পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাভাষী মানুষের প্রতি আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই! কাশ্মীর সমস্যা:একটি ঐতিহাসিক দলিল
[সৌজন্যে:স্বাধীনতার পরে ভারতের জ্বলন্ত সমস্যা(পৃ:৮৮---১৪৫)—প্রবীর ঘোষ]
“আমি আত্মহত্যাকে অন্যায় মনে করিনা,
আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকেও না,
নারী-পুরুষের প্রেমময় অসামাজিক সম্পর্ককে
অশ্লীল ভন্ডামি মনে করি না,
বৈষম্য জিইয়ে রেখে যারা জাতীয় সংহতির কথা বলে
তাদের ভন্ডামি ও অশ্লীলতা দেখলে মাথায় খুন সওয়ার হয়!”---পারভীন সুলতানা
দেশপ্রেম যখন পণ্য
বড় অসময়ে এ-লেখায় হাত দিয়েছি?নাকি এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়?
“যুদ্ধের খবর পাবলিক দারুণ খাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি পত্রিকারই বিক্রি বেড়ে চলেছে হু-হু করে। এই সময় অন্য খাবার খাওয়ানো মুশকিল”। জুনের মাঝামাঝি নিজ পত্রিকা দপ্তরে বসে বলছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার সহ-সম্পাদক।
এলাহাবাদ থেকে উড়ে কলকাতায় এসেছিলেন হিন্দি ম্যাগাজিনের এক বড় প্রকাশক।
উদ্দেশ্য—এই কার্গিল যুদ্ধের বাজার থাকতে থাকতে একটা বাংলা দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা। যুদ্ধ আজ প্রচার মাধ্যমগুলোর কাছে পণ্য। যুদ্ধে মৃত সেনারা আজ পণ্য। ভারত-পাকিস্তান দু-দেশের প্রচার মাধ্যমই তাদের নিহত সেনাদের বীরত্ব-কাহিনী,দেশের জন্য আত্মত্যাগকাহিনী প্রচার করে দু-দেশের মানুষদের মধ্যে অন্তসারশূন্য দেশপ্রেমের আবেগের বান ডাকাচ্ছে। যুদ্ধ তহবিলে বিয়ের কনে সব গয়না দিয়ে দিচ্ছেন,বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুতো পালিশ করা রোজগার তুলে দিচ্ছেন,চাকুরেরা একদিনের মাইনে দিয়ে দিচ্ছেন,খেলোয়াড়-গায়ক-গায়িকা,সিনেমার নায়ক-নায়িকারা নিজের নিজের দেশের সেনাবাহিনীর মনোবল বাড়াতে ছুটে যাচ্ছেন অগ্নিগর্ভ সীমান্তে।
দু’দেশের একই চিত্র।
বিয়ের কনে থেকে ছাত্র সবাই যে,আবেগে ভাসতে ভাসতে এমনটা করে ফেলে,তা’ নয়। অনেকে এই সুযোগে চমক দিতে চায়। ছাপোষা চাকুরেদের চাওয়া,না চাওয়ারও পর অবশ্য মাইনে কাটা নির্ভর করে না। আর এই সামান্য টাকায় যুদ্ধের খরচের হাজার ভাগের একভাগ না উঠলেও দেশপ্রেমকে তেজি করার ব্যাপারটা মন্দ জমে না।
চাকুরেদের অবস্থাটা কিল খেয়ে কিল হজম করার মত। পারফর্মারদের কাছে প্রায়শই এই যুদ্ধ,এই মৃত্যু-পণ্য। যাঁরা মরেছেন তাঁরা দেশপ্রেমের জন্য না মরলেও চাকরির জন্য মরেছেন। মানুষ মরছে,মারছে মানুষই। ওদেশের সেনা মরলে এদেশের মানুষ উল্লাসে ফেটে পড়ছে।
এদেশের সেনা মরলে ওদেশের মানুষের রক্তে বীরত্ব ছলাৎ ছলাৎ করে উঠছে। কি ভয়ঙ্কর অমানবিক ব্যাপার!
এরা কি সকলেই দেশপ্রেমিক?দেশপ্রেম মানে কি সরকারের পক্ষে প্রশ্নাতীত আনুগত্য?অন্যরকম হলেই দেশদ্রোহী? ‘দেশপ্রমিক’ ও ’দেশদ্রোহী’ চিহ্ণিত করবে কারা?আপাদমস্তক ধান্দাবাজী ও দুর্নীতিতে ডুবে থাকা রাজনীতিকরা? স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরেও যে দেশের শতকরা পঞ্চাশভাগ মানুষ পানযোগ্য জলটুকু পায়না,শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ সরকারের কাছ থেকে পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেনা,যে দেশের তিরিশভাগ মানুষের মাথার ওপর চাল নেই,প্রতিদিন এক বেলা ভাত বা রুটি জুটলেই যথেষ্টর বেশি,সে দেশের মানুষ যদি বলে, “ভাত দে হারামজাদী,নাইলে মানচিত্র ছিঁড়ে খাবো”---তবে তারা কি দেশদ্রোহী বলে চিহ্ণিত হবে? শিক্ষার সুযোগ-বঞ্চিত ক্ষুধার্ত মানুষ জানেনা,কার্গিল খায়, না মাথায় মাখে। ওরা জানে না,কারণ পত্রিকা পড়া বা টি.ভি দেখার মত বিলাসিতা করা সুযোগ ওদের নেই। বঞ্চিত শোষিত মানুষদের অধিকার অর্জনের লড়াইকে আমরা কি দেশদ্রোহিতা বলবো? যারা দারিদ্রসীমার নীচের বঞ্চিত মানুষগুলোকে মিথ্যে আশার বাণীতে ভুলিয়ে শোষণপ্রক্রিয়াকে গতিশীল রেখেছে,সেই দুর্নীতির পাঁকে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা রাজনীতিকরাই কি ঠিক করে দেবে ‘দেশপ্রেমিক’ ও ‘দেশদ্রোহী’র সংজ্ঞা?
দেশ মানে তো মাটি-নদী-পর্বত নয়;মানুষকে বাদ দিয়ে দেশ হয়না। দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি প্রেম।
নাগরিকদের অধিকার লাভে বঞ্চিত মানুষদের প্রতি প্রেম। দেশপ্রেমের এই সংজ্ঞাটিকে ও ছকটিকে মাথায় রাখলে,দেশপ্রেমিক ও দেশদ্রোহিদের চিনে ফেলা সহজ হয়।
কাশ্মীর নিয়ে বাহান্ন বছর(এই লেখার সময় পর্যন্ত)ধরে ভারত-পাক যুদ্ধ দফায় দফায় কম হলো না। এ এক ভয়ঙ্কর সমস্যা। ভারত-কাশ্মীর-পাকিস্তানের আত্মঘাতী সমস্যা।
“যুদ্ধ নয়,শান্তি চাই”---শুধুই কি শ্লোগানের জন্যেই শ্লোগান হয়ে থাকবে?নাকি শান্তি আনতে আমরা দু-পক্ষই আন্তরিক হবো?.........
কাশ্মীর---তুমি কার?
পঞ্চাশ বছরের ওপর ভারত ও পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে বিতর্ক ও উত্তেজনা জীইয়ে রেখেছে। কাশ্মীর সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারত-পাক উত্তেজনা ও ছোট-বড় যুদ্ধ চলবেই। যে সব রাজনৈতিক চিন্তাবিদ থিঙ্কট্যাঙ্করা ভারত-পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিধর হয়ে ওঠার পর ঘোষণা করেছিলেন,এতে করে দু-দেশের মধ্যে যুদ্ধ সম্ভাবনার অবসান ঘটল---তাঁদের সমস্ত চিন্তা-ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করেই দু-দেশ এখন যুদ্ধে উত্তাল। কারণ সেই কাশ্মীর সমস্যা। দু-দেশের রাজনীকিতরা ও রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থেই আমজনতার কাছে দেশপ্রেমিক সাজতে চায়।
এইসব সাজা দেশপ্রেমিকরা কোনও দিনই কাশ্মীর সমস্যার স্থায়ী সমাধান করবে না,করতে পারবেনা। কাশ্মীর নিয়ে স্থায়ী সমাধানের উপায় মাত্র তিনটি। এক:দু-দেশের দখলে থাকা কাশ্মীর অংশকে সেই সেই দেশেরই অংশ বলে মেনে নেওয়া। দুই:দু-দেশের দখলে থাকা কাশ্মীরবাসীরাই ঠিক করুক তাদের ভবিষ্যৎ,তারা স্বাধীন থাকবে,অথবা ভারত বা পাকিস্তানের রাজ্যবাসী হিসেবে থাকবে---তা সে স্বায়ত্বশাসন নিয়ে হোক,কী রাজ্য হিসেবেই হোক। তিন:কাশ্মীরবাসীদের স্বাধীনতার দাবি মেনে নেওয়া।
...(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।