গর্জে ওঠার এইতো সময়.... তিতাস বাচাও, দেশ বাচাও পলাশী যুদ্ধের প্রহসনমূলক নাটক শেষ হতে না হতেই লুন্ঠিত হল মুর্শিদাবাদের রাজকোষ। সে সময় রাজকোষে কি পরিমাণ সম্পদ ছিল?
মুর্শিদকুলী খার শাসনকাল থেকে দীর্ঘ ৫৫ বছরের সঞ্চয় একত্রিত হয়ে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কোষাগারে পূর্ণিয়া যুদ্ধের পর সঞ্চিত ছিল সার্জন ফোর্থের প্রদত্ত হিসেব মতে মনিমুক্তা হিরা জহরতের মূল্য বাদ দিয়ে তৎকালীন মুদ্রায় ৬৮ কোটি টাকা (S. C. Hill, Bengali in 1757-67, Page-108) .
পলাশীর নাটক শেষ করে সিরাজ-উদ-দৌলারই দীওয়ান রামচাদ বাবু মুনশী নবকিষেণ, লর্ড ক্লাইভ ও মীরজাফরকে নিয়ে নবাবের কোষাগারে হাজির হন বিত্ত-সম্পদ লুট করার জন্য। দীওয়ান বাবুর তালিকার সাথে মিলিয়ে প্রাপ্ত সম্পদ তারা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। সিরাজ-উদ-দৌলার প্রাসাদে ও অন্দরমহলে রক্ষিত সম্পদ ভাগ করে নেন দীওয়ান রামচাদ, মুনশী নবকিষেণ, মীর জাফর আলী খান ও আমীর বেগ খান। (সিয়ারে মতাযেলি, ২য় খন্ড(অনুবাদ) পৃষ্ঠা-২৩)
মুর্শিদাবাদের রাজকোষ থেকে পাওয়া গেল পনের লক্ষ পাউন্ড অর্থাৎ ৩০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ।
ক্ষতিপূরণ হিসেবে বৃটিশ নৌবাহিনী এবং স্থল বাহিনীর ৬ জন সদস্যকে দিতে হল ৮ কোটি টাকা। সিলেক্ট কমিটির ৬জন সদস্যকে দিতে হল ৯লক্ষ পাউন্ড (১৮ কোটি টাকা), ক্লাইভ তার নিজের জন্য আদায় করলেন ২ লক্ষ ৩৪ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৩ কোটি টাকা), কাউন্সিল মেম্বাররা পেলেন ১থেকে ১.৫ কোটি টাকা করে।
এছাড়াও উৎকোচ, নিপীড়ন এবং আরো বিবিধ নীতি বহির্ভূত ঘৃণিত পন্থায় এ দেশের সম্পদ লুট করেছে বৃটিশ বেনিয়ারা। সিরাজের পতনের পর নবাবের শূন্য আসনটি কোম্পানীর অর্থোপার্জনের উৎসে পরিণত হয়। শিখন্ডি নবাবী কেনাবেচার মধ্যে দিয়ে কোম্পানীর নতুন ধরণের তেজারতি শুরু হয়।
কোম্পানি এবং তাদের কর্মচারীগণ যাকে খুশী তাকে নবাবের পদে অধিষ্ঠিত করতে পারতো এবং যাকে খুশি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতো। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত মাত্র ৮-৯ বছরে এ ব্যাপারে কোম্পানী ও তার দেশী বিদেশী কর্মচারীদের পকেটে যায় কমপক্ষে ৬২,৬১,১৬৫ পাউন্ড। প্রত্যেক নবাব কোম্পানীকে বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুযোগ সুবিধা দানের পরও বহু মূল্যবান উপঢৌকনাদি দিয়ে সন্তুষ্ট রাখতো। (বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, আব্বাস আলী খান, পৃষ্ঠা-৯৫)
মীরজাফর ক্ষমতায় আরোহণ করে টের পেয়ে গেলেন যে, তিনি প্রকৃতপক্ষে বাংলার নবাব নন, শিখন্ডি মাত্র। বলতে গেলে তিনি বৃটিশদের অর্থোপার্জন এবং শোষণের যন্ত্র।
সিরাজের প্রধান সেনাপতি থাকা অবস্থায় তিনি যে মর্যাদা এবং প্রতিপত্তির প্রতীক ছিলেন আজ নবাবীর আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তাকে কোম্পানীর সাধারণ কর্মচারীদের তোষামোদ করে চলতে হচ্ছে। তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য উৎকোচ, উপঢৌকন হিসেবে তাকে লক্ষ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করতে হয়েছে। কিন্ত তবু কোম্পানীর ক্ষুধা মেটেনি। রাজকোষের সমস্ত ভান্ডার উজার করে দিয়েও তিনি তার ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেন নি। ষড়যন্ত্রের শুরুতে তিনি ভেবেছিলেন ব্রাক্ষণ্যবাদী চক্র এবং ইংরেজ বণিকদের সহযোগীতা নিয়ে তিনিই হবেন উপমহাদেশের সবচেয়ে শক্তিশালী নবাব।
নবাবীর নেশায় তিনি এত উন্মত্ত মাতাল ছিলেন যে, ষড়যন্ত্রের গভীরে আর এক ষড়যন্ত্রকে আমলে আনতে পারেন নি। কিন্ত নবাবের পতনের পর যখন দেখলেন শক্তির সব সূত্রগুলো ছিন্ন-ভিন্ন, সব অমাত্যবর্গ উগ্র লালসা নিয়ে ক্লাইভের তোষামোদে ব্যস্ত, দেখলেন কোম্পানীর কর্মকর্তাদের দাপট, দেখলেন রাজকোষের নির্মম লুন্ঠন এবং লোপাট হতে দেখলেন নগর জনপদ গুলো। বাংলার নবাবা হয়ে তাকে দেখতে হল সবকিছু নীরবে, নিরুপায় হয়ে। দুর্বিসহ মনে হলেও কোম্পানীর সব অপকর্মকে সমর্থন দিতে হল হাসি মুখে। ক্লাইভের চোখে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটুকুও তার অবশিষ্ট রইল না।
সিরাজের পতনের সাথে সাথেই বাংলার মুসলমান হয়ে পড়ল অভিভাবকহীন। বাংলার মুসলমানদের জীবন-জীবিকা এবং অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের সব উৎসমুখগুলোতে আগুন জ্বলে উঠল। একের পর এক ধনী গরীব নির্বিশেষে বাংলার সব মুসলমান এগিয়ে চলল ধ্বংসের কিনারে।
(আগামী পর্বে সমাপ্য) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।