আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বচ্ছ জলে বিন্দুর ঢেউ (The Ring Of Bright Water) - তৃতীয় পর্ব

"আমারে ফিরায়ে লহো অয়ি বসুন্ধরে, কোলের সন্তানে তব কোলের ভিতরে"-শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলেজের সব থেকে দুষ্ট মেয়ে রাত্রিকে প্রথম যেদিন দেখলাম, সেদিনই প্রেমে পড়ে গেলাম। শুধু যে প্রেম তা নয়, হতাশাজনক প্রেম। সারাদিন উদাস হয়ে মনের পটে শুধু রাত্রির মুখ আঁকতাম। সারাদিন রাত অস্থির লাগতো। এমন কি ঘুমের মাঝে হঠাত উঠে বসে পরতাম।

তারপরে আর সারারাতে ঘুম নেই। জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখতাম। খালি বিছানায় হাত রাখতাম রাত্রির হাত কল্পনা করে। আমি ইমাজিনেশনে ভর করে পথ থেকে পথে হেটে যেতাম রাত্রির হাত ধরে। আমার ইমাজিনেশন এতই বিস্তৃত ছিল যে আমি চোখ বন্ধ করে রাত্রির চুলের ঘ্রান নিতে চাইতাম।

কি যে অদ্ভুত সব অনুভূতি। আমি হাসতাম, একা একাই হাসতাম খুব। বন্ধুরা বলতো, “কি হয়েছে তোর? পাগোল হয়ে গেলি?” তখন আষাঢ় কিংবা শ্রাবন মাস। আকাশ জুড়ে মেঘ আর থেমে থেমে বৃষ্টি। সেদিন বৃষ্টির মাঝেও প্রথম ক্লাশটি করতে রওনা দিলাম।

ক্লাসে ঢুকে পেছনের দিকের একটি বেঞ্চিতে বসে পরলাম। বাঁ দিকে তাকাতেই দেখি শ্যামলা মত ভারি মিষ্টি একটি মেয়ে তার সামনের বেঞ্চির মেয়েটির চুলে বাবলগাম লাগাচ্ছে। আমি মুগ্ধ হয়ে মেয়েটির দুস্টমি দেখছিলাম। এরই মাঝে কখন যে ক্লাসে টীচার চলে এসেছিল খেয়ালই করিনি। স্যার আমাকে দুইবার ডাকার পরে আমার মনোযোগ আকর্ষণে ব্যার্থ হয়ে আমার কাছে এসে বললেন,”কি ক্লাস চলাকালীন সময়ে মেয়েদের দিকে তাকিয়ে পড়া শিখে নাকি টীচারের দিকে? এর পরে যদি আমার ক্লাসে এমন অমনোযোগী দেখি তাহলে অন্য সেকশনে পাঠিয়ে দেব।

“ সমস্ত ক্লাস হেসে উঠলো, লজ্জায় মাথা কাটা গেলো বুঝি এবার। শুধু হাসলো না রাত্রি নামের সেই দুষ্ট মেয়েটি। কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। প্রথম খেয়াল করলাম রাত্রির চোখে। দুরন্ত এই মেয়েটির চোখ অনেক মায়াবী।

কিছু কিছু চোখ আছে যে চোখের দিকে তাকালে মনে হয় আর কিছু না থাক, এই নির্ভরতাটুক অন্তত আছে। সেই চোখের মায়ায় নিজেকে স্বইচ্ছাতেই দিয়ে দিলাম সেদিন। সত্যিকারের কাউকে ভালবাসলে ভয় থাকে। প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসার কথা বলতে ভয় করে। ভয় করে যদি সে ফিরিয়ে দেয়! ফিরিয়ে দেবার কথা ভাবলেই মনে হয় থাক না গোপন আমার ভালোবাসা।

দূর থেকেই ভালোবেসে যেতে পারবো তো অন্তত। আবার মাঝে মাঝে ভীষণ গাড় কিছু আঁকড়ে ধরে। ইচ্ছে করে ছুটে যেয়ে ভালোবাসার মানুষটিকে জানিয়ে দেই ভালোবাসার কথা। কিন্তু তা আর হয় না। প্রেমে পরলেই হয়ত মানুষ সবথেকে ভীতু হয়ে যায়।

ভালোবাসার মানুষটির সামনে দাঁড়িয়ে ‘ভালোবাসি’ শব্দটা বলতে সাহসে কুলোয় না। সারাক্ষন তাকে নিয়ে ভাবতেই ভালো লাগে। আমার-ও খুব ভয় করতো রাত্রিকে ভালোবাসার কথা জানাতে। যদি ও রেগে যায়! আর রাত্রি যে পরিমান দুষ্ট মেয়ে ছিল, হয়ত দেখা যেত সে সবাইকে বলেই বেড়াবে এসব কথা। আড়ালে হাসবে আমাকে নিয়ে।

ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আড় চোখে তাকাবে আমার দিকে। হয়ত দেখা যাবে সবাই আমার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলবে, ”ঐ দেখ, ব্যার্থ প্রেমিক যায়। “ আমি যে রাত্রিকে ভালোবাসার কথা জানাতে চাইনি তা কিন্তু নয়। একদিন সারারাত প্ল্যান করলাম রাত্রি যখন কলেজে আসবে তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকবো। ও ক্লাসে ঢোকার আগে ডেকে বলবো ‘ভালোবাসি।

‘ কিন্তু দেখা গেলো পর দিন রাত্রি ক্লাসেই আসেনি। তারপরে অন্য প্ল্যান করলাম। ভাবলাম চিঠি লিখবো। চিঠিতে ওকে জানাবো ভালোবাসার কথা। লিখেও ফেললাম একটি চিঠি, “প্রিয় রাত্রি, তুমি হয়ত জানো না ক্লাসের একটি ছেলে সারাটিক্ষন চুপিচুপি তাকিয়ে থাকে তোমার দিকে।

সে তোমার চুল ভালোবাসে, তোমার হাসি ভালোবাসে, ভালোবাসে তোমাকে। ছেলেটি সারারাত তোমাকে ভেবে জেগে থাকে চাঁদের মত। খুব অস্থির হয়ে থাকে তোমাকে দেখার জন্য। তুমি ক্লাসে না আসলে বাকি দিন বিষণ্ণ হয়ে থাকে। সে তোমার পিছু পিছু হেটে যায় প্রতিদিন।

কলেজ থেকে এগিয়ে যেয়ে মোড়ে যে চটপটির দোকান, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে, কারন সেই চটপটি তোমার খুব প্রিয়। প্রতিরাতে একটি করে চিঠি লিখে তোমার কাছে। কিন্তু জানো, সাহসের অভাবে সেই চিঠি তোমার হাতে দিতে পারেনা। তুমি হয়ত কখনো ভাবোনি সেই ছেলেটিকে নিয়ে। তুমি হয়ত এখনো জানোই না সে তোমাকে কতটা ভালোবাসে।

তুমি যদি পরিমাপ করতে পারো কতটা ভালোবাসি তোমাকে, তাহলে হয়ত কখনো অস্বীকার করতে পারবে না। সত্যিই অনেক ভালোবাসি তোমাকে। তোমাকে ঘিরে আমার কত স্বপ্ন। আমি হয়ত কোনদিন মুখে বলতে কিংবা বুঝাতে পারবো না, তাই লিখেই দিলাম তোমাকে। ইতি রিক” জীবনের প্রথম কোন মেয়েকে প্রেমপত্র দেব সেদিন।

আমার হৃদপিন্ড স্বাভাবিকের থেকে বেশী কাঁপতে শুরু করলো। ইচ্ছে করছিল একটি একমনি পাথর এনে বেকুব হৃদপিন্ডটাকে চাপা দিয়ে রাখতে। ভাবলাম রাত্রি ক্লাসে আসার আগেই ওর হাতে চিঠি দেব। সকাল সকাল দাঁড়িয়ে রইলাম কলেজ গেটের সামনে। কিন্তু দেখা গেলো অন্যসব দিনে একা থাকলেও সেদিন ওর সাথে বান্ধবিরাও ছিল।

তারপরে ভাবলাম ক্লাস ব্রেকের সময় ক্যান্টিনে ওর হাতে চিঠি দেব। আমি ক্যান্টিনে গেলাম ঠিকিই কিন্তু ওকে দেখার পরে একপা এগুতে পারলাম না। মনে হচ্ছিল গ্লু দিয়ে কেউ আমার পা মেঝের সাথে জুড়িয়ে দিয়েছে। এমন কি কিছুক্ষন পরে আমার পায়ের নীচ থেকে শিকড় গজানো শুরু হতে পারে। ঘণ্টা বাজলো ক্লাসের।

শেষে মনস্থির করলাম যা আছে কপালে, ক্লাস শেষে আমি ওকে জানাবোই আমার ভালোবাসার কথা। ক্লাস শেষ হলো। সবাই যথারীতি বেড়িয়ে গেলো। কলেজ গেট থেকে বেড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে আমি দাড়ালাম রাত্রির সামনে। ভূত দেখার মত চমকে উঠলো রাত্রি।

গোল গোল চোখে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। ওর চোখে তাকিয়ে ভুলেই গেলাম আমি কি বলতে এসেছি। রাত্রি ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞাসা করল,”কিছু বলবে?” “হ্যা, না, মানে হ্যা“ তোতলাতে শুরু করলাম আমি। “তুমি কি তোতলা? মানে তোমার কি কথা অস্পষ্ট হয়? কি বলবে বলো” “ভুলে গেছি” বলেই অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলাম আমি। মৃদু হেসে হাটতে শুরু করে রাত্রি।

আমি জায়গায় দাঁড়িয়ে অসহায়ের মত তাকিয়ে থাকি। মনে মনে নিজেকে গালি দিতে থাকি এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করার জন্য। কি হতো সাহস করে বলে ফেললে? শেষে রাত্রি না জানি তোতলা ভেবে নিলো। ইচ্ছে করছিল বাসের নীচে লাফিয়ে অপদার্থ জীবন বিসর্জন দিতে। কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ।

এভাবেই দিন গড়াতে থাকে। ঠিক তার পরের এক শ্রাবন মাসের কথা। দুপুরে হঠাত করেই আকাশ জোড়া ভীষণ কালো মেঘ ভর করলো। বিকেলে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় নামতেই শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। দৌড়ে যেয়ে দাড়ালাম একটি পুড়নো বিল্ডিংয়ের কার্নিশের নীচে।

পাশে চোখ পড়তেই দেখি রাত্রি দাঁড়িয়ে। আমি ভুলে গেলাম বৃষ্টি ঝরছে, আমার হৃদয়ের ক্ষরণের থেকে মেঘের ক্ষরণ কি এতটা বেশী? নিশ্চুপ কেটে গেলো বেশ কিছু সময়। রাত্রি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “রিক, সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমাকে একটি রিকশা ডেকে দেবে প্লীজ?” আমি নেমে গেলাম বৃষ্টিতে। আমার ধ্যান জুড়ে শুধু একটি বাক্য,”আমাকে একটি রিকশা ডেকে দেবে প্লীজ?” বারে বারে কানে বাজছে।

অনেক খুঁজে বিশ মিনিটের মাথায় রাজি হলো এক রিকশাওয়ালা। আমি রিকশা নিয়ে এসে দাঁড়ালাম রাত্রির সামনে। রাত্রি রিকশায় উঠে বললো, “রিক, তুমি ভিজে গেছো। উঠে এসো” আমি মন্ত্রমুগ্ধ বাধ্য শিশুর মত রাত্রির পাশে বসলাম। রিকশা চলছে।

ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছিলাম আমি। চুল থেকে টপটপ পানি ঝরছিল। মনে হচ্ছিল আমি ঘোরের মধ্যে ডুবে আছি। পাশ থেকে রাত্রির চুলের মিষ্টি মৃদু গন্ধ পাচ্ছিলাম। রাত্রি আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার ব্যাগে ছাতা ছিল, তোমাকে ডেকে বললাম ছাতা নিয়ে যেতে, তুমি কি শুনতে পাও নি?” “রাত্রি, আমি তোতলা না।

কিন্তু তোমাকে দেখলে......” “আমি জানি, তুমি তো দেখছি শীতে কাঁপছো। হাতটা দাও আমার হাতে। “ আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম। প্রথম প্রেমের উষ্ণ স্পর্শ এলোমেলো করে দিলো সব। রাত্রি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।

আমার হাতটা একটু টেনে নিয়ে রাত্রি বললো, “আমাকে কি খুব ভালোবাসো?” “হ্যা রাত্রি, ভয়ে বলতে পারি না” আবেগ ভরা কন্ঠে বললাম আমি। “আমি শক্ত করে তোমার হাত ধরে রেখেছি। এবার বলতে পারবে?” “আমি তোমাকে ভালোবাসি রাত্রি, সত্যিই অনেক ভালোবাসি, আমি বলে বুঝাতে পারছি না। “ “তোমাকে বোঝাতে হবে না ভীতু, আমি অনেক আগে থেকেই বুঝি। অপেক্ষায় ছিলাম কখন তুমি বলবে।

মাঝে মাঝে রাগে আমার ইচ্ছে করতো তোমার গলা চেপে ধরে বলি, তুই এত ভীতু কেন? বল ভালোবাসি” গলা ভারি হয়ে আসে রাত্রির। ওর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরে। আমি ভেজা হাতে ওর চোখে জল মুছে দেই। আমাকে জড়িয়ে ধরে আরও বেশী কাঁদতে থাকে রাত্রি। আমি অবাক হয়ে ভাবি, এতটা সুখ আমার জন্যেই ছিলো? আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল,”আমিই এই পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ।

“ আমি তাকাই রাত্রির দিকে। আমার বুকে কপোল ঠেকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আমি রাত্রির চোখ মুছে দিয়ে বল্লাম,”জলে কাজলে একাকার হয়ে যাচ্ছে তো!” রাত্রি কান্না থামিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমানী স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি এতো ভালো কেন রিক?” স্বচ্ছ জলে বিন্দুর ঢেউ (The Ring Of Bright Water) - শেষ পর্ব  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।