"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মেনিলার সাথে প্রথম পরিচয় হয় একটি বারে। আমি পার্টটাইম কাজ করতাম সেই বারে। মেনিলা প্রতিদিন কলেজ শেষে এসে বসতো ডানপাশের শেষ কর্নারের ছোট একটি টেবিলে। প্রতিদিন একটি স্টবেরি আইস্ক্রিম আর একটি কফি নিয়ে বসে থাকতো প্রায় একঘন্টা। ঠিক পাঁচটায় কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট ধরাতো।
মেয়েদের সিগারেট টানতে দেখলে সেটা আমার মত বাঙালির কাছে হাস্যকর ব্যাপার বলে মনে হওয়ার কথা, কিন্তু আমার হয় না। কারন এখানে ছেলেদের থেকে মেয়েরাই সিগারেটে বেশী অভ্যস্ত। আশ্চর্য হলেও আমার কাছে মনে হত সিগারেট মেনিলার জন্যে পারফেক্ট। আসলে প্রতিদিন একটি ঘটনা দেখে হয়ত এই ধারনা। মেনিলা সিগারেটের অর্ধেকটা শেষ করে একবার পেছন ফিরে বারের দিকে দেখতো।
তারপরে ঢুকে যেত কার পারকিং-এ।
প্রতিদিন মেনিলাকে স্টবেরি আইস্ক্রিম আর কফি দিয়ে আসার সময় সে ছাই বর্ণের ধূসর চোখে তাকিয়ে থাকতো। শান্ত শীতল দৃষ্টি। যাস্ট মিষ্টি করে একটু হাসতো যার অর্থ থ্যাঙ্কস। মেনিলা অদ্ভুত রূপবতী।
আমাদের দেশে তাকে নিয়ে আসলে রহিম করিম টাইপ পাবলিক তাকে দেখে ভেবে নেবে চতুর্মাত্রিক কোন ভুবন থেকে পরী নেমে এসেছে। তারা মেয়েটির পেছনের ডানা খুঁজতে থাকবে। মেনিলার গোলাপি ঠোঁটের নীচে খুব ছোট করে একটি তিল। এই তিল যে তার রূপ খুব রকমের বাড়িয়ে দিয়েছে তা-কি সে জানে?
প্রায় একমাসের মাথায় খাবার সার্ভ করার পরে মেনিলার প্রথম একটি শব্দ শুনতে পেলাম। অসম্ভব মিষ্টি গলার স্বর।
আমি তখন খাবার দিয়ে ফিরে আসছিলাম। মেনিলা পেছন থেকে ডাকলো,”লিসেন”
“ইয়েস প্লিজ” আমি বিনীত ভঙ্গিতে হেসে তাকালাম তার চোখে।
“আমি কি তোমার নাম জানতে পারি?” মেনিলা সেই মিষ্টি হেসে জানতে চাইলো।
“আমি রিক”
“তুমি কি জানো আমি প্রতিদিন ক্লাস শেষে এখানে এসে কেন একঘন্টা বসে থাকি?”
আমি বললাম,”স্টবেরি আইস্ক্রিম আর কফির জন্যে”
মেনিলা এবার হাসি চেপে বললো,”ওকে, থ্যাঙ্কস”
এটুকুই ছিল মেনিলার সাথে প্রথম কথা। তারপরে সে প্রায় সময়ই টুকটাক কথা বলতো আমার সাথে।
মাঝে মাঝে সে পার্সোনাল ম্যাটারও জানতে চাইতো খুব কৌশলে। সে হয়ত নিজেকে খুব বেশী বুদ্ধিমতী ভাবতো। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করল,”রিক, তোমাদের ভাষায় লাভার দের কি বলে?”
আমি ওকে একটু বিভ্রান্ত করে দেয়ার জন্যে হেসে বললাম,”কপোত-কপোতি”
মেনিলা একবার কপোত-কপোতি উচ্চারন করতে যেয়ে থেমে বললো,”আমাদের এখানে যেমন প্রায় সবাই প্রেম করছে, তোমাদের ওখানে কি এমন হয়?”
“আমাদের ওখানে সমাজ ব্যাবস্থায় এসব তো দূরে থাক, বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত বর কোনে দুজন দুজনকে দেখে না। “
“তাহলে তাদের বোঝাপড়া কেমন হয়?”
“তাদের মাঝে কখনো ডিভোর্স হয় না, সুতরাং এটা তুমি বুঝে নাও”
“ইন্টেরেস্টিং, তাহলে তোমার কপোট-কপোটি নেই?”
আমি হেসে ফেললাম। বাংলা অভিধান পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম জটিল অভিধান যেখানে তিনটা বর্ণ একই ধ্বনি প্রকাশ করে।
বাইরের কারো মুখে বাংলা উচ্চারন শুনলে হাসি পাওয়ারই কথা। মেনিলাকে তার ঘোর লাগা ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে শুধু ঘার নেরে নেতিবাচক ভঙ্গি করে চলে এলাম।
এভাবে প্রায় সময়ই মেনিলার সাথে কথা হতো। ওর সাথে কথা বলতে ভালোই লাগতো। আসলে ওর মিষ্টি হাসি আর সুন্দর স্বরের জন্যেই।
একটি জিনিস লক্ষ করলে দেখা যায় যে, যেসব মেয়ে খুব মাত্রার সরল, তাদের সরলতা তাদের উজ্জ্বল চোখেই দেখা যায়। ওর চোখেও ঠিক তেমনি আলো ঠিকরে পড়তো। নাটোরের বনলতা সেনের বিপরীতেও একটি মেয়ে এতটা মিষ্টি হতে পারে তা হয়ত জীবনানন্দ দাশ না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতেন না। ব্রাউন চুল, ধূসর চোখ, বড় চোখের পাপড়ি সত্যিই স্বপ্নে দেখা রাজকুমারী।
একদিন রাত দশটায় কাজ শেষে বেড়িয়ে বাসস্টপে রওনা হয়েছি।
তুষারপাত শুরু হয়েছে। বাস স্টপে যেয়ে মনিটরে দেখি বাস সার্ভিস স্টপ করা হয়েছে ভারী তুষারের কারনে। আমার বাসায় যেতে হেটে এক ঘণ্টার পথ। এই তুষারে হেটে এপার্টমেন্টে পৌঁছতে গেলে পথে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে কোথাও মরে পরে থাকতে হবে। বাস স্টপে রাত কাটানো যায়, কিন্তু শীতের প্রকোপ কতক্ষন সহ্য করা যায়? শুধু একটি যাত্রী ছাউনি দিয়ে রাখা।
দশমিনিটের মাথায় একটি গাড়ি এসে থামল স্টপে। গাড়ির চাকার প্রায় অর্ধেকটা তুষারে ঢেকে আছে। গাড়ি সাবধানে ব্রেক করার পরে পিছলে প্রায় তিনহাত এগিয়ে গেছে। গ্লাস নামিয়ে মেনিলা ঝটপট উঠে পড়তে বললো। আমিও কোনদিকে না তাকিয়ে উঠে পড়লাম, অন্তত গাড়ির হিটারে শীত থেকে শেষ রক্ষা হবে।
বেশিদূর আর যেতে হলো না, পাঁচ মিনিটের মাথায় গাড়ির চাকা আটকে গেলো।
দুজনে চুপচাপ বসে আছি। আমার মনে ভয় আর আতংক। প্রথমত ভূতের ভয়, আমার ধারনা আমি একটি ভূতের পাশে বসে আছি। কারন আমাকে নেয়ার জন্য মেনিলার আসার কোন কথা না।
দ্বিতীয়ত মৃত্যুর ভয়, কারন আর ঘণ্টা খানের তুষার পড়লে সমস্ত গাড়ি ঢেকে যাবে। আমি মেনিলার দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম, হয়ত হঠাত দেখা যাবে ইংরেজি মুভির মত মেনিলার ভয়ংকর দাঁত আর নখ গজাতে শুরু করবে। গালে মুখে থাকবে ছোপ ছোপ রক্ত। ভয়ানক দৃষ্টিতে তাকাবে আমার দিকে। মনে হতেই চমকে যেয়ে বললাম,”পানি খাব”
মেনিলা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে সেই বিখ্যাত মোনালিসা টাইপ মিষ্টি হাসলো।
হাত বাড়িয়ে পেছনের সিট থেকে পিজ্জা এনে আমার হাতে দিয়ে বললো,”আজ রাতের জন্য আমাদের এখানেই থাকতে হচ্ছে, কাল সকালে দুজনে উদ্ধার হচ্ছি, খেয়ে নাও। “ আমি চুপচাপ খেয়ে গেলাম। আবার ভয়ও করছে এই ভেবে যে, ছোট বেলায় ভূতের গল্পে শুনেছি কিছু কিছু ভূত হত্যা করার আগে খেতে দেয়। মৃত্যুর আগে মানুষের খাওয়া দেখতে নাকি ভূতদের ভালো লাগে। শরীর ঘামাতে শুরু করলো।
মেনিলা চাপা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার কি ভয় করছে রিক?”
“হ্যাঁ একটু করছে, এর আগে তো কখনো এমন হয়নি। আচ্ছা তুমি কিভাবে বাসস্টপে এলে?”
“আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, তোমাকে দেখে থামালাম”
“আমার মনে হয় তুমি জানতে আমি এসময়ে স্নোতে আটকা পরে যাব, তাই তুমি আমাকে কোম্পানি দিতে বাসা থেকে চলে এসেছ, সাথে পিজ্জা নিয়েছ এ জন্যেই”
“আমিতো তোমাকে বোকা ভাবতাম, এখন দেখছি তোমার ভালোই জ্ঞান আছে। “
“এটা তোমাদের সমস্যা, তোমরা নিজেদের খুব ধূর্ত মনে করো”
“তুমি তো ভালোই কথা বলতে পারো! কিন্তু বারে এত চুপ করে থাকো কেন?”
“সেখানে আমার ডিউটি, কাজেই বকবক করলে সেটা থাকবে না”
“তুমি কি জানতে চাও আমি কেন তোমার কাছে এসেছি?”
“আমার জানার আগ্রহ খুব কম”
“থাক তবে অন্যদিন বলবো”
গাড়িতে হিটার চললে পানি শুন্যতার সৃষ্টি হয়। ঘুম-ও পায় খুব। আমি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
দু’টো স্বপ্নও দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম আমি নৌকা করে একটি নদী পার হচ্ছি। ঢেউয়ে নৌকা দুলছে। বয়স্ক এক মাঝি ঠোঁটে বিড়ি ধড়িয়ে নৌকার বৈঠা চালাচ্ছে। হঠাত দেখি মাঝি নেই, সেখানে মেনিলা বৈঠা চালাচ্ছে।
তার ঠোঁটে বিড়ি। সে বিড়িতে টান দিচ্ছে আর বৈঠা চালাচ্ছে। স্বপ্নে মুভমেন্ট খুব দ্রুত চেঞ্জ হয়। ঢেউয়ে আমি পানিতে পড়ে গেলাম। মেনিলা হাত বাড়িয়ে আমাকে ধরতে চাচ্ছে।
আমি দূরে সরে যাচ্ছি। আমি অনেক কষ্টে নৌকায় উঠলাম। দেখি মেনিলা নৌকায় নেই, মোনালিসা নৌকার মাথায় বসে সেই রহস্যময় হাসি হাসছে আর বৈঠা চালাচ্ছে।
দ্বিতীয় স্বপ্নে দেখলাম আমি আর রবীন্দ্রনাথ বজড়ায় বসে আছি। রবিবাবু মেঘমালা দেখে যাচ্ছেন।
আমি তাকে ডেকে বললাম,”গুরুদেব চা খাবেন? দার্জিলিং থেকে আনিয়েছি। ” ওমনি সে আমার উপরে বিরক্ত হয়ে গলা চেপে ধরলেন। আমি হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম ঘুম থেকে। আমি মেনিলার দিকে তাকিয়া আবারো বললাম,”পানি খাব”
রিস্টওয়াচে সময় দেখলাম ৬ টা বেজে গেছে, চারিদিকে ভোরের আমেজ। কিছুক্ষনের মধ্যেই বরফ কাটার গাড়ি চলে আসার কথা।
মেনিলা সামনের ঝাপসা কাঁচের দিকে তাকিয়ে বললো,”ঘুমালে তোমাকে দেখতে ভালো লাগে, ঠিক বাচ্চাদের মত, হা করে ঘুমাও। “
“তুমি কি সারারাত আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে?”
“তোমার স্বপ্নে কি আমি ছিলাম?”
আমি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। সিস্টেমে নির্ঘাত কোন সমস্যা আছে। নইলে এই মেয়ে হঠাত গাড়ি নিয়ে আমাকে উদ্ধার করতে আসবে কেন আর স্বপ্নের তর্জমাই বা কেন শুনতে চাইবে? কিছু বলার আগেই বরফ কাটার গাড়ি চলে এলো। বরফ সরানোর পরে মেনিলা আমাকে এপার্টমেন্টে নামিয়ে দিয়ে গেলো।
স্বচ্ছ জলে বিন্দুর ঢেউ (The Ring Of Bright Water) - দ্বিতীয় পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।