আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সীমান্তে হত্যাকাণ্ড ও ছিটমহল সমস্যা

চারপাশে কেবল চাপা আতঙ্ক। কখনো শোনা যায় গুলির শব্দ; আবার কখনো অপহরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন চলে। সঙ্গে নিরীহ মানুষের আহাজারি। এইতো আমাদের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোর প্রতিদিনের চালচিত্র। গত এক দশকে সীমান্তে প্রায় এক হাজার নিরীহ বাংলাদেশি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে নিহত হয়েছে।

কিন্তু এই মানবতাবিরোধী কার্যকলাপ বন্ধে ভারত সরকারের তেমন কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। তাইতো প্রতিনিয়ত বিএসএফের বন্দুকের গুলিতে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ বাংলাদেশিদের। হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন দীর্ঘদিন সীমান্তে বিএসএফের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও দৃশ্যত দায়মুক্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়াও আমাদের সরকার বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদ ও নানা ধরনের কুটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে পাওয়া যাচ্ছে দু:খ প্রকাশ, সমবেদনা এবং কিছু আশ্বাস। কিন্তু আবারো এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। বিএসএফের কাছে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন, মানবাধিকার, প্রতিবেশীসুলভ আচরণ সবই আজ ফিকে হয়ে গেছে। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের রেকর্ড অনুযায়ী ১ জানুয়ারি ২০০০ থেকে ৩১ আগষ্ট ২০১০ পর্যন্ত ৯৯৮ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে বিএসএফ। অতিসম্প্রতি তারা একের পর এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।

শুধু গুলি করে হত্যা নয়; পাশাপাশি তারা নানাভাবে নির্যাতন করে হত্যা করছে। নির্যাতনের পাশাপাশি চলছে ধর্ষণ, অপরহণ। গত এক দশকে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫ নারী এবং বিএসএফ কর্তৃক অপহরণের শিকার হয়েছে ৯৩৩ জন। এছাড়াও নিখোঁজ হয়েছে আরো ১৮৬ জন। আবার অনেক সময় মদ্যপ অবস্থায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে গ্রামের তরুণীদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছে।

কারণে-অকারণে লোকালয়ে ঢুকে কৃষকদের অপহরণ করেও নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইনে কোনো দেশ অন্য কোন দেশের নাগরিককে হত্যা করতে পারে না। কেউ যদি অন্যায় করে তাহলে তাকে গ্রেফতার করে সে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু বিএসএফ এসবের কোনটাই মানছে না। তাদের ওপর গুলির নির্দেশ না থাকলেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এসব বেআইনি হত্যার সঙ্গে জড়িত বিএসএফদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন কিনা তা স্পষ্ট নয় ।

একদিকে ভারত যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে আবার অন্যদিকে সীমান্ত আইনেও তারা অপরাধী। এছাড়াও সীমানায় স্থাপনা নির্মাণেও বেশ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে ভারতের সাথে। আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে সীমান্তের ১৫০ গজের মধ্যে কোন স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। কিন্তু বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ৫০ গজের মধ্যে (শর্তসাপেক্ষে) ১২টি পয়েন্টে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু-প্রতিম রাষ্ট্র।

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্যে-সহযোগিতা ইতিহাসে উল্লেখ্যযোগ্য এবং প্রশংসনীয়। এদেশটির সাথে আমাদের রয়েছে বিস্তৃত সীমান্ত। এ সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় চোরাচালান, অপতৎপরতা, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং যাবতীয় বেআইনি কর্মকাণ্ড ঠেকাতে রয়েছে উভয় দেশরই সীমান্তরক্ষী বাহিনী। কিন্তু ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী নানা অজুহাতে যখন-তখন গুলি করে নিরীহ বাংলাদেশীদের পাখির মতো হত্যা করবে, তা তো কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এতে যেমন বিশ্ব মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়, তেমনই নানা উদ্বেগও সৃষ্টি করে।

কারণ প্রতিটি মৃত্যুই মানবতার মৃত্যু। আবার এসব বিষয়ে একমত হতে কিংবা নিজেদের মধ্যে সমস্যা সমাধানের জন্য পতাকা বৈঠক, উচ্চ-পর্যায়ে বৈঠক ইত্যাদি ব্যবস্থা থাকলেও কার্যত কোন লাভ হচ্ছে না। ফলে সীমান্তে শান্তি আসছে না। সীমান্তবাসীর জীবনে স্বস্তি ফিরে আসছে না। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আরো একটি অন্যতম সমস্যা হল ছিটমহল সমস্যা; যা দীর্ঘ ছয় দশকের বেশি সময় ধরে অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে।

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে তেমন কোন ফলাফল মিলছে না। ১৯৪৭ সালের ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের সময়ই ছিটমহল সমস্যা সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের ১৬ মে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সই হওয়া চুক্তিতে দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় করার কথা ছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ বেরুবাড়ি ছিটমহল ভারতের কাছে হস্তান্তর করে। কিন্তু বিনিময়ে তেমন কোন সাড়া মেলেনি ভারত সরকারের কাছ থেকে।

১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ ভারতের অভ্যন্তরে থাকা দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহলে আংশিক যোগাযোগ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায়। বর্তমানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি এবং ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল রয়েছে; যেগুলি ১৯৭৪ সারে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি অনুসারে দু’দেশের মধ্যে বিনিময়ের কথা ছিল। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে আর তেমন কোন জোরালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এসব ছিটমহলবাসী মানবেতর জীবন-যাপন করছে। এসব ছিটমহলের অধিকাংশটিতেই নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা।

সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিবার পরিকল্পনা, জন্ম নিবন্ধন, ভোটার আইডি কার্ড, দুর্যোগকালীন সহযোগিতা, অবকাঠামো নির্মাণ, দুস্থ, প্রবীণ মহিলা ও প্রতিবন্ধী ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, স্যানিটেশন ইত্যাদির কোনোটাই নেই। সেখানকার আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভয়াবহ। এসব অঞ্চলে প্রতিনিয়ত চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ পাথরড়ুবি ইউনিয়নের মশালডাঙ্গা ছিটমহলাটির কথা। আমি ভূরুঙ্গামারী সদর ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়ায় খুব কাছ থেকে এ ছিটমহলবাসীর দু:খ-কষ্ট দেখেছি।

এ ছিটমহলে আনুমানিক ২৫-২৬ হাজার লোক বাস করে। ৪২ বাই ১৫০ গজের একটি ভারতীয় করিডোর দিয়ে বাংলাদেশের মূল ভূ-খণ্ডের সাথে যুক্ত হয়েছে মশালডাঙ্গা ছিটমহল। আর এই করিডোরের প্রবেশমুখে নির্মাণ করা হয়েছে একটি বিএসএফ চৌকি। এই ছিটমহলের ভেতর দিয়ে নির্মাণ করেছে একটি সড়ক। আর এ সড়ক দিয়েই নেওয়া হয়েছে ভারতীয় বিদ্যুৎ ও টেলিফোন লাইন এবং যে দেশের যানবাহনগুলো যাত্রী, মালামাল ও সামরিক লোকজন পরিবহন করছে।

ভারতীয় লোকজন অহরহ যাওয়া আসা করলেও ছিটমহলবাসীর চলাফেরার অনেকটাই নিয়ন্ত্রক বিএসএফ। বিভিন্ন সময় তারা নানা নির্যাতন, গ্রেফতারসহ হয়রানি করে আসছে ছিটমহলবাসীর। নানাভাবে লুট হচ্ছে গরু-ছাগল, ফল-ফসল, ঝাড়ের বাঁশ ইত্যাদি। এসব লোকজন নানা প্রকার সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এমনকি এরাও মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

এদের নেই জন্ম নিবন্ধন কার্ড, ভোটার আইডি কার্ড। অঞ্চলে বহুবিবাহ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রবণতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাসহ নানা রকম সামাজিক সমস্যা বিদ্যমান। আর এ চিত্রটি শুধু মশালডাঙ্গা ছিটমহলের নয়; এ দেশের অধিকাংশ ছিটমহলেরই একই অবস্থা। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী গতবছরের ৭ জানুয়ারি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী সীমান্তে পঞ্চদশী ফেলানী নামের এক কিশোরীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হত্যার পর তার নিথর দেহ প্রায় পাঁচ ঘন্টা কাঁটাতারের বেড়ার সাথে ঝুলিয়ে রাখে।

এ মর্মন্তুদ ঘটনার ১২ দিন পর ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশ স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। এরপর ১৯ জানুয়ারি অনুষ্টিতব্য বৈঠকে ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য দু:খ প্রকাশ করা হয়। সমবেদনাও জানানো হয়। ভারতের স্বরাষ্ট্র গোপাল কৃষ্ণ পিল্লাই (জি কে পিল্লাই) সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধে আশ্বাস দেন। এছাড়াও তাঁদের পক্ষ থেকে জানানো হয় ওই হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিএসএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তবে আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এরকম প্রতিশ্রুতি, আশ্বাস বহু মিলেছে। কিন্তু বাস্তবের তেমন কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি। তবুও আশায় বুক বেঁধে আছি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.