আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিক

ডুবে যাওয়া জাহাজের নাবিক টোকন ঠাকুর লবণাক্ত রোদ, বালি বালি মহাদেশ, উচ্ছ্বসিত ফেনা, ঢেউয়ের পর ঢেউ, আদিগন্তের পাখি কিংবা অনেক জাহাজডুবির গল্প নিয়ে সমুদ্র হয়ে যাওয়া চোখ দুটো_ এ বাক্য দীর্ঘ, তবে সম্পূর্ণ নয়। এ বাক্যে নিষ্পত্তি সম্পন্ন হয়নি। সম্পন্ন হয়নি চোখ দুটো কার? কার চোখের মধ্যে শঙ্খচিল, ডানা মেলে দেয় জলস্তরের শূন্যতায়? কার চোখের মধ্যে বালি বালি মহাদেশ, চোখের মধ্যে মানচিত্র, মানচিত্রের মধ্যে অসংখ্য পতাকা! পতাকায় লেগে আছে রক্ত, পতাকার মধ্যে যুদ্ধের ইতিহাস। যুদ্ধের মধ্যে নিহত অনেক প্রাণ, নিহত স্বপ্ন, নিহত ভালোবাসা। ভালোবাসার মধ্যে কী আছে, তা তো লেখ্য নয়, আলেখ্য।

স্বপ্নের মধ্যে কী ছিল, কী থাকে তার সীমিত ধারণাটুকু হয়তোবা পাওয়া যায়। হয়তো স্বপ্নের মধ্যেও জেগে আছে আরও কোনো মহাদেশ, কিন্তু গোচরে আসছে কেবল একটা দ্বীপ, একটা স্বপ্নের দ্বীপ। কারা বাসিন্দা, দ্বীপের? লবণাক্ত রোদে পোড়া দ্বীপ। হয়তো একটি ছেলে আর একটি মেয়ে থাকে এ দ্বীপে। সারাদিন সমুদ্রের হাওয়ায় মেয়েটির অবাধ্য চুল উড়ে যায়।

কোনো কাজ নেই, ভালোবাসা ছাড়া। ভালোবাসাইবা কী? সমুদ্রের ঢেউকে জিজ্ঞেস করলে সে কি বলতে পারবে, ভালোবাসাটা কী? কেন মানুষ ভালোবাসার এক চরম প্রাপ্তিকালে সমুদ্রের কাছে চলে আসে? মেয়েটির মনে কি রাগ হয়? সে রাগ দেখায়, সে প্রশ্ন করে, সে লাল কাঁকড়ার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামে_ 'তুমি কি খালি লাল কাঁকড়ার দৌড়াদৌড়ি দেখবা?' ছেলেটি বালিপৃষ্ঠা থেকে চোখ না তুলেই জবাব দেয়, 'খালি লাল কাঁকড়াই না, দ্যাখো বালির ওপর কাঁকড়ারা কী সুন্দর আল্পনা করে রাখছে। ' 'তুমি কি আল্পনা দেখতেই আসছ?' 'সমুদ্র দেখতে আসছি। ' 'ওহ'। মেয়েটি আহত হয়, 'আমি না সমুদ্র, কোনটা বড়?' ছেলেটি বুঝতে পারে, এ প্রশ্ন শুধু প্রশ্নই নয়।

এর মধ্যে আরও কিছু আছে। সে ঘুরে তাকায়, হাত বাড়ায়, মেয়েটি মুখ নিচু করে, ছেলেটি সরে যায় তার কাছে, তাকে দু'হাতে জাপটে ধরে শুয়ে পড়ে তীরলগ্ন বালির ওপর। এ কী! এ তো দেখি বাংলা সিনেমা! নায়ক-নায়িকা জড়াজড়ি করছে সমুদ্রের তীরে! অবশ্য সমুদ্রের সেই শক্তি আছে। আছে বলেই অমাবস্যার রাতেও হানিমুন হয়ে চলে। নবদম্পতিরা নির্বাক হয়, সমুদ্র গর্জন করে।

ঢেউ আছড়ে আছড়ে পড়ে। সমুদ্র-লবণ ঢুকে পড়ে নবসম্পর্কের মধ্যে। হাসি হাসি চোখে-মুখে ছবি তোলা হয়। সমুদ্র থেকে ফিরে যাওয়ার পর, সে ছবি একদিন পুরনো হয়ে যায়। পুরনো ছবির হাসি হাসি মুখ দেখে মনে পড়ে, একদিন সমুদ্রে যাওয়া সেই লবণাক্ত সম্পর্কের স্বাদ।

সেই স্বাদ কোথায় হারায়? সেই স্বাদ খুঁজে পাওয়া যাবে, আবার সমুদ্রে গেলে? 'চলো না, এবার বড় ছুটিতে আবার আমরা সমুদ্রে যাই, ক'দিন ঘুরে আসি?' তারপর তারা কি সমুদ্রে আসবে? সমুদ্রে গেলেই কি সেই লবণাক্ত, হারানো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাবে? সে আশায় সমুদ্রে এসে, সম্পর্কের অবশিষ্টাংশ চুকিয়ে খালি মুখে শূন্য বুকে বাড়ি ফেরা মানুষ কি নেই? আহারে! সমুদ্র কিছুই দেয়নি তাদের। সমুদ্র কি আসলে দিতে পারে? নাকি সমুদ্রকেই দিতে আসে মানুষ? যখন সমুদ্রে আসি, আমার ইচ্ছাটা আমার। নাকি সমুদ্রই ডাক দেয়? যেমন_ মাঝে মাঝে আমি ভাবি, পাহাড়ও কী কম ডাকে, নাকি আমিই উৎকর্ণ বেশি? তবে সমুদ্রে এলেই, মনে মনে আমি নাবিক। টের পাই, বন্দরের পর বন্দর ছাড়িয়ে ভেসে চলেছে আমার জাহাজ। তবে কি আমার জাহাজের বন্দরে ভেড়ার নেশা নেই? বন্দরের টান নেই? নাকি 'যদি বন্দরে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পাই, জাহাজ ভেড়াব না, অর্ডার করব, কাপ্তেন, গভীর সমুদ্রে চলো'_ এ আমার অভিপ্রায়? একদিন এক প্রবাল দ্বীপের তীরঘেঁষে আমি হেঁটেছি।

ঝাউবনের মধ্যে সারাদিন বসে থেকেছি। তীরে আছড়ে পড়া একেকটা ঢেউ কী বলতে চায়, তার যথার্থ অনুবাদ করতে চেয়েছি। জোয়ারভাটার মর্মার্থ নিয়ে ভেবেছি। সমুদ্রের কোনো অনুমতি ছাড়াই সমুদ্রকে বাংলা কবিতার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি কিংবা এটাও বলা যায়, বাংলা কবিতাকে স্বেচ্ছায়, ভালোবেসে সমুদ্রে ডুবিয়ে দিয়েছি। বাংলা কবিতা সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে বে-আব্রু ঢেউ হয়ে গেছে, ফেনা হয়ে গেছে।

বাংলা কবিতা হয়তো তীরে তীরে আছড়ে পড়েছে। নরনারী-যুবকযুবতীরা সে ঢেউয়ে, সে উচ্ছ্বসিত ফেনায় কিংবা সে কবিতায় আছড়ে পড়ে আনন্দে, এটা ভাবতেও আমার ভালো লাগে যে, আমি সেই আনন্দ-রচয়িতা। সমুদ্রের সঙ্গে এ রকম সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও আমি ডাঙায় থাকতে পারিনি, নাবিক হয়ে মহাসমুদ্রের ভেতর দিয়ে ভেসে চলেছি, প্রিয়তমা বন্দরের নেশায়। সত্যি, বহুকাল সমুদ্রের কুয়াশা লাগা হিম জমে আছে আমার টুপিতে, বহুদিন ঘুমিয়ে আছি জলের ওপর, বন্দর খুঁজে পাইনি। বন্দরের একটা স্কেচ করা আছে আমার মনে।

বুঝতে পারছি, সেই বন্দর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত জাহাজ দাঁড়াবে না। পথে, কত ঘাট-আঘাট, কত রকম বন্দরও হয়তো চোখে পড়ল। মনে হলো, এটাই কি সেই নোনাবন্দর, যার সন্ধানে আমি কয়েক যুগ সমুদ্রে ভেসে চলেছি? না, কোনো মায়া, কোনো মোহ আমাকে আটকে রাখতে পারেনি, এসব পোতাশ্রয়। কারণ আমার মন অন্বেষণ করে চলেছে সেই বন্দর, যা আমি আপন মনের স্বপ্নে দেখেছি। ক্রমাগত সেই বন্দরের নেশায়, বহুকাল একা একা, বহুদিন জনপদের বাইরে বাইরে কাটিয়ে দিলাম।

সমুদ্র আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। সমুদ্র আমাকে জনপদ থেকে বিচ্ছিন্ন করে তুলল। কারণ কী এই যে, ভালোবাসা ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ভালোবাসা বিচ্ছিন্ন করে দেয়? সমুদ্রে তীরের একটা স্মৃতিচিত্র আমি এখনও মনে রেখেছি। হোটেলের নরম বিছানা এড়িয়ে, তারুণ্যের প্ররোচনায় শুয়ে ছিলাম বালুর ওপর। সে রাতে জোছনা, সে রাতে সমুদ্র বড় মাতাল।

বালুতীরও টলে টলে যাচ্ছিল। গর্জন করছিল সমুদ্র। ঢেউ এসে হুঙ্কার দিয়ে আছড়ে পড়ে। পুরো বিচে আমি একা। দূরে হোটেলের বাতিঘরের আলো।

হঠাৎ দেখি, একটা-দুইটা-তিনটা বা কয়েকটা শাদা ঘোড়া দৌড়ে যায় কেশর ফুলিয়ে। শাদা ঘোড়ার শাদা ফেনার ঢেউ খেলে যায়। ব্যাকগ্রাউন্ডে জলরাশি কিন্তু জোছনায় জলস্তরও শাদা। জলস্তর অস্থিতিশীল, এ সময় কিংবা সব সময়ই। মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর, এখন, সমুদ্রতীরে শাদা ঘোড়াগুলো কোত্থেকে এলো? বিভ্রান্তি কি-না বুঝতে চেয়ে বালিতে চিমটি কাটি, বালি উঠে আসে আঙুলে।

তাহলে ঘোড়াগুলো এলো কোত্থেকে? একি শুধু চিত্রকল্পদ্রুম? তাছাড়া আমি কি সত্যি সত্যি মাঝরাতে ঘোড়াদল দেখলাম সমুদ্রতীরে? এ কি বাস্তবতা, নাকি পরাবাস্তবতা? সালভাদর দালি বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আলোচনা করা যেত। পরবর্তী সময়ে, সমুদ্রতীরে দৌড়ে যাওয়া মাঝরাতের সেই শাদা ঘোড়াদের নিয়ে আমি কখনও লিখিনি। আমি হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম শাদা কেশরের সেই ঘোড়াগুচ্ছের কথা। ভুলে গিয়েছিলাম যে, সমুদ্রের জল লবণাক্ত হওয়া সত্ত্বেও তীরে দাঁড়িয়ে একদিন চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে। অশ্রুতেও লবণ আছে।

তবে কি অশ্রু আর সমুদ্রজল একই উৎস থেকে আসে? সমুদ্রতীরের বালিতে আঙুল দিয়ে দাগ কেটে আমিও লিখেছি তোমার নাম, তুমি জানো না। বালির ওপর 'ভালোবাসি' লিখেছি, ঢেউ এসে সেই ভালোবাসা মুছে দিয়ে গেছে। ঝাউবনের মধ্যে বসে থেকে দেখেছি, ঢেউয়ের ওপর দিয়ে জলে চিকচিক করে ওঠে রোদ, মাছধরা নৌকাগুলো ঢেউয়ের তালে ওঠানামা করে, দূরে, আরও দূরে ছোট্ট পাখির মতো লাগে এমন এক জাহাজ ভেসে যায়। হয়তো দূরে বলেই জাহাজটাকে পাখির মতো লাগে। জলপাখি।

ঢেউপাখি। ইঞ্জিনপাখি। যন্ত্রপাখি। আসলে সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে, দূরবর্তী জাহাজকেও জলপাখি নামে ডাকা যায়। কী এক অবাক বিস্ময়! কী এক অপার বিহ্বলতা, সমুদ্রকে ঘিরে।

যে দেখেছে সমুদ্রকে, তার যেমন, যে দ্যাখেনি সমুদ্র তারও। বাংলাদেশের কত অংশ মানুষ এখনও সমুদ্র দ্যাখেনি, জানো? আমার ধারণা, ষাট ভাগ মানুষই সমুদ্রের সামনে যায়নি বা তাদের যাওয়ার সুযোগ হয়নি। এমনকি তাদের পাহাড়ও দেখা হয়নি। গভীর জঙ্গল দেখা হয়নি। কারণ সেসব মানুষ ঘরবন্দি হয়ে আছে।

শহরবন্দি হয়ে আছে। সমরবন্দি হয়ে আছে। খুব দুর্ভাগ্য তাদের, বন্দিত্বই তাদের নিয়তি হয়ে গেছে। তারা সমাজসংসার-বিধিবদ্ধ জীবনের কাছে বন্দি। হয়তো সমুদ্র তাদের ডাকে, তারা সে ডাক শুনতেও পায়।

কিন্তু ঘর থেকে বেরুতে পারে না। আমি সেসব বন্দি মানুষকে একবার সমুদ্র দেখাব, পাহাড় দেখাব, বনভূমি দেখাব, কবিতার ভেতর দিয়ে, স্বপ্নের ভেতর দিয়ে, ছবির ভেতর দিয়ে, ভালোবাসার ভেতর দিয়ে। সেই অভিপ্রায় নিয়ে, বারবার সমুদ্রে ছুটে যাই। সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ি। লোনাজলে স্নান করি।

বালিতে আঙুল দিয়ে নাম লিখি, স্বপ্ন লিখি, নিজের না পাওয়া লিখি। না পাওয়ারা জোড়া লেগে লেগে কবিতা হয়ে ওঠে। না পাওয়ারা যূথবদ্ধ হতে হতে ভালোবাসা হয়ে ওঠে। না পাওয়াকে পাইয়ে দেবে সমুদ্র, এটা ভেবে আমারও ভুল হয় বারবার। তবু কিছু ভুল ভালোবাসি।

কিছু ভুল ভালোবাসতেই ভাল্লাগে। কত কত জল, তবু সব জলই সমুদ্রজল নয়। কত কত মানুষ, তবু সব মানুষই সখা নয়, সখি নয়। কত কত চোখ, তবু সব চোখই সমুদ্র নয়। শুধু একজোড়া চোখেই সমুদ্র থাকে, সে কথা শুনেছি, সে কথা জানি।

সেই জোড়াচোখ খুঁজে চলেছি। কারণ সেই জোড়াচোখের মধ্যেই আছে লবণাক্ত রোদ, বালি বালি মহাদেশ, লাল কাঁকড়ার গুঁড়িগুঁড়ি আল্পনাকলা, আছে প্রিয় কাউকে পাওয়ার মতো উচ্ছ্বসিত ফেনা, পরম কিছু ধরার মতো চরমতর ঢেউ, আছে চরাচরের পাখি, কী যে তাদের স্বরলিপি, কী যে পাখির বর্ণমালা কিংবা আমি জানি, সেই জোড়াচোখের মধ্যেই লুক্কায়িত আছে জাহাজডুবির গল্প। ডুবে যাওয়া একটা জাহাজেরই নাবিক হতে চেয়ে, আমি সমুদ্রে ভেসে চলেছি। সমুদ্রে ডুবে যাওয়া একটা জাহাজের নাবিক। এই বাক্যও সম্পূর্ণ হলো না।

আগে তো সমুদ্রচোখ খুঁজে পেতে হবে। তারপরই সম্পূর্ণ হবে, সম্পন্ন হবে, নিষ্পত্তি হবে বাক্য... ........................................................................ কালের খেয়া, সমকাল, ১২.১০.২০১২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.