আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘তাহাদের কথা’

হ্যালো-টুডে ডটকম : দু’জনই সুবক্তা। তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান। রাজনীতির মাঠে তারা তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী। একজন আরেক জনের দিকে তীর ছুড়েছেন সারা জীবনই। তাদের বিতর্ক রাজনীতিতে বিনোদন জুগিয়েছে সব সময়।

তবে রাজনীতির মাঠের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার চাপ এখন নেই তাদের ব্যক্তিজীবনে। দুজনই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই দুই বন্ধুর নাম সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মহাজোট সরকারের দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এখন কারাগারে।

তবে এক জায়গায় এসে মিশে গেছে দু’বন্ধুর জীবন। দু’জনের জীবনেই এখন দুঃসময়। কারাগারে থাকা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত তিনি। রেলওয়েগেট কেলেঙ্কারি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের রাজনীতির সামনেও এঁকে দিয়েছে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।

যদিও তিনি সবসময়ই একে চিহ্নিত করেছেন রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে। অর্ধ শতাব্দীর রাজনীতির ক্যারিয়ার সুরঞ্জিতের। এ জীবনে তিনি সবচেয়ে বিপাকে পড়েন গত এপ্রিলে। এর পাঁচ মাস আগে জীবনে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় স্থান হয়েছিল তার। রেলমন্ত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু দুঃসময় খুব দ্রুত ধরে ফেলে তাকে। তার এপিএস ওমর ফারুক ৭০ লাখ টাকাসহ ধরা পড়েন পিলখানায়। অভিযোগ উঠে, এ টাকা নিয়ে মন্ত্রীর বাসাতেই যাচ্ছিলেন তিনি। মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় উঠে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে। নিজের অসহায় অবস্থার কথা স্বীকারও করেছিলেন তিনি।

বলেছিলেন, এতদিন তীর ছুড়ে এসেছি, এখন নিজেই তীরবিদ্ধ। তীরের যন্ত্রণা যে কি তা বুঝতে পারছি। কি যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে। সে সময় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন সুরঞ্জিত। তবে তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হয়নি।

রেলমন্ত্রী থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী করা হয়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তে কোন প্রমাণ পায়নি দুদক। তবে রেহাই মিলেনি তার। এ মাসেই একটি টিভি সাক্ষাৎকার আবারও চরম বিপর্যয় নিয়ে এসেছে রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জীবনে। তার সাবেক এপিএসের গাড়ি চালক এক টিভি সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, বস্তা ভর্তি টাকা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বাড়িতেই যাচ্ছিল।

এ সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর আবারও তোলপাড় চারদিকে। যদিও সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় যে কোন তদন্তই মেনে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সুরঞ্জিত। তবে বিপদের এ দিনে সুরঞ্জিত সেন বড় একা। তার পক্ষে দলের কোন নেতাকেই কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না।

কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তাই এখন দেখার বিষয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে ১ বছর ১০ মাস আগে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। আটকের পরই নির্মম নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তার বিরুদ্ধে এখন বিচার চলছে পুরনো হাইকোর্ট ভবনে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

কাশিমপুর কারাগারে বন্দি আছেন বিএনপির বহুল আলোচিত এই নেতা। যদিও বরাবরই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। বলেছেন, কোন তালিকাতেই তার নাম নেই। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সন্তান হওয়াতেই ধরা পড়েছেন তিনি। আক্রমণই শেষ কথা: নবম সংসদের প্রথম অধিবেশন।

ব্যতিক্রমী সে অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল বিরোধী দল। বন্ধু সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দিকে প্রথম দিনেই তীর ছুড়েছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। সুরঞ্জিতের মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার দুঃখের কথা বলেছিলেন তিনি। গাড়িতে উড়া পতাকার দিকে ইংগিত করে বলেছিলেন, সুরঞ্জিত বাবুর দুঃখ আমি বুঝি। সে বক্তব্যের জবাব দিয়েছিলেন সুরঞ্জিত।

বলেছিলেন, উনি কি বিরোধী দলের উপনেতা হয়ে এসেছেন। দু’বন্ধুর বিতর্কে হস্তক্ষেপ করে স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছিলেন, আপনারা একজন আরেকজনকে এত খোঁচান কেন। আমি তো জানি আপনাদের সম্পর্ক। দিনের পর দিন সংসদে একজন আক্রমণ করেছেন আরেকজনকে। ওআইসির মহাসচিব পদে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে দেশে ফিরে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে যে ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তা চায়ের টেবিলে আলোচনার ঝড় তুলেছিল বহুদিন।

ওআইসি নিয়ে কথা বলতে হলে সুরঞ্জিতকে ধর্ম পরিবর্তন করে আসার কথা বলেছিলেন তিনি। কারাগারে যাওয়ার কিছু দিন আগে ২০১০ সালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে শেষবারের মতো মুখোমুখী হয়েছিলেন দু’বন্ধু। যুদ্ধাপরাধের বিচার, ত্রয়োদশ সংশোধনী নিয়ে পরস্পরকে উচ্চকণ্ঠে আক্রমণ করেছিলেন। তবে বিতর্ক শেষ করেছিলেন কণ্ঠ নামিয়ে। বলেছিলেন, আমাদের দু’বন্ধুর কথাই দলে গুরুত্ব পায় না।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মন্ত্রিসভায় স্থান পাওয়ায় এ নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বলেছিলেন, আমার বন্ধু সুরঞ্জিত মন্ত্রী হয়েছে। এতে আমি খুবই আনন্দিত। তবে ফজর, জোহর, আসর, মাগরেব শেষে এখন এশার আজান হচ্ছে। কোন ইমামেই এখন কাজ হবে না।

এপ্রিলে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএস বস্তাভর্তি টাকাসহ ধরা পড়ার পর বলেছিলেন, শেষ বয়সে এভাবে ধরা খেয়ে সুরঞ্জিত রাজনীতিবিদদের অপমান করেছেন। তার ওই ঘটনায় রাজনীতিবিদ হিসেবে আমিও অপমান বোধ করছি। এখন একটি কথাই মনে পড়ছে ঘুঘু তুমি বারবার খেয়ে যাও ধান। সালাহউদ্দিন কাদের বলেন, কয়েকদিন আগে সুরঞ্জিত আইন দিয়ে নয় বরং ট্রাইব্যুনালে আবেগ দিয়ে বিচার করতে বলেছেন। আজ আমি সেই আবেগের কথা বলতে চাই না।

তবে বন্ধু সুরঞ্জিতকে এ পরিস্থিতিতে পড়তে দেখে আমি দুঃখিত। শুধু নিজেদেরই নয়, দু’বন্ধু বাক আক্রমণ চালিয়েছিলেন আরও অনেকের বিরুদ্ধেই। বর্তমান বিরোধীনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্যে করে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছিলেন, বাঘে ধরলে ছাড়ে হাসিনা ধরলে ছাড়ে না। ইউনূসরে ছাড়ছে। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আক্রমণ থেকে রেহাই পাননি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

যে জীবন তাদের: মরহুম ফজলুল কাদের চৌধুরীর বড় পুত্র সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৯ সালের ১৩ই মার্চ চট্টগ্রামের গুডস হিলে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক পাস করেন। পেশায় ব্যবসায়ী এ রাজনীতিবিদ দু’পুত্র আর এক কন্যার জনক। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ পর্যন্ত মোট ছয় বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৮ সালে মুসলিম লীগে যোগদানের মাধ্যমে তার রাজনীতির শুরু।

১৯৮৫ সালে যোগ দেন জাতীয় পার্টিতে। ১৯৮৮ সালে নিজেই গঠন করেন এনডিপি। ১৯৯৬ সালে এনডিপি বিলুপ্ত করে যোগদেন বিএনপিতে। এরশাদ জমানায় মন্ত্রী হিসেবে আর চারদলীয় জোট আমলে দায়িত্ব পালন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় একজন তুখোড় বিতার্কিক ছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।

প্রয়াত দেবেন্দ্রনাথ দত্তের পুত্র সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৫ সালের ৫ই মে সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। পরে সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে পাস করেন এলএলবি। সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদে ছিলেন অন্যতম কনিষ্ঠ সদস্য, স্বাধীন দেশের প্রথম সংসদ সদস্যসহ প্রায় সব সংসদেই নির্বাচিত হন তিনি। একাত্তরের রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা সুরঞ্জিত দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত পরিচিত ছিলেন ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে।

৫ই নভেম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করার আগে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় রথের মধ্যে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ থেকে নির্বাচিত হন তিনি। এরপর ১৯৯১ সাল পর্যন্ত কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে ন্যাপ, একতা পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলেও ১৯৯৬ সালে বড় দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নির্বাচনে হারের স্বাদ নিতে হয় তাকে। আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার পর সুরঞ্জিত বিভিন্ন সময়ে বলেন, আগে ছিলাম ছোট দলের বড় নেতা, এখন হয়েছি বড় দলের ছোট নেতা। সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে নিজের নির্বাচনী এলাকায় ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর অবশ্য সংসদ সদস্য শরিফ উদ্দিন আহমেদের মৃত্যুতে হবিগঞ্জ-২ আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সংসদে আসেন সুরঞ্জিত। পরে প্রধানমন্ত্রীর সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টাও হন।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে বিরোধী দল থেকে একমাত্র সদস্য ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। জরুরি জমানায় সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সে সময়কার প্রেসিডিয়াম সদস্য। শেষ কথা: আপনি তাদের পছন্দ করতে পারেন। অপছন্দও করতে পারেন। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ছাড়া বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাস লেখা সম্ভব নয়।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আলোচিত থাকতে চেয়েছিলেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নিশ্চিতভাবেই তিনি তা থাকবেন। কথার কারিগর সুরঞ্জিতকেও কেউ ভুলতে পারবে না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।