স্বপ্নবাজ। একটা রাতের রংধনুর স্বপ্ন দেখি...। -কিঙ্কর আহ্সান বাগান বিলাস
কিঙ্কর আহ্সান
বুবুদের বাড়ির সামনে ফুল ফোটে। লাল লাল ফুল। থোকায় থোকায় ফুটে থাকে।
সংখ্যায় অনেক। ওতে মধু হয়। প্রতিদিন বিকেলে মধু খাওয়ার জন্যে জড়ো হয় ছোট ছেলেমেয়েরা। তারা ফুল কুড়ায়। ছেড়া ফুলের মধু খায়।
তছনছ করে গাছের চারপাশটা। সরু সরু ঘাসগুলো পায়ে পিষে ভোতা করে দেয়। মটকে দেয় ঘাড়। কখনো কখনো ফড়িং ধরে। ভেঙে দেয় ডানা।
লাল, নীল হরেক রঙে সাজানো ফড়িংগুলো তখন আর উড়তে পারেনা। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে মাটিতে। বাড়ির গেটটাও ঢেকে আছে ফুলে। বাগানবিলাস ফুল। লতানো ঝোপ।
একেবেঁকে জড়িয়ে ধরে আছে পুরো জায়গাটা। ফুলগুলো যখন ঝড়ে তখন পুরো পথটা ঢেকে থাকে। পথটাকে দেখলে মনে হয় মস্ত এক ম্যাজেন্টা রঙের কুর্তা জড়িয়েছে গায়।
বাড়িটা দোতলা। ওপরতলায় বুবু থাকে আর নিচের তলায় মাহবুবারা।
ওরা ভাড়াটিয়া। অনেক বছর ধরে আছে এ বাড়িতে। মেয়েটার সাথে আমার জমত খুব। কলেজে ছুটিছাটা পেলেই এসে উঠতাম বুবুদের বাড়ি। কিছুতেই তখন পিছু ছাড়ত না আমার।
আসলে সবার সাথে মিশতে পারত না ও। কেন জানিনা আমাকে পছন্দ করল খুব। রাজ্যির গল্প এসে করত আমার সাথে। আমিও এই ছোট্ট মেয়েটাকে সময় দিতাম। দিনভর লুডু খেলতাম।
খেলতাম রুমাল চুরি, কলম লড়াই,এলাটিং-বেলাটিং সহ আরও নানান হিজিবিজি খেলা। এসব খেলা ছাদে বসেই হত। নিচ তলায় ওর বাড়িতে যাওয়া হত না কখনোই। মাহবুবা চাইতো না। বুবুও নিষেধ করত।
বলত,‘জানিস্ ওর একটা পাগল ভাই আছে। গেলেই কামড়ে দেয়। গো গো করে ডাকে। যাসনে কখনও। ’ কৌতুহল হতো আমার।
খুব ইচ্ছে হত নিচে ঢু মেরে আসি একবার। তবে লাজ-লজ্জার বালাই খেয়ে ওদিকে পা মাড়াইনি কখনও।
সেবার বাড়িতে সুজি নেই। বোনের মেয়ে জারা কাঁদছে সমানে। তার কান্নার জোরে পাচিলের ওপরের কাকেরা পালিয়েছে সব।
ভেন্টিলেটরে বাসা বাধা চড়ুইগুলোও চেচাচ্ছে তাল মিলিয়ে। বুবু আমাকে মাহবুবাদের বাসায় যেতে বললেন। সুজি পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্যে। ভয়ে ভয়ে গেলাম নিচে। টোকা দিলাম দরজায়।
বুকের ভেতরটা গম গম করছে। কোন না দত্যি-দানো এসে হানা দেয় আমার ওপর। দরজা খুলল মাহবুবার মা। মধ্যবয়স্ক। অল্পতেই বুড়িয়ে গেছেন মহিলা।
মাথার চুল অধিকাংশই সাদা। তবে চোখটা জ্বলজ্বলে। কেমন যেন মায়া মায়া ভাব। ভেতর থেকে শোনা যাচ্ছে চিৎকার। কান্নার আওয়াজ।
কে যেন কাঁচের জিনিষপত্র ভাঙছে। আমার কৌতুহল দেখে ভেতরে ডাকলেন মাহবুবার মা। পুরো ঘরের মেঝে ভর্তি ভাঙা কাঁচের টুকরো। আর এসবের জন্যে যে দায়ী সে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার সারা গায়ে ধুলো-ময়লা।
মুখে হাসি। বোঝা যায় ভাঙাভাঙির কাজ করে সে ভালই আনন্দ পাচ্ছে। মহিলা বসতে বললেন। তারপর নিজের ছেলেকে কোনোরকমে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলেন ভেতরের দিকে। আমি বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবনা ভাবতে লাগলাম।
এত বড় ছেলের এহেন আচরনের মানে কি। চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যায় ছেলেটির বয়স পনের পেরিয়েছে অনেক আগেই। কিছুক্ষন বাদেই ফিরলেন মহিলা। হাতের ছোট্ট বাটিতে সামান্য পায়েস। খেতে দিলেন আমাকে।
চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,‘ভয় পেয়েছ? ভয়ের কিছু নেই। ও আমার বড় ছেলে। লক্ষী ছেলে। ’ ভয় পাইনি বলে মাথা নাড়লাম আমি। তাকে দেখে মনে হল তিনি আরো কিছু বলতে চান।
অনেক অনেক কিছু। বললেন তিনি। তার ছেলের কথা। লক্ষী বড় ছেলের কথা। ছেলেটির বয়স তখন মাত্র চার।
এক সড়ক দূর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পায়। দুটো গাড়ির ঠোকাঠুকি। গাড়ি থেকে ছেলেটি ছিটকে পড়েছিল পথের ওপর। তারপর থেকে সে গায়ে গতরে বেড়েছে অনেকখানি। তবে ভেতরের চিন্তা ভাবনা থেকে গেছে ছোট্ট বাবুটির মতন।
এখনও সে আওড়ায় টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার। হাটতে পারেনা। মেঝেতে গড়াগড়ি খেয়ে ঘুড়ে বেড়ায় ঘরময়। ভয় পেলে মুখ লুকায় মায়ের বুকে। রাগে-ক্ষোভে কাঁদে গো গো করে।
কোনো চিকিৎসক’ই বাতলাতে পারেনি এর কোনো সমাধান। ছেলেটিকে নিয়ে মায়ের হুজ্জোতের শেষ নেই। সারাদিনই কাটে তাকে নিয়ে। ঘুম পাড়ানো,খাওয়ানো আরও কত কাজ। এই ছেলেকেই কিনা বাইরের লোকেরা বলে দত্যি-দানো।
অদ্ভুত। কথা শেষ করে মাহবুবার মা কাঁদলেন। মায়েদের কাঁদার বদঅভ্যাস আছে। মাথা ঘামালাম না। সেদিনের মত চলে গেলাম।
বুবুর ঝাড়ি খাওয়ার কোনো ইচ্ছেই নেই আমার । তারপর আসা হত প্রায়ই। সময় কাটত ছেলেটির সাথে। বয়াম ভর্তি লেবেনচুস নিয়ে আসতাম আমি। ভাইকে নিয়ে মাহবুবার লজ্জাও কেটে গিয়েছিল।
রং বেরংয়ের মার্বেল নিয়ে খেলতাম আমরা। মাঝে মাঝে একসাথে কালিবাড়ি রোড পেরিয়ে চলে যেতাম বি এম স্কুলের মাঠে। মস্ত মাঠ। মাঠ জুড়ে মানুষের ভীড়। চানাচুর আর ঝালমুড়িওয়ালা জমজমাট করে রাখত চারপাশ।
বিকেলে বিকেলে কার পোষা কবুতরগুলো জানি এসে হাজির হত মাঠে। ময়ুরের মত পেখম মেলতে চাইত তারা। তাই দেখে ছেলেটির কি আনন্দ। হুইল চেয়ারের ওপর বসে দু হাত তুলে দিত আকাশে। মনে হত সে-ও পাখি হতে চায়।
দুটো পাখা থাকলে কে-ই বা ঠেকাতো তাকে ! ভাইয়ের আনন্দ দেখে ‘কি মজা,কি মজা’ বলে চিৎকার করত মাহবুবা। তখন পাখিরা উড়ত। ঢাউস আকাশটার সীমানা জুড়ে। ওদের ডানার ঝাপটানি মিলিয়ে যেত ধীরে ধীরে। কতই না কারসাজি।
বিকেলের আলো এসে ভর করত ছেলেটির মুখে। কেন ওকে সবাই দানো বলে ? ওতো শিশু। ছোট্ট একটা আদুরে শিশু। কদিন বাদেই শিশুটিকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমার। ফুরিয়েছে ছুটি।
মন খারাপ হয়। আমি একা একা আলো মাখি। শেষ বিকেলের মন খারাপ করা আলো।
তারপর কাটল অনেকগুলো দিন। এক ছুটি শেষ হয়ে এসেছে আরেক ছুটি।
পিঠেপিঠি দিনগুলো পার করে এবারও এসেছি বুবুদের বাড়ি। বাড়ির সামনে অনেক ভীড়। শোনা যাচ্ছে মাহবুবার মায়ের বিলাপ। কান্না আর কান্না। এর মাঝে ঠাই নেই অন্য কোন শব্দের।
যাকে নিয়ে এই ভীড় তার গায়ে কাফনের কাপড়। নিথর, নীরব একটা দেহ। কোনো চেঁচামেচি নেই। নেই গো গো শব্দ। কানাঘুষা করে কেউ কেউ বলছে,‘মরে গিয়ে বাঁচিয়েছে মাকে।
আপদ বিদেয় হলো। ’ বুঝলাম মারা গিয়েছে মাহবুবার ভাই। খুঁজতে খুঁজতে মাহবুবাকে পেলাম ছাদে। কাঁদছে। কাঁদুক ও।
কেঁদে চোখ-মুখ ফুলাক। ফুল ফুটেছে আজ বাগানবিলাসের ঝোপে। অনেক ফুল। ঝরে ঝরে ওরা ঢেকে দিচ্ছে ছেলেটির মুখ। কি সুন্দর দৃশ্য।
কি সুন্দর !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।