কেউ কেউ একা
২৩ জুন ছিল পলাশী ট্রাজেডির ২৫২ তম বার্ষিকী। ১৭৫৭ সালের ওই দিনে পলাশীর আম্রকাননের সংঘটিত যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর ও তার সাথীদের চক্রান্তে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের কাছে পরাজিত হন। অস্ত যায় বাংলার স্বাধীনতার সূর্য। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় বাংলার রক্তাক্ত ইতিহাস। আজও বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম মানুষ উচ্চারণ করে শ্রদ্ধার সাথে একজন দেশপ্রেমিক হিসেবে।
পাশাপাশি মীরজাফরদের নাম উচ্চারণ করে ঘৃণার সাথে দেশোদ্রোহী হিসেবে। সেদিন বাঙালিদের জন্য বাংলার স্বাধীনতা হরণ হয়েছে। যড়যন্ত্রের বেড়াজালে নবাবকে আটকে তারা হাসিল করেছে স্বার্থ। দেশপ্রেম সেখানে ছিল নিরর্থক। ভালবাসা অর্থহীন।
স্বার্থের মোহে অন্ধ হয়ে সেদিন বিশ্বাস ঘাতকেরা বাংলার স্বাধীনতা তুলে দিয়েছিল ভীনদেশীদের হাতে। বুঝতে পারেনি 'খাঁচায় বন্দি পাখির মর্মবেদনা'। কিন্তু পরে যখন তাদের ভুল ভাঙ্গে, সময় তখন অনেক গড়িয়েছে। সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে গত সকালের প্রত্যাশা তখন অলিক কল্পনা ছাড়া আর কিছূই না।
নবাব সিরাজউদ্দৌলা।
পুর নাম মীর্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা। জন্মেছিলেন ১১৩৩ সালে। পিতার নাম মীর্জা মুহম্মদ জয়েনউদ্দিন, মা ছিলেন আমিনা বেগম। নবাব আলিবর্দী খাঁর ছোট মেয়ে ছিলেন এই আমিনা বেগম। আলিবর্দী খাঁর কোন সন্তানাদি না থাকার কারণে আমিনা বেগমের পুত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে তিনি খুব ভালবাসতেন।
ছোটবেলা থেকেই তাকে ভবিষ্যতের নবাব বানাতে নানা ধরনের কাজকর্মে তাকে সাথে সাথে রাখতেন। এভাবে দিনে দিনে নবাব সিরাজউদ্দৌলা চৌকস হয়ে ওঠেন। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে বসেন তিনি। নিজের মহলের অনেকেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার এই সিংহাসনে বসা মেনে নিতে পারেনি। সিংহাসনের মোহে শুরু হয় গৃহবিবাদ।
বিশেষ করে নবাব আলিবর্দী খাঁর বড় মেয়ে ঘষেটি বেগম, মেঝো মেয়ের ছেলে শওকত জঙ্গ এবং ভগনীপতি সেনাধ্যক্ষ মীর জাফর- এরা কেউই নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে বসা সুনজরে দেখেননি। ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ ও ঘষেটি বেগমের সাথে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। পরিকল্পনা করতে থাকেন কীভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করা যায়।
ইরেজরা এদেশে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসার প্রথম থেকেই তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যকলাপের সাথে জড়িয়ে পড়ে। নবাব সিরাজউদ্দৌলার সিংহাসনে বাসার পর থেকে থেকেই ইংরেজদের উদ্ধত্যতা আরও বেড়ে যায়।
তারা নবাবের অদেশ অমান্য করে নানা ধরনের কাজ একের পর এক করেই যেতে থাকে। তার প্রমাণ নবাবের অনুমতি ছাড়াই নিজেদের স্বার্থ রক্ষার করার জন্য দুর্গ নির্মাণ কাজ শুরু করা। নবাব এর তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং দুর্গ নির্মাণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ইংরেজরা এ আদেশ অমান্য করে। যার ফলে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালের ২০ জুন কলকাতা দুর্গ অধিকার করলে নবাবের সাথে তাদের মতবিরোধ চরমে পৌঁছায়।
কলকাতা পতনের সংবাদ মাদ্রাজে পৌঁছালে কর্ণেল ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসন নিজেদের অপমানিতবোধ করেন। তারা নবাবকে উচিৎ শিক্ষা দেবার জন্য নানা রকম ফন্দি ফিকির আটতে থাকেন। শেষে নিজেদের শক্তি সংহত করে উপস্থিত হন বাংলায়। ১৭৫৭ সালের ফেব্রয়ারি মাসে তারা কলকাতা দুর্গ পুনর্দখল করেন এবং কুটকৌশলে অল্পকালের মধ্যে নবাবকে আলিনগরের সন্ধি স্থাপনে বাধ্য করেন।
এদিকে দিন দিন নবাব বিরোধী চক্রান্ত ঘনীভূত হয়ে ওঠে প্রাসাদে।
নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর, জগতশেঠ, রাজবল্লভ, ইয়ার লতিফ, উমিচাঁদ -এরা খুব বিশ্বস্ত এবং কাছের ব্যক্তি ছিলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করে এরাই নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার জন্য লর্ড ক্লাইভের সাথে গোপন চক্রান্তে লিপ্ত হয়। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন খবরা খবর পাচার করে বাংলার স্বাধীনতাকে তারা দিন দিন অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
লর্ড ক্লাইভ শক্তি সংগ্রহ করতে থাকে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলা থেকে উৎখাত করার জন্য। একসময় আলিনগরের সন্ধিভঙ্গের মিথ্যা অজুহাত এনে তারা নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রা করে।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন তারিখে পলাশী নামক গ্রামের আম্রকাননে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও ক্লাইভ পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ক্লাইভ সেনা মেতায়ন করে লক্ষবাগে। সকাল ৮টায় মীরমদন কামানে অগ্নিসয়যোগ করেন। আধা ঘন্টার মধ্যে ১০ জন গোরা ও ২০জন কালা সিপাহী মারা যায়। আধ ঘন্টা যুদ্ধ করে ক্লাইভ বুঝতে পারেন এভাবে নবাবের সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যাবে না।
তারা বাধ্য হয়ে গাছের আড়ালে বসে পড়ে। নবারের তোপমঞ্চগুলো ছিল ৪ হাত করে উঁচু। কামানের সব গোলা ইংরেজ সৈন্যদের মাথার উপর দিয়ে যেতে থাকে। ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ক্লাইভ উমিচাঁদকে বকাবকি করেন। উমিচাঁদ জানান, যারা যুদ্ধ করছে তারা মীরমদন ও মেহনলালের সেনাদল।
অন্যেরা কেউই যুদ্ধ করছে না। মীরমদন, মোহনলাল যেভাবে যুদ্ধ করছিল এমন করে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, রায়দুল্লভ এগিয়ে যেত তাহলে খুব অল্পসময়ের মধ্যেই ক্লাইভের সমর সাধ মিটে যেত।
ক্লাইভ কোন উপায় না দেখে জরুরি সভায় বসেন। সিদ্ধন্ত হয় সারাদিন লুকিয়ে থেকে আত্মরক্ষা করতে হবে। পালিয়ে থেকে ক্লাইভ যে পলাশীবিজেতা হয়েছিলন তা তিনি নিজেই বলে গেছেন।
যুদ্ধ চলছে। হঠাৎ দুপুরের দিকে আকাশ কাল করে বৃষ্টি নামে। সে বৃষ্টিতে ভিজে যায় নবাব পক্ষের অধিকাংশ বারুদ। যুদ্ধ চলতে থাকে ধীর গতিতে। নতুন করে বারুদ সংগ্রহের আয়োজন চলে।
এই সময় ইংরেজদের একটা কামানের গোলা এসে লাগলে মীরমদনের উরুস্থল ছিন্ন হয়ে যায়। মোহনলাল তাকে নবারের কাছে নিয়ে যেতে বলে। মীরমদনকে সবাই ধরাধরি করে নবাবের সামনে উপস্থিত করলে তিনি প্রধান সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতার কথা বলে মারা যান। নবাব মীরজাফরকে ডেকে পাঠান। মীরজাফর কালক্ষেপন করে নবাবের সামনে হাজির হলে তার কাছে রাজ্য রক্ষার বিনীত অনুরোধ জানান।
এ সময় নবাবকে প্রভাবিত করে মীরজাফর যুদ্ধ বন্ধের আর্জি জানান। নবাব তার কথায় প্রবাবিত হয়ে শিবিরে সৈন্যদের ফিরে আসতে বলেন। এই কথা শুনে চমকে উঠেন মোহনলাল। তিনি বলে পাঠান, আর মাত্র কিছু সময় পেলে তিনি শত্র“দের পরাজিত করতে পারবেন। এরপরও নবাব যুদ্ধ বন্ধ করতে নির্দেশ দিলে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যায়।
মীরজাফর ক্লাইভের কাছে লিখে পাঠান- রাত ৩টার দিকে নবাবের শিবির আক্রমণ করলে পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হওয়া যাবে।
ক্লাইভের অপেক্ষা সহ্য হয় না। আক্রমণ করেন নবাবের সৈন্যদের। মোহনলাল ও ফরাসী বীর সিনফ্রেঁ ঘুরে দাঁড়িয়ে আবার যুদ্ধ শুরু করেন। এদিকে মীরজাফর তার সৈন্যদল নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন ক্লাইভের সৈন্যদের সাথে যোগ দিতে।
শেষে বিকাল ৫টার দিকে সিনফ্রেঁ ও মোহনলাল যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন। নবাব শেষে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে বিদায় জানিয়ে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। একই বছরের জুলাই মাসের ২ তারিখে মীর জাফরের ছেলে মিরনের আদেশে মোহাম্মদী বেগকে দিয়ে বন্দি অবস্থায় নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব। তাঁর শাসনকাল এক বছর কয়েক মাসের বেশি স্থায়ী হয়েছিল।
সিংহাসনে আরোহণকালে তার বয়স ছিল মাত্র ২৩ বছর। ২৪ বছর বয়সে স্বদেশকে ভালবেসে, স্বদেশের মানুষকে ভালবেসে, স্বদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। আর এই বিশ্বাসঘাতকতার ফলে প্রায় ২০০ বছরের মত বাংলা ছিল পরাধীন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।