওভার ডাইমেনশনাল কার্গো’ বা ওডিসির আওতায় (শুল্ক ছাড়া) কমপক্ষে ৮৬ জাহাজ পণ্য ত্রিপুরায় নেয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে ৩৯ ট্রেইলর পণ্য পার করা হয়েছে। আশুগঞ্জের সোনারামপুরে দুটি ডিপো, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাদানীনগরের একটি ডিপোতে বেশকিছু পণ্য রাখা হয়েছে। তিতাস নদীর ওপর বসানো বাইপাস ডুবে যাওয়ায় পাঁচটি ট্রেইলর রাস্তায় আটকা পড়ে আছে।
এগুলো ত্রিপুরায় পৌঁছানোর পর আবার নতুন করে পণ্য আনা হবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।