গত ১৭ই ডিসেম্বর অনেকদিন পরে দীর্ঘক্ষণ টিভি দেখলাম। তার কারণ ছিল চ্যানেল আইয়ে বিজয় দিবস উপলক্ষে শহিদুল ইসলাম খোকন এর পুরস্কারপ্রাপ্ত 'ঘাতক' ছবিটি দেখাচ্ছিল। যা দেখে আমার রুমে এসে নির্বিঘ্নে ছবিটা দেখার জন্য আমার টিভি অন করে বসে পড়লাম ( সঙ্গত কারণে আমি আমার বাসার মূল বড় টেলিভিশনের সামনে বসতে পারি না!) ছবিটা দেখতে গিয়ে সেই ৯৬ সালের আমার অস্তগামী কিশোর বেলার স্মৃতিতে ফিরে গেলাম বারবার। এই ছবিটা তখন প্রথম সপ্তাহে আমরা ১৪ জন বন্ধু মিলে সিলেটের মনিকা সিনেমা হলে দেখেছিলাম। মনে পরে কি আনন্দ নিয়ে হলে যেতাম ছবি দেখার জন্য।
সেদিন এতো বেশী ভিড় ছিল যে টিকিটের দাম কালো বাজারে একলাফে ৫ গুন বেড়ে গিয়েছিল । আমাদের সব বন্ধুদের পকেট খালি করে মিলে ৬০০ টাকা দিয়ে ১৪ টা টিকেট কিনলাম তবু ছবি না দেখে ফিরে যাবো না এই পণ ছিল সবার। টিকেট কেনা তো হলো তবু মন খারাপ কেন? কারণ ৩ ঘণ্টা হলে শ্বাসদ্ধকর দৃশ্যর সাথে কোল্ড ড্রিংকস না হোক সিগারেট না হলে কি চলে? কি আর করা! হলের পাশের রেস্টুরেন্ট এর মালিক কামাল ভাই (প্রতি সপ্তাহে হলে যাওয়ার কারণে তার চা খেয়ে বাড়ি ফিরতাম সেই সূত্রে হৃদয়ের একতা সম্পর্ক হয়েছিল। যিনি একজন বাংলা ছায়াছবির চরম ভক্ত) এর কাছ থেকে ১০০ টাকা ধার করে গোল্ড লিফ, বেন্সন প্যাকেটে ভরে হলে ঢুকে গেলাম। আর ফেরার আগে সেদিন কামাল ভাই আমাদের বিনে পয়সায় তার রেস্টুরেন্ট এ চা আর গরম গরম ডালপুরি খাওয়ালেন।
আজও সেই হল টা আছে আছে কামাল ভাইয়ের সেই রেস্টুরেন্ট , নেই শুধু আমরা সেই বন্ধুরা। কামাল ভাই আজ ৫০ ঊর্ধ্ব একজন, যিনি আজও দেখা হলে সেই একই স্নেহের পরশ দিয়ে যান। উল্লেখ্য সেই ধার নেওয়া ১০০ টাকা কামাল ভাই আমাদের কাছ থেকে ফেরত নেয়নি, কোনদিন তাকে জোর করেও সেই টাকা আমরা দিতে পারেনি। কারণ তার একটাই কথা ' আমি তোমাদের টাকা দেইনি, দিয়েছি আমার একটু স্নেহ,কারন তোমাদের মাঝে বাংলার প্রতি যে ভালোবাসা আমি দেখেছি সেটা এই ১০০ টাকার কাছে কিছু না। তোমাদের সবাই একদিন অনেক বড় হবে কিন্তু একটা অনুরোধ তোমাদের মাঝে যে বাংলার প্রতি যে ভালোবাসা দেখেছি তা কোনদিন যেন শেষ না হয়।
এমনভাবেই থেকো তোমরা"। ছবিটা দেখছিলাম আর এসব স্মৃতি মনে করে চোখ দুটো জলে টলমল করছিল। আহা ! কি দিন ফেলে এসেছি !
আমার দুরন্ত কিশোর বেলা থেকে শুরু করে কলেজ জীবন পর্যন্ত একটানা ১০ টি বছর সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার আনন্দ উপভোগ করেছি। আমার সাথে ছিল আমার খুব প্রিয় ৯ বন্ধু । আমরা ১০ জন ছিলাম সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখার পোকা।
মাঝে মাঝে অবশ্য সঙ্গে আরও ৩/৪ নিয়ে যেতাম। আমাদের ১০জনের আনন্দ দেখে অনেকে তখন আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যেতো। তবে বেশি মজা পেতাম যখন স্কুল পালিয়ে ছবি দেখতে যেতাম। আমাদের স্কুল শুরু হতো সকাল ৮ টায় এবং ছুটি হতো ২ টা ৩০ মিনিটে । আমি ও আমার একই পাড়ায় বাস করা আমার স্কুলের বন্ধু সাদিকুর মিলে স্কুলের পিছনের মেডিকেল কলেজের রাস্তা দিয়ে স্কুল পালিয়ে পুলিশ লাইন মাঠে গিয়ে অপর বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতাম।
যারা ছিল অন্য স্কুলের কিন্তু আমাদের একই পাড়ার বন্ধু। আমি ও সাদিকুর ছিলাম একই স্কুলের সহপাঠী ও জানের জান দোস্ত। অন্যদের স্কুলের সময় ছিল সকাল ১১ টায় আর ছুটি হতো বিকেল চারটায়। তো আর কি করা? আমরা ২ বন্ধু মিলে সকাল আটটা থেকে ১০ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম বাকী বন্ধুদের জন্য। প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার সময় স্কুলের পেন্টের ভিতরে আরও একটা পেন্ট পরে বের হতাম।
সেই পুলিশ লাইন মাঠে গিয়েই গাছের চিপায় দাঁড়িয়ে উপরের স্কুল পেন্ট খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে শার্টের ইন ছেড়ে দিয়ে নরম সবুজ ঘাসের উপরে বসে ২ বন্ধু মিলে চানাচুর,চিপস আর সিগারট টানতে টানতে সময় পার করতাম। ২ বন্ধুর সেই সময় আলোচনার বিষয় থাকতো যে ছবি দেখতে যাচ্ছি সেই ছবিটা কেমন হবে? কখনও বা আগের দেখা কোন একটা ছবি নিয়ে ভালো লাগা না লাগা নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতো। এমনি করে কখন যে সকাল ১০ টা বেজে যেতো টেরই পেতাম না। দূর থেকে অপর বন্ধুদের সবাইকে আসতে দেখে উত্তেজনায় টগবগ করতাম। ঐ তো সবাই আসছে, এখন সবাই মিলে হলে যাবো এই ভেবে আনন্দে চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠতো।
আজ ভাবি হয়তো সেই দিনগুলোর জন্য আমি আমার দেশকে, দেশের সংস্কৃতিকে মনে প্রাণে ভালবাসতে পেরেছি। আমাকে কখনও বিদেশের কোন জৌলুস বেশিক্ষণ আকর্ষিত করতে পারে না, যতটুকু আমার বাংলা গান, ছবি ও নাটক আকর্ষিত করে। হয়তো বা আমি কারো কাছে রুচিহীন! কারো কাছে খ্যাঁত! এতে আমার কোন দুঃখ নেই। মনের মাঝে অন্তত এইটুকু শান্তি পাই যে আমি আমার এই দুঃখিনী বাংলা মাকে আমার হৃদয়ের সবটুকু জুড়ে স্থান দিতে পেরেছি। আমি লোক দেখানো দেশপ্রেমিক হইনি, যারা মুখে বাংলাদেশ আর নিত্যদিন নিত্যসময় পছন্দের তালিকায় রাখে শুধুই বিদেশ আর বিদেশিনীদের মনে ধারণ করে।
যারা আধুনিকতার নামে নিজের দেশের ভালো জিনিসটাকেও গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে তাদের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছুই দেয়ার নেই। আসুন সবাই বিশ্বকে দেই কাঁপিয়ে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।