আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার জাপান যাওয়া...৪

বাংলাদেশের মাটি দিয়ে গড়া এক মানুষ সকাল সাড়ে ৮টায় বের হলাম। শীতের কারনে গায়ে কোর্ট টাই। বিলাসবহুল গাড়ীতে উঠে দেখলাম আরও বিভিন্ন দেশের ছাত্র-ছাত্রীরা। আমাদের দলে আমি, তারেক, মনোয়ার, আহসান, লিটন, জাফর ও নাজমা। সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলছি মনের সুখে।

পাশ থেকে হিন্দি, পেছন থেকে উর্দু শুনতে পাচ্ছি। সবার গন্তব্য একটি কনভেশন সেন্টারে। সকাল সোয়া ৯টায় পৌছলাম, সাড়ে ৯টায় শুরু হলো অনুষ্ঠান। এ ধরনের প্রোগ্রামের অভিজ্ঞতা নেই। জাপানীদের সর্ম্পকে বা বিদেশে কোন অনুষ্ঠানে নিজেকে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে কি ধরনের কান্ড কারখানা করতে হয় তাও অনেকাংশে অজানা।

গ্রামের ছেলে, ম্যনার্স বলে যে একটি শব্দ আছে তার সাথে পরিচিত হতে সবে শুরু করেছি। তারপরও কোন মতে চালিয়ে যাচ্ছি। পরিচিত পর্বের শুরুটা সবার মতোন ইংরেজিতে চালিয়ে নিলাম। মাঝে দু'চারটি জাপানীও বলতে শুরু করেছি। দেখছি তার ফল বেশ ভালই।

জাপানী গুড্ডু গুড্ডু ছাত্রীরা ইতিমধ্যে নিজেদের খোলস থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। আমার নাম হয়ে গেল কাজী। কাজী, ও গেনকি দেস কা..বললে গেনকি দেস। অর্থাৎ কাজী কেমন আছো, আমি বলছি ভালো আছি। আগে ভাগে জানিয়ে ওয়াথাসি ওয়া নিহন নো স্কুশি দেস..অর্থাৎ আমি খুব অল্পই জাপানি জানি।

দেখলাম যতটুকু জানি ততটুকুতে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আমার টিম লিডার বেশ খুশিই হলো। এরই মধ্যে পরিচয় হলো পাকিস্তানী ছাত্র বাবর, ছাত্রী ইয়াসমিন, নওরিন, আজমার সাথে। হিন্দি ছবির বদৌলতে তাদের সাথে উর্দু চালিয়ে নিলাম। তাদের অনেকে অবাকহলো।

বললাম, সবে তো শুরু। তবে ইংরেজি চালাতে হলো মালদ্বীপ, ভুটান, শ্রলীংকার ছাত্র ছাত্রীদের সাথে। তাদের নামগুলো মনে রাখা বেশ কষ্টকর। মালদ্বীপের লুসিয়া মুসা, শ্রীলংকার নামালি গুনাসাকেরার সাথে পরিচিত হলাম। জাপানীরা বেশ কিছু প্রশ্নপত্র দিলো।

এগুলো পুরন করে দিলাম। বুঝলাম তারা আমাদের নিয়ে আসার পেছনে একটিই মাত্র কারন কোন বিষয়ে নতুন কিছু বের করা। এখানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মোটামুটি সবাই কম বেশি ট্যালেন্ট। কারন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বেস্ট ছাত্র ছাত্রীদের সিলেকশন করে তারা জাপানে আমন্ত্রন জানিয়েছে। তাদের প্রশ্নের মধ্যে ছিল বেশ কিছু গবেষনাধর্মী বিষয়।

তবে তখন যে বয়স ছিল তাতে এসব কিছু ভালো লাগছিল না। কোন মতে বের হয়ে ভিন্ন দেশের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে বন্ধুত্ব করার দিকে সবার নজর ছিল। আমার আর তারেকের মধ্যে বেশ একটি পার্থক্য ছিল, তা হলো আমি ছাত্রলীগের আর ছাত্র দলের। তার সাথে দেখলাম পাকিস্তানীদের বেশ খাতির হয়ে গেল। আর আমার সাথে জাপানী ছাত্রীদের।

পর পর তিনদিন এ ধরনের আনুষ্ঠানিক বিষয় ছিল। তিনদিনে দেখলাম বাংলাদেশী তারেকের নাম পাকিস্তানী মেয়েরা সবাই মুখস্ত করে ফেলেছে। তবে জাপানে কাজুকো শব্দটি ব্যাপক পরিচিত হবার সুবাদে আমার কাজী নামটিও জাপানী ভালোই উচ্চারন করে। তারেক একবার এসে টেনে নিয়ে পাকিস্তানী বেশ কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। তাদের মধ্যে একজন ইয়াসমিন (মেডিকেলের ছাত্রী), নওরিন (ডিপ্লোমেট) এবং আজমা।

বেশ ভালই কাটছিল দিনগুলো। পাকিস্তানীদের মধ্যে ইয়াসমিন বেশ সুন্দরী। তার আচার ব্যবহারও চমৎকার। পেশওয়ার এর ইউনিভার্সিটি টাউনে বাড়ী। সে একদিন প্রশ্ন করে বসল, তুমি পাকিস্তানীদের এড়িয়ে চলো কেন? হঠাৎ করে প্রশ্ন করায় তেমন সুবিধা মতো উত্তর দিতে পারলাম না।

বললাম, কই নাতো। ইয়াসমিন মুচকি হেসে বললো, তোমার চেহারা দেখে বুঝতে পারছি তুমি প্রশ্নটিও এড়িয়ে যাচ্ছো। আসল কথা হলো সে বিষয়টি ধরে ফেললো। কারন একটিই, প্রগতিশীল রাজনীতি করি, তাই ৭১ এর যুদ্ধে পাকদের নির্যাতনের কথা মনে পড়ে যায়। কতবার তাদের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দিয়েছি।

কতবার বক্তৃতায় ঘৃনাভরে তাদের প্রত্যাখান করেছি। এখন এমন একটি বাস্তবতায় কি করবো বুঝতে পারছি না। আশ্রয় নিলাম দলনেতার কাছে। বললাম, পাকিদের সাথে তো স্বাভাবিক হতে পারছি না। তিনি বুদ্ধি দিলেন, সব ভুলে মিলে মিশে যাও, তাদের সুযোগ পেলে বলো, ৭১ এ তাদের সেনা জান্তা অসহায় বাঙ্গালীদের কি নির্যাতন চালিয়েছিল।

নিজের সাথে অনেক বোঝা পড়া করলাম। তাদের একটি জিনিষ আমার ভালো লাগতো, দেখা হলেই অবলিলায় বলে দিতো, আচ্ছালামু আলাইকুম। তাদের সালামের রেওয়াজ দেখলাম, সকালে, বিকালে, দুপুরে যখনই সামনে পড়তাম, সালামটা আগে দিয়ে দিতো। শেষপর্যন্ত ইয়াসমিনের সাথে স্বাভাবিক হতে পারলাম। উর্দুর সাথে হিন্দির মিল থাকায় আলোচনা জমাতে সময় লাগলো না।

তবে সে আবার প্রশ্ন করে বসলো, কোন কারন ছাড়াতো এড়িয়ে চলা যায় না। কি কারন, পড়লাম মুছিবতে। চিন্তা করলাম ,তাকে বলে ফেলাই ভালো। তাকে বললাম, তুমি জান ১৯৭১ এর কথা। বলল, শুনেছি।

ইয়াসমিন আমার কাছে শুরুতে ক্ষমা চেয়ে বললেন, নতুন প্রজম্ম ৭১ এর এ ঘটনার জন্য অবশ্য লজ্জিত। বলল, তার পরিবার পাকিস্তান পিপপলস পার্টির সমর্থক। বাবা-চাচারা পেশওয়ারের নেতা। এখানে তাদের বেশ প্রভাব আছে। তাকে বললাম, ৭১ এর কথা মনে হওয়ার কারনে স্বাভাবিক হতে সময় লেগেছে।

ইয়াসমিন বললেন, এবার নিশ্চয় স্বাভাবিক হওয়া যাবে..ক্ষমা তো চেয়ে নিছি। তারপর থেকে তার সাথে বেশ বন্ধুত্ব হলো। অনেক কিছু জানলাম। একে একে নওরিন, হুমায়রা, আজমা, বাবর প্রায় সবার সাথে সমানে মিশতে লাগলাম। তাদের সাথে মিশে যে বিষয়টি বুঝলাম, তা হলো তাদের লেখাপড়ার স্ট্যার্ডান্ড আমাদের চেয়ে অনেক ভালো।

এরা প্রায় সবাই অনর্গল ইংরেজি বলতে পারে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।