একই আবর্তে
মে মাসের চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছিল মিসেস মারফির ব্যাক্তিগত বোর্ডিং বাড়িটির ওপর। অতীতে এই চাঁদের আলো আরো বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে পড়ত; একদিন সেইসব অঞ্চল সমূহ আবিষ্কৃত হবে; অন্তত বর্ষপঞ্জী তাই বলে। বসন্ত ছিল তার উদ্বেলিত যৌবনে আর উচ্চন্ড তাপদাহ ছিল তার অনুসারী। উদ্যানগুলো ভরে উঠেছিল নতুন সবুজ পাতায় আর পশ্চিমা ও দক্ষিণের ব্যাবসায়ীদের দিয়ে। ফুল আর গ্রীষ্মকালীন পান্থনিবাসের দালালরা ভেসে বেড়াচ্ছিল; বাতাস আর ল’সনের প্রতি উত্তর দিনকে দিন নম্র হয়ে আসছিল।
সর্বত্র বাজছিল হ্যান্ড-অরগান, বয়ে চলছিল ঝর্ণা আর সেই সাথে চলছিল তাস খেলা।
মিসেস মারফির বোর্ডিং বাড়ির জানালাগুলো ছিল খোলা। একদল বোর্ডার বাড়ির সিঁড়িঘরে জার্মান প্যানকেকের মত গোল হয়ে বসেছিল।
তিনতলার এক রাস্তামুখী জানালায় মিসেস ম্যা’কেস্কি তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রাতের খাবার ঠান্ডা হচ্ছিল টেবিলের ওপর।
আর খাবারের উত্তাপ প্রবেশ করছিল মিসেস ম্যা’কেস্কির শরীরে।
নয়টায় মি ম্যা’কেস্কি বাড়ি ফিরলেন। তার হাতে ছিল কোট আর ঠোঁটে পাইপ। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে সেখানে বসে থাকা মানুষগুলোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কারন যদিও তিনি সবার গা বাঁচিয়ে সিঁড়ির ঠিক মাঝখানের পাথরটিতে পা ফেলছিলেন তবুও তার নয় নম্বর সাইজের জুতাটা সিঁড়িতে বসে থাকা মানুষগুলোর জন্য বেশ বিরক্তির সৃষ্টি করছিল।
তিনি ঘরে ঢুকে বড় বিস্মিত হলেন। প্রতিদিনের মত স্টোভের ঢাকনা আর পটেটো-ম্যাশার ছুটে এলোনা তার দিকে। তার বদলে এলো শুধু বাক্যবাণ। মি ম্যা’কেস্কি বেশ বুঝতে পারছিলেন যে মে মাসের ঐ মায়াবতী চাঁদখানা তার স্ত্রীর স্তন দুটোকেও বেশ কোমল করে তুলেছে।
রন্ধন সামগ্রীর পরিবর্তে কিছু বাক্যগোলা তার দিকে ছুটে এলো “আপনি আসলেন তাহলে!
রাস্তার ঐ ইতর মেয়ে মানুষগুলোর ফ্রকে পা দিয়ে ঠিকইতো ক্ষমা চেয়ে নিতে পার।
অথচ নিজের বউ এর কাছে এলে ঐ পা’টাই তুলে দাও আমার ঘাড়ের ওপর। আর আবার তাতে কিনা চুমুও খেতে বল! প্রতি শনিবারেই তো পকেটের পয়সা ফুরানোর আগ পর্যন্ত গ্যালিগারদের ওখানে মদের পর মদ গেল। আর আমি ঘরে বসে বসে তোমার জন্য রান্না করা খাবার ঠান্ডা হতে দেখি”।
“থামো তো” এই বলে মি ম্যা’কেস্কি তার কোট আর হ্যাটখানা চেয়ারের ওপর ছুড়ে মারলেন। “তোমার এই রাত-বিরাতের চেঁচামেচি আমার ক্ষুধায় জ্বলতে থাকা পেটের প্রতি একটা অপমান।
জানো তো শিষ্টতা থেকে সরে এলে সমাজের ভিত্তির ইটগুলোর মাঝ থেকে চুন আর সুরকিগুলো ঝড়ে ঝড়ে পড়তে থাকে। আরে ঐ মহিলারাই তো একে অপরের সাথে পাল্লা দিয়ে আমার রাস্তা আটকে বসে ছিল। আর তাদের শরীরের ওপর দিয়ে আমাকে হাটতে বাধ্য করছিল। কিন্তু তাই বলে তুমি তাদের ঐ কাজের জন্য আমার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলে আমার মত ভদ্রলোকের মেজাজ বিগড়ে দিতে পারনা। এখন মুখখানা আর শূয়োরমুখো না করে আমার খাবারের একটা ব্যাবস্থা কর।
”
মিসেস ম্যা’কেস্কি খুব ধীরে চুলার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার চলনের মধ্যেই এমন একটা কিছু ছিল যা মি ম্যা’কেস্কিকে বেশ সতর্ক করে তোলে। মিসেস ম্যা’কেস্কির মুখের পাশের চামড়াগুলো যখন একটা ব্যারোমিটারে মত নিচে নেমে যায় তখনই তা পরবর্তী তৈজসপত্রের ঝনঝনানিপূর্ণ এক যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বানী হয়ে দাঁড়ায়।
“আমি শূয়োরমূখী!” এই বলে মিসেস ম্যা’কেস্কি শূয়োরের মাংস আর টার্নিপ সমেত স্ট্যুর কড়াইটা তার সংসার রাজ্যের রাজার দিকে নিক্ষেপ করলেন।
এ ধরনের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সম্পর্কে মি ম্যা’কেস্কি একটুও নবিস নন বরং যথেষ্ঠই তড়িৎকর্মা।
তিনি খুব ভাল করেই জানতেন তার স্ত্রীর এই হেন আক্রমনের প্রতিআক্রমন কিভাবে করা উচিত। টেবিলের উপর ‘শ্যামরক’ দিয়ে পরিপাটি করে সাজান এক বাটি ভাজা মাংস ছিল। তিনি তাই দিয়ে আক্রমন শানালেন আর তার বদলে পেলেন মাটির গামলা ভর্তি পুডিং এর গোলা। স্বামী কর্তৃক নিক্ষিপ্ত সুইশ পনিরের একটা বড় খন্ড মিসেস ম্যা’কেস্কির এক চোখের নিচে এসে আঘাত করল। এর প্রত্যুত্তরে যখন মিসেস ম্যা’কেস্কি গরম, কাল আর আধা সুবাসিত তরলপূর্ণ কফির পাত্র ছুড়ে মারলেন তখনই এই যুদ্ধ যজ্ঞের একটা সুষ্ঠু পরিসমাপ্তি ঘটতে পারত।
কিন্তু মি ম্যা’কেস্কি পঞ্চাশ সেন্টে বিকনো সস্তা ‘টেবিল ডোউট’ নন। বর্বর যাযাবরেরাই শুধু কফির মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। তারা অমন সমাজ বিরুদ্ধ অশিষ্ট আচরণ করতে থাকুক। মি ম্যা’কেস্কি ছিলেন তাদের চেয়ে অনেক বেশী শিষ্ট। হাত ধোয়ার পাত্রগুলো তার অভিজ্ঞতার বাইরে ছিল না।
যদিও ওগুলো ‘পেনশন মারফির’ আওতাভুক্ত নয় কিন্তু তাদের সমগোত্রীয়রা তার হাতের কাছেই ছিল। বিজয় সুনিশ্চিত জেনে মি ম্যা’কেস্কি তার বিবাহ সূত্রে প্রাপ্ত শত্রুর মস্তকখানা উদ্দেশ্য করে গ্রানাইটের প্রলেপ দেয়া জলপাত্রটা ছুড়ে মারলেন। অবশ্য মিসেস ম্যা’কেস্কি সময়মত সরে গিয়ে নিজের মাথাটা বাঁচালেন। আর সেই সাথে তিনি ছুঁড়ে মারার জন্য হাতে তুলে নিলেন একটা ইস্তিরি। তিনি আশা করেছিলেন যে এই অস্ত্রের মাধ্যমেই ঐ দিনকার মত তাদের ভোজনবিলাসী দ্বন্দযুদ্ধের একটা ইতি টানবেন- যা ছিল তার সুশীল মননেরই পরিচায়ক।
কিন্তু নিচের দিকের তলায় উচ্চস্বরের বিলাপ তাকে আর তার স্বামীকে একটি অনৈচ্ছিক যুদ্ধবিরতিতে উপনীত হতে বাধ্য করল।
বাড়িটার কোণার দিককার ফুটপাথের ওপর ক্লিয়ারী নামের একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার একখানা সতর্ক কান খাড়া হয়েছিল ঐ বাড়ির তৈজসপত্র ভাঙচুরের শব্দের প্রতি।
“নিশ্চয়ই আবার জন ম্যা’কেস্কি আর তার বউ মল্লযুদ্ধ শুরু করেছে। আমার কি উপরে গিয়ে ব্যাপারটা থামান উচিত? না আমি যাব না।
ওদের মতন বিবাহিতের জীবনে এমন আনন্দের ক্ষণ খুব কমই আসে। নিশ্চয়ই ওদের এখন এই যুদ্ধের রসদ যোগানোর জন্য হাড়ি পাতিল ধার করতে হবে। ” এসব কথাই পুলিশটি স্বগতোক্তীর মত আওড়াচ্ছিলেন।
আর ঠিক এই সময়েই নিচের দিককার তলায় একটা উচ্চগ্রামের শব্দ শোনা গেল যা ভীতি অথবা প্রচন্ড দুর্দশার বার্তা বহন করছিল। “এটা মনে হয় বিড়াল সম্পর্কিত কিছু একটা হবে” এই কথা বলে ক্লিয়ারী উল্টো পথে হাটা শুরু করলেন।
সিঁড়িতে বসে থাকা বোর্ডাররা বেশ উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন। মি টমি যিনি কিনা জন্ম থেকেই ইন্সুরেন্স কোম্পানীর একজন আইনজ্ঞ এবং পেশায় একজন গোয়েন্দা, এই চিৎকারের কারন অনুসন্ধানে ভেতরে ঢুকলেন। তিনি এই বার্তা নিয়ে ফিরলেন যে মিসেস মারফির বাচ্চা ছেলেটা হারিয়ে গেছে। বার্তাবাহকের পেছন পেছন মিসেস মারফিও একটা বলের মত এসে গড়িয়ে পড়লেন। কান্নায় আর মূর্ছারোগে বিধ্বস্ত দুইশ পাউন্ড ওজনের ঐ মহিলাটি তার ত্রিশ পাউন্ড ওজনের তাম্রবর্ণের অনাসৃষ্টিকারী সন্ত্বান হারিয়ে যাওয়ার বেদনায় আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে চিৎকার করতে লাগলেন।
সত্যিকারের ব্যাথস। ওদিকে মি টমি গিয়ে বসলেন টুপি ব্যাবসায়ী মিস পুর্ডির পাশে। সহানুভূতির তাড়নায় তারা জড়িয়ে ধরলেন একে অপরের হাত। ওয়ালশ নামের দু’জন বৃদ্ধ পরিচারিকা যারা কিনা এই ঘরের বাচ্চাদের হুড়োহুড়ি নিয়ে সবসময়ই অভিযোগ করতেন, আজ তারাই সবার আগে তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেন। ঘড়ির পেছন দিকটায় কেউ খুঁজে দেখেছে কিনা সেই খবরও নিলেন।
একদম উপরের সিঁড়িতে স্থূলকায় স্ত্রীর পাশে বসে থাকা মেজর গ্রিগ উঠে দাঁড়িয়ে তার কোটের বোতাম আটকে নিতে নিতে বললেন “বাচ্চা ছেলেটা হারিয়ে গেছে? আমি পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজব”। তার স্ত্রী তাকে কখনই অন্ধকার নামার পর বাড়ির বাইরে যেতে দেন না। কিন্তু সেই তিনিই কিনা তার পৌরুষপূর্ণ কন্ঠে বললেন “যাও লুডোভিক। যে এই শোকার্ত মায়ের দুঃখ দূর্দশা দেখেও তাকে সাহায্য করে না তার হৃদয় তো পাথরের তৈরী”। মেজর বললেন “আমাকে ত্রিশ কি ষাট সেন্ট দাও।
পথ হারিয়ে বাচ্চারা অনেক সময় খুব দূরে চলে যায়। আমাকে গাড়ি ভাড়া করতে হতে পারে”।
বৃদ্ধ ডেনি চার ঘর পেছনে হল রুমের সবচেয়ে নীচের সিঁড়িটাতে বসে সাঁঝবাতির আলোয় একটি পত্রিকা পড়ার চেষ্টা করছিলেন। কাঠমিস্ত্রীদের ধর্মঘট সম্পর্কিত অনুচ্ছেদের বাকি অংশটুকু পড়ার জন্য পাতা ওল্টাচ্ছিলেন তিনি। মিসেস মারফি চাঁদের দিকে চেয়ে আর্তনাদ করে উঠলেন “ও! আমার মাইক! খোদার দোহাই লাগে কেউ আমাকে বলো আমার ছোট্টো বাচ্চাটা কোথায়”।
বৃদ্ধ ডেনি নির্মাণ-শিল্প বাণিজ্যের ওপর প্রকাশিত প্রতিবেদনটির দিকেই তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে মিসেস মারফিকে প্রশ্ন করলেন “শেষ বারের মত ওকে কখন দেখেছিলে”?
বিলাপের সুরে মিসেস মারফি বললেন “আহ! হয়ত গতকাল কিংবা…… চার ঘন্টা আগেও হতে পারে। আমি জানি না। কিন্তু হায়! আমার বাচ্চা, আমার মাইক হারিয়ে গেছে। এই তো আজ সকালেই তো ও ফুটপাথের ওপর খেলছিল- নাকি আমি বুধবারের কথা বলছি?
আমি কাজে এতটাই ব্যাস্ত থাকি যে দিন তারিখ ঠিক মনে রাখতে পারি না। তবে আমি পুরো বাড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজেছি।
কিন্তু আমার সোনামানিক তো হারিয়ে গেছে। হায় ঈশ্বর”!
এই বড় শহরটা এর সমালোচকদের সামনে এভাবেই নিশ্চুপ, কদাকার আর প্রকান্ড রূপে দাঁড়িয়ে থাকে। নগরবাসীরা বলে যে এই শহরটা লৌহের মতই নিষ্ঠুর; তিল পরিমাণ করুণাও নেই এর বুকে। ওরা এই শহরের রাস্তাগুলোকে জনমানবহীন বন আর লাভার মরুভূমির সাথে তুলনা করে। কিন্তু গলদা চিংড়ির শক্ত খোলসের নিচেও তো মনোরম আর সুস্বাদু একটা পিন্ড থাকে।
হয়ত উপমাটা যথোপযুক্ত হল না। তবুও আমার এ কথায় কারও মনোকষ্ট পাওয়া উচিত হবে না। পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া আমরা কাউকে গলদা চিংড়ি বলে আখ্যায়িত করব না।
একটা শিশুর পথভুলে হারিয়ে যাওয়ার মত বিপত্তি আর নাই। দুনিয়ায় কোন ধরনের বিপদই মানুষের হৃদয়কে এতখানি নাড়া দেয় না।
শিশুদের পা’গুলো বেশ অনিশ্চিত আর দূর্বল। আর তাই ওদের জন্য পথগুলোও হয় খুব দূর্গম আর অদ্ভুতুড়ে।
মেজর গ্রিগ কোণার দিকটায় ছুটে গেলেন। তারপর সোজা বিলিদের ওখানটায় গিয়ে এক চাকরকে জিজ্ঞেস করলেন “আমাকে একটা কথা বল তো, তুমি কি এখানে কিংবা আশেপাশে কোথাও ছয় বছর বয়সী ধনুকের মত বাঁকানো পা’ওয়ালা নোংরামুখো একটা ছেলেকে দেখেছ? ঐ যে- যে ছেলেটা হারিয়ে গেছে, দেখেছ ওকে”?
সিঁড়ির উপরে মিস পুর্ডি তখনও মি টমির হাত ধরে বসেছিলেন। “কি ভয়ংকর ঘটনা তাই না? মায়ের কোল থেকে হারিয়ে যাওয়া ঐ বাচ্চাটা হয়তো এতক্ষণে কোন তাগড়া ঘোড়ার ক্ষুরের নিচে গিয়ে পড়েছে”।
মি টমি মিস পুর্ডির হাতটা জোরে চেপে ধরে তার সাথে ঐক্যমত প্রকাশ করলেন। “তাই তো। তুমি যদি বলো তবে আমিও বের হই, বাচ্চাটাকে খুঁজে বের করতে ওদের সাহায্য করি”।
মিস পুর্ডি বললেন “হয়ত তোমার তাই করা উচিত। কিন্তু তুমি তো অত্যধিক সাহসী আর বেপরোয়া।
মনে কর এই উৎসাহের তোড় তোমার জন্য কোন বিপদ ডেকে আনল। তখন আমার কি হবে বল”?
বৃদ্ধ ডেনি মধ্যস্থতা চুক্তির ওপর করা প্রতিবেদনটির প্রতিটি লাইন বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন। ওদিকে মি ম্যা’কেস্কি আর তার স্ত্রী তাদের দ্বিতীয় দফা ঝগড়ার প্রস্তুতি নেবার জন্য তিন তলার সামনের দিককার জানালায় এসে দাঁড়ালেন। মি ম্যা’কেস্কি তার তর্জনীটা বাঁকিয়ে ফতুয়ায় লেগে থাকা টার্নিপের দাগ তুলছিলেন। আর মিসেস ম্যা’কেস্কি তরকারির লবন লাগা চোখটা ভাল করে মুচ্ছিলেন।
নিচ তলায় কারো আর্তচিৎকার শুনতে পেয়ে তারা দু’জনেই জানালা দিয়ে মাথা বের করলেন।
মিসেস ম্যা’কেস্কি খুব শান্ত গলায় বললেন “ছোট্ট মাইকটা হারিয়ে গেছে। ছোট্ট ফুটফুটে শয়তানটা হারিয়ে গেছে”।
জানালা থেকে মাথাটা সরিয়ে নিতে নিতে মি ম্যাকেস্কি বললেন “বাচ্চাটা কি পথ ভুল করল? অতটুকুন বাচ্চাটা হারিয়ে গেল! পুরোটাই একটা বাজে ব্যাপার। যদি কোন মহিলা হারিয়ে যেত তাহলে বেশ হত।
কারন ওরা যাবার সময় শান্তিকে পেছনে ফেলে যায়। কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোপুরিই ভিন্ন”।
স্বামীর দেয়া খোঁচাটা পুরোপুরি অগ্রাহ্য করে মিসেস ম্যা’কেস্কি উল্টো তার হাতটা জড়িয়ে ধরলেন। আর খুব আবেগী গলায় বললেন “জন, মিসেস মারফির ছোট্ট ছেলেটা হারিয়ে গেছে। কত বড় এই শহর আর ও ঐটুকু একটা বাচ্চা।
ওর বয়স তো ছিল মাত্র ছয়। জন, ছয় বছর আগে যদি আমাদের একটা বাচ্চা হতো তবে আজ ওর বয়সও একই হতো, তাই না”।
“আমাদের তো কখনও কোন সন্তান ছিল না” খুব ধীরে ধীরে কথাটা বললেন মি ম্যা’কেস্কি।
“কিন্তু যদি থাকত! ভেবে দেখ জন আমাদেরও যদি একটা বাচ্চা থাকত আর যদি সে আজকে এই রাতে হারিয়ে যেত। আমাদের ছোট ফেলান যদি হারিয়ে যেত; যদি এই শহর তাকে চুরি করে নিত; যদি আর ওকে কোথাও খুঁজে না পেতাম, এখন তবে কি কষ্টটাই না থাকত আমাদের মনে”।
মি ম্যা’কেস্কি বললেন “তুমি বোকার মত কথা বলছো। আমি আমার ছেলের নাম ক্যানট্রিমে থাকা ওর বুড়ো দাদার নামে রাখতাম- প্যাট”।
কোন ধরনের রাগ না করেই মিসেস ম্যা’কেস্কি বললেন “তুমি একটা মিথ্যুক। গেঁয়ো ম্যা’কেস্কির চেয়ে আমার ভাইয়ের নামটা দশগুণ বেশী ভাল। ওর নামেই আমি আমার ছেলের নাম রাখতাম”।
তারপর তিনি জানালার বাইরে মাথা ঝুঁকিয়ে নিচের দিককার শোরগোল দেখলেন আর খুব নরম গলায় বললেন “জন, আমি দুঃখিত। আমি তোমার সাথে বাজে ব্যাবহার করেছি”।
তার স্বামী বললেন “বরং বল এ কারনেই পুডিংগুলো বেশ দ্রুত সাবার হয়েছে। পুরো টার্নিপও চালান হয়ে গেছে। আবার সাথে ছিল কর্মউদ্দীপক কফিও।
এটা কিন্তু দ্রুত খাবার খাওয়ার এক অভিনব পন্থা। আচ্ছা যাও, মাফ করে দিলাম। আর মিথ্যা বলতে হবে না”।
মিসেস ম্যা’কেস্কি তার স্বামীর শরীরের মধ্যে নিজেকে এলিয়ে দিলেন। তার খসখসে শক্ত হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিলেন।
মিসেস মারফির অসহায় কান্না শুনে তিনি বললেন “একটা বাচ্চার জন্য এত বড় একটা শহরে হারিয়ে যাওয়া মারাত্মক ভয়ংকর একটা ব্যাপার। জন, আমাদের ছোট্ট ফেলান যদি আজ হারিয়ে যেত তবে বোধ হয় আমার হৃদয় ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যেত”।
হঠাৎই মি ম্যা’কেস্কি তার স্ত্রীর হাতের মধ্য থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নিলেন কিন্তু পরক্ষণেই সেই হাতটা তার স্ত্রীর কাঁধের এক পাশ জড়িয়ে ধরল। আর তিনি কেমন একটা রুক্ষ্ম স্বরে বললেন “আমি হয়তো খুব বোকার মত কথা বলছি। তবুও আমার ছেলে- প্যাট যদি আজ অপহৃত হতো কিংবা ওর খারাপ কিছু একটা হতো তাহলে হয়ত আমি নিজেকে কেটে দু’টুকরো করে ফেলতাম।
কিন্তু আমাদের তো কোনদিন কোন বাচ্চা ছিল না। জুডি, কখনও কখনও আমি তোমার সাথে নিষ্ঠুর আর বাজে আচরণ করেছি। তুমি ওসব কথা মনে রেখ না”।
তারা একত্রে জানালা দিয়ে ঝুঁকে নিচে চলতে থাকা হৃদয় বিদারক নাটকটা দেখতে থাকলেন। অনেক ক্ষণ তারা ওভাবেই বসে ছিলেন।
রাস্তার ধারে অনেক লোক জড় হচ্ছিলেন। তারা বিভিন্ন রকম প্রশ্ন, উড়ো খবর আর অপ্রাসঙ্গিক সব আশঙ্কার মাধ্যমে পুরো এলাকার বাতাস ভারি করে তুলেছিলেন। ঐ ভিড়ের মধ্যেই মিসেস মারফি সমস্ত দিক চষে বেড়াচ্ছিলেন। তাকে দেখে একটা নরম পাহাড় বলে মনে হচ্ছিল যার বুকে বয়ে চলছে ঝর্ণার কান্না। সংবাদ বাহকেরাও নানা রকম খবর নিয়ে আসছিল আর যাচ্ছিল।
হঠাৎই বোর্ডিং বাড়িটির সামনে নতুন উৎসাহে চিৎকার চেঁচামেচি শোনা গেল।
মি ম্যাকেস্কি জিজ্ঞেস করলেন “জুডি, এখন আবার কি হল ওখানে”?
“এটাতো মিসেস মারফির কন্ঠস্বর” এই বলে মিসেস ম্যা’কেস্কি নিচের দিকে ঘটতে থাকা ঘটনাগুলো বোঝার চেষ্টা করলেন। আর তারপর তার স্বামীকে জানালেন “ও বলছে যে শেষ পর্যন্ত ছোট্ট মাইককে খুঁজে পাওয়া গেছে। বাচ্চাটা বিছানার নিচে গোল করে পেঁচিয়ে রাখা কার্পেটের পেছনে ঘুমিয়ে পড়েছিল”।
মি ম্যাকেস্কি হো হো করে হেসে উঠলেন।
তারপর ব্যাঙ্গ করে বললেন “এই তোমার ফেলাম! আমাদের কখনও কোন বাচ্চা ছিল না। কিন্তু আমাদের- প্যাট যদি আজকে হারিয়ে যেত অথবা চুরি হতো তাহলে তো ঠিকই ওকে শয়তান বলে সাব্যস্ত করতে। এখন যাও ঐ ছোকড়াটাকে ফেলান বলে ডাক। আর দেখ কিভাবে ও খাটের নিচে কুৎসিত কুকুরছানার মত লুকিয়ে থাকে”।
মিসেস ম্যা’কেস্কি খুব ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁড়ি পাতিল রাখার থাকের দিকে এগিয়ে গেলেন।
ভিড় ভাঙ্গতেই পুলিশ ক্লিয়ারী তার আগের জায়গায় ফিরে এলেন। এবারও তার একটা কান খাড়া হয়েছিল ম্যা’কেস্কিদের অ্যাপার্টমেন্ট বরাবর। আর আগের বারের মত এবারও সেখানে লোহা আর চিনামাটির তৈরী বাসনকোসনের ঝনঝনানি শুনে বেশ বিস্মিত হলেন তিনি। ক্লিয়ারী তার ঘড়ি বের করে সময়টা দেখে নিলেন।
“অসহ্য, মিসেস ম্যা’কেস্কি আর তার স্বামী সোয়া এক ঘন্টা ধরে মারামারি করছেন।
এতক্ষণে তো তিনি তার স্বামীর ওজন চল্লিশ পাউন্ড বাড়ানোর ব্যাবস্থা করতে পারতেন”। এই কথা বলতে বলতে ক্লিয়ারী কোণার দিকটায় চলে গেলেন।
বৃদ্ধ ডেনি পত্রিকাটা ভাঁজ করে নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন। কেননা আজকে রাতের মত মিসেস মারফি তার বোর্ডিং বাড়ির দরজাটা বন্ধ করে দিতে যাচ্ছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।