আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কর্পোরেট বৃত্তে বন্দী সম্ভাবনাময় যুবসমাজ

বেশকিছুদিন আগে কোনো এক বিকেল বেলা হলের মাঠে বসে বন্ধু কায়েসের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম। ওর সাথে আড্ডা মানেই সাহিত্য, গণিত, বিতর্ক আর বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠা। কেননা, এইসব বিষয়ে আপ-টু-ডেট থাকার ব্যাপারে আমার বড় একটা উৎসই হচ্ছে ও। ভার্সিটির ক্লাস, সেশনাল আর এক্সামের এতো এতো ব্যস্ততার মধ্যেও ও যে কীভাবে এইসব কো-কারিকুলাম এক্টিভিটিজের জন্য সময় বের করে, সেটা আমার কাছে একটা রহস্যই। প্রথমআলো বন্ধুসভা, গণিত অলিম্পিয়াড-গণিত ক্যাম্প ইত্যাদি ছাড়াও বুয়েটের বিভিন্ন ক্লাবে তার সরব উপস্থিতি।

তো যাই হোক, আলোচনার একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে, “ভিকারুন্নেসা এবং পারসোনার ঘটনাতে প্রথমআলোর ভূমিকাতো অনেকের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ। তা, এ ব্যাপারে তোদের অবস্থান কি?” (উল্লেখ্য, ভিকারুন্নেসার ঘটনাতে ভিক্টিম মেয়ের পোশাকের ব্যাপারটাকে হাইলাইট করায় ফেবু এবং ব্লগে প্রথম আলো বেশ সমালোচিত হয়েছিলো। আবার, পারসোনার ইস্যুতে ঘটনার তিনদিন পর বস্তাপচা খবরের ন্যায় ‘পারসোনার ভিডিওতে আপত্তিকর কিছু পাওয়া যায় নি’ রিপোর্ট প্রকাশ করেও তারা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলো। ) জবাবে আমি যা শুনলাম তা অনেকটা কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবার মতোই। পারসোনার ঘটনায় প্রথমআলোর রিপোর্টে আরো অনেকের মতো ও নিজেও ক্ষুব্দ হয়েছিলো।

তাই ফেসবুকে নিজের ওয়ালে ওই রিপোর্টের লিঙ্ক দিয়ে লিখেছিলো “এই তবে প্রথমআলোর আসল চেহারা!” কিন্তু ও বুঝতে পারে নি কীসে ও ঢিল ছুঁড়েছে। পোস্ট দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর কাছে ফোন আসে বাংলাদেশে গণিত আন্দোলনের কর্ণধারদের একজনের(ধরি, তার নাম ‘ক’) কাছ থেকে। (সঙ্গতকারণেই তাঁর নামপ্রকাশ করছি না। আমাদের অনেকের কাছেই তিনি পরম শ্রদ্ধেয়, দেশবরেণ্য একজন মানুষ। দেশজুড়ে তাঁর অনেক ভক্ত-শুভাকাংখী।

আমি তাই তাঁদের অনুভূতিতে আঘাতদান থেকে বিরতই থাকছি। ) তো, তিনি ওকে ফোন করেই বললেন, “কায়েস, এটা কি তুমি ঠিক করলা? গণিত পরিবারের একজন হিসেবে তোমার অবশ্যই এ ধরণের কিছু লেখার আগে আমাদের সাথে আলোচনা করা উচিত ছিলো। ” এরপর তিনি ওকে আরো বিভিন্ন কথা বুঝালেন। এই ধরণের ব্যাপারে ওর অবস্থান কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কেও বেশকিছু দিক-নির্দেশনা দিলেন। ফলে ওকে একরকম বাধ্য হয়েই ওই পোস্ট ডিলিট দিতে হয়েছিলো।

তাঁর প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই আমার কিছু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে, নিজের ওয়াল পোস্টে অভিমত ব্যক্ত করার জন্য কেনো তাঁর সাথে আলোচনা করা উচিত? এটা কি ব্যাক্তি-স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নয়? গণিত পরিবারের তথা বাংলাদেশের গণিত আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রথমআলো এবং তার সহদর প্রতিষ্ঠান গুলো অনেক ভূমিকা রেখেছে-একথা সত্য এবং এজন্য তারা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবী রাখে। সেটা তারা পাচ্ছেও। প্রথমআলো বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান জাতীয় দৈনিকে পরিণত হয়েছে এবং বড়োগলায় ডায়লগ দিতে পারছে, “যা কিছু ভালো, তার সঙ্গে প্রথমআলো!” কিন্তু তার মানে কি এই যে গণিত আন্দোলনের সাথে যুক্ত প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে তাদের মূল্যবোধ, অভিমত প্রথমআলো’র কাছে বন্ধক দিতে হবে? বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হিসেবে আজ প্রচণ্ড খারাপ লাগে যখন দেখি কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি(সিএসআর)এর নামে অনেক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানই এই কেন্দ্রের ভাবমূর্তিকে তাদের ব্যবসার পণ্য করতে চায়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, সেই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেই সুযোগ করে দিতে উঠে পড়ে লাগতে দেখা যায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেরই কতিপয় সদস্যদের। অবশ্য তাদেরই বা দোষ কি? দেশজুড়ে এতোবছর ধরে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে যে প্রতিষ্ঠানটি তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্যই বা কতটুকু? আমাদের দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে টাকা ঢালার সময় এলেই সব সরকা্রের থলিতে টান পড়ে।

ভাবগতিকে মনে হয়, এরাও সত্যজিত রায়ের ‘হীরকরাজা’র মতো জনগণকে অশিক্ষিত-অসচেতন করে রাখতেই বেশি আগ্রহী। এ অবস্থায় সবকটাকে “মস্তিষ্ক প্রক্ষেলন যন্ত্র”-এ ঢুকানো ভিন্ন আর তো কোনো উপায় দেখি না। গত ২৯জুলাই,২০১১(শুক্রবার) কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোসল করতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান ক্লোজআপওয়ান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উঠে আসা তারকা-সঙ্গীতশিল্পী এবং বিজ্ঞাপনী সংস্থা ‘মাত্রা’র কর্মকর্তা আবিদ শাহরিয়ার বাপী। আবিদের মৃত্যুর পর সমগ্র দেশবাসী শোকে বিহ্বল হয়ে শোক প্রকাশ ও সম্মাননা জানালেও রহস্যজনক ভাবে মাত্রা মালিক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অভিনেতা আফজাল হোসেনসহ কোনও কর্মকর্তা/কর্মচারী আবিদের মরদেহ দেখতে আসেননি, সম্মাননা জানাননি বা আবিদের পিতা-মাতাকে কোনও সান্ত্বনা প্রদানও করেননি। এমনকি আবিদের ব্যাবহৃত দু’টি মোবাইল ফোন ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি কোথায় কি অবস্থায় আছে তাও জানাবার প্রয়োজন মনে করেননি তারা।

বেঁচে থাকতে যে আবিদ তাদের কাছে এতো মূল্যবান ছিলো, মৃত্যুতে সে এতোটাই মূল্যহীন হয়ে গেলো? তবে এদের মতো কর্পোরেটদের জন্য কেনো আমাদের সম্ভাবনাময় যুবকে্রা তাদের মেধা, মূল্যবোধকে ব্যবহার করবে কিংবা এদেরকে ব্যবহার করতে দিবে? মূসা ইব্রাহীম-প্রথম বাংলাদেশী এভারেস্ট বিজয়ী। বর্তমানে তিনি সাব-এডিটর হিসেবে ইংরেজী দৈনিক ‘ডেইলী স্টার’ এ কর্মরত আছেন। তার এভারেস্ট জয়ের পেছনে প্রথমআলো গোষ্ঠী এবং গ্রামীণফোনের অবদান অনেক। কিন্তু আবিদ শাহরিয়ারের মৃত্যু নিয়ে তার একটি নোট আমার মনে প্রশ্ন জাগায়, তার কলমও কি আজ বিক্রি হয়ে গেছে ‘সিএসআর’ এর কাছে? তিনি তাঁর নোটে লিখেছেন, “সিএসআর'র কাজটা কি শুধুমাত্র লাইফ গার্ডের ওয়াচ টাওয়ার ব্র্যান্ডিং করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? আফসোস হলো- বিভিন্ন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান তাদের মেরুদন্ডটা যেন এসব তথাকথিত সিএসআরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে একেবারে বিকিয়ে দিয়েছে। যেহেতু তাদের কারো কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না, ফলে এসব সিএসআরকারী প্রতিষ্ঠান সেই সুযোগে ব্র্যান্ডিং পর্যন্তই তাদের কর্তব্য করে থেমে থাকছে।

বাকি 'এমপাওয়ারিং'টা হলো কি না, এই সিএসআর আদৌ মানুষের কোনো উপকারে এলো কি না, তা তাদের থোড়াই কেয়ার করলেও চলে। ” তার পুরো নোটের সাথেই আমি একমত। কিন্তু খটকাটা লাগে যখন দেখি, এর সবকিছুই তিনি লিখেছেন মূলত ‘রবি’ নামের একটি মোবাইল কোম্পানীকে উদ্দেশ্য করে, যেটি কিনা বাজারে গ্রামীণফোনের ব্যবসায়িক প্রতিদন্দ্বী। তবে কি এত এত মায়াকান্না, এত এত যুক্তি-এর সবই গ্রামীণফোনের স্বার্থে? কই তিনি তো একইক্ষেত্রে গ্রামীণফোনের ভূমিকা নিয়ে কোনো আওয়াজ তুললেন না। আমার এক এলাকাতো বড়ভাই বন্ধুসভার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

কিছুদিন আগেও এলাকায় গিয়ে মন্ত্রী-এমপিদের গুষ্টি উদ্ধার করে বক্তৃতা দিয়ে এসেছেন। তাঁর ফেসবুক ওয়ালে ঢুকলেই চোখে পড়ে জাতীয় নানা সমস্যার কথা, সরকার আর বিরোধীদলের নানা কীর্তিকলাপের খবর। কিন্তু আজ অব্দি তাঁকে তেল-গ্যাস, ভিকারুন্নেসা, পারসোনা কিংবা অঞ্জন চৌধুরীর কুকীর্তি নিয়ে ভুলেও কখনো মুখ খুলতে দেখিনি। এর মানে কি ধরে নেবো? তিনি এই ঘটনা গুলো আমলে নেন না, সমর্থন করেন নাকি তিনিও তাঁর মূল্যবোধ বিক্রি করে দিয়ে বসে আছেন সিএসআরকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে?? আমার বাবার এক সহপাঠী বন্ধু বর্তমানে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা(কিন্তু যুদ্ধাপরাধী নন)। বিধর্মী হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে তাঁর আচরণ আপন ছেলের মতোই।

তাঁর সাথে যতোদিন আমার দেখা হয়েছে, শতব্যস্ততার মধ্যেও আমার সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন, নিজে বসে আপ্যায়ন করিয়েছেন। সময় করতে পারলে আড্ডায় মেতেছেন। তাঁর সাথে যদি কেউ কোনোদিন খুব ঘনিষ্ট হয়ে আলোচনা করতে পারে কেবলমাত্র তাহলেই হয়তো জানতে পারবে তিনি কতোটা অজামাতি মানুষ। নিশ্চয়ই প্রশ্ন জাগছে, কিন্তু এরকম একজন লোক কেন জামায়াত করে? এ প্রশ্ন জাগাটাই তো স্বাভাবিক। এর কারণ হচ্ছে, তিনি যখন অভাব-অনটনের কারণে পড়াশুনা চালাতে পারছিলেন না তখন এই জামায়াত তাঁর পড়াশুনার খরচ চালিয়েছে।

তাঁকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়িয়েছে, বিদেশী ডিগ্রীধারী করেছে। তাই তিনি আজ ‘নেমকহারামী’ করতে পারেন না, পারেন না জামায়াতের সমালোচনা করতে, বরং তাঁদের অন্যায়েরই সাফাই গাইতে হয়। জামাতের এই টেকনিক আজো বহাল আছে। আজো তারা গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদেরকে এভাবে সুকৌশলে তাঁদের দলে ভেড়াচ্ছে। মূল্যবোধ কিনে নিচ্ছে দেশের ভবিষ্যত মেধাবী প্রজন্মের।

তাদেরকে পরিণত করছে তোতাপাখিতে। আর কর্পোরেট হাউসগুলোও বর্তমানে এই বহুলচর্চিত টেকনিককেই কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু এ থেকে বেরিয়ে আসার কি কোনোই উপায় নেই? আমার জানা নেই। আপনাদের জানা আছে কি?? আর যদি কোনো উপায় নাই থাকে তবে কি আমরা অদূর ভবিষ্যতে একটা তোতাপাখি প্রজন্মই পেতে যাচ্ছি??? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.