আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইফ ইসমাইল এর গল্প তবুও মানুষ

এক. : 'আঁর পোয়ারে অনরার কাছে আর রাখিত্ পাইতাম্মন্। আঁরে এহনই ছাড়ি দন'। : কিন্তু, আপনার বাচ্চার অবস্থা তো ভালো না। বাসায় নিয়ে গেলে অক্সিজেন পাবে কোথায়? আপনি তো বাচ্চা হারিয়েই ফেলবেন। : অনরা ডাকাইত্ ।

আঁর পোয়ারে পাতাইজ্জ্যা ইঞ্জেকশন দিয়েনে তো শেষ গইজ্জুন। ইয়ার পরেও অনরারে দি'এনে পোয়ার চিকিৎসা গরাইতো কন নিকি?! : স্যরি, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। কিন্তু তাই বলে এ অবস্থায় আপনার বাচ্চা নিয়ে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। বাচ্চা মারা যাবে। অনেকক্ষণ ধরে ক্লিনিকের ম্যানেজার আর জনৈক অভিভাবকের বহাস কানে আসছিল নাসিমের।

কাজের সময় এরকম শোরগোল হলে কাজ করা যায়! মনে মনে খুব বিরক্ত নাসিমকে অনন্যোপায় হয়ে এরকম বাতচিত্ মাঝে মধ্যেই শুনতে হয়। আজও শুনছিল আর বিরক্ত হচ্ছিল। কিন্তু ম্যানেজারের শেষকথা কানে আসতেই চমকে যায় সে। কী বলে ব্যাটা!? দুই. নাসিম পেশায় ব্যবসায়ী। বয়েস পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই।

লম্বা ছিপছিপে গড়ন। গায়ের রং শ্যামলা হলেও চেহারার আর্য গঠন যেকোন তরুনীর বুকে কাঁপন তোলে এখনও। এক কথায় সুপুরুষ। ব্যবহারও অমায়িক। কোন একক ব্যক্তির মাঝে শৈর্য বীর্য, আভিজাত্যের পাশাপাশি মিষ্টভাষী আর আন্তরিকতার গুন কদাচিৎ মেলে।

নাসিম ব্যতিক্রমদেরই একজন। বুদ্ধিমত্তা আর ব্যক্তিত্বের জোরে গন্যমান্য হিসাবে সমাজে গ্রহণযোগ্য। পয়সাপাতি রোজগারও নেহায়েতই কম করেনি। সহায় সম্পদ যা কামিয়েছে তাতে আরো একপুরুষ বসে খেতে পারবে। তবে তাঁর আচার ব্যবহারে সে রকমটি প্রকাশ পায়না।

মানবতাবাদী। ফলে বেশ কিছু সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত। যেমন, তার অফিসের সাথে লাগোয়া ক্লিনিক। নাসিমরা কয়েক বন্ধু মিলে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছে। উদোক্তাদের অধিকাংশই ডাক্তার।

শিশু বিশেষজ্ঞ। শুধু নাসিম ছাড়া। সে-ই একমাত্র ব্যবসায়ী। কিন্তু ক্লিনিকের মা-বাপ হিসাবে যদি কারো নাম বলতে হয়, সে নাসিম-ই। নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অফিসকে আয়তনে ছোট করে তাতে শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন ও পরিকল্পনা তারই।

নিজের সন্তানের মতো করে প্রতিষ্ঠানটি সে গড়ে তুলেছে। অবশ্য কারণও আছে। মধ্য ষাটের দশকে উত্তর চট্টগ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নাসিমের জন্ম। মোটামুটি স্বাচ্ছন্দে কেটেছে তার শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বাপ-দাদার ভিটে মাটিতে। মেধাবী, চৌকস নাসিমের জীবনে ঝড় আসে বিয়ের পর।

বৌ নিয়ে খুবই সুখী দিনযাপন করলেও লোকজনের চোখে সম্পর্কটাকে ঠিক একটা মানানসই বলে মনে হয় না। নাসিমের শারীরিক মানসিক ম্যাচিউরিটির সাথে বউটাকে বেমানানই বলা চলে। তার বন্ধু বান্ধবেরা বুঝে উঠতে পারে না এই মেয়েটার সাথে নাসিমের প্রেমঘটিত প্রণয় হয় কী করে! ঘনিষ্টজনদের কেউ কেউ প্রশ্ন করলে সে মুচকি হেসে উত্তর দেয়, "আসলে স্রষ্টা তাঁর সৃষ্টিতে ভারসাম্য রৰার জন্যই সম্ভবতঃ এমনটি করেছেন। "_ একথা মুখে বললেও তার চেহারায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বাচ্চাগুলোর কথা স্মরণ করে হারিয়ে যায়।

দু'টো বাচ্চাই তার প্রতিবন্ধী। একজন শারীরিক আরেকজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। বন্ধুদের কেউ কেউ ভাবে, 'সত্যিই তো'। এএতাহলে কী হতো?! আলস্নাহ্ সত্যিই মেহেরবান। ' বাচ্চাগুলোকে নিয়ে নাসিমের কষ্ট নেই।

অপ্রাপ্তির হাহাকার নেই। তবে, সন্তানদের কষ্ট দেখলে প্রাণ কাঁদে। তাই বিশাল ব্যবসায়ী হয়েও দিনের বেশ কিছুটা সময় সে বাচ্চাদের সাথে কাটায় কোন রকম ব্যতিক্রম ছাড়া। সন্তানদের চিকিৎসা করাতে গিয়েই তার মাথায় শিশু হাসপাতালের আইডিয়া আসে। সে দেখে, আক্ষরিক অর্থেই বাংলাদেশে বিশেষতঃ চট্টগ্রামে শিশুদের জন্য চিকিৎসার ভাল জায়গা নেই।

যা আছে তা চট্টগ্রামের জন্য কিছুই না। তিন. ম্যানেজার আর রোগীর অভিভাবকের মধ্যে কথা কাটাকাটির এ পর্যায়ে নাসিম তার পিয়নকে বলে, 'হাসপাতালের মানেজার সাহেবকে আমার সালাম দাও'। : কী ব্যাপার, শোরগোল হচ্ছে কেন? : স্যার ১০নং বেডের গার্ডিয়ান বলছেন রোগীকে এক্ষুনি নিয়ে যাবেন, কিন্তু বাচ্চাটার অবস্থা ভালো নয়_ নেবুলাইজার চলছে, আম্তা আম্তা করে আদিল জানায়। : কেন নিয়ে যেতে চান?! : স্যার, গতকাল বাচ্চাটার শিরদাঁড়া থেকে ফ্লুয়িড কালেকশান করার সময় সমস্যা হয়েছিল। রাত হতে প্রচন্ড জ্বর।

অক্সিজেনও দিতে হচ্ছে। _ ভয়ে ভয়ে জানায় আদিল। : কেন, কী সমস্যা হয়েছিল? : কাচুমাচু করতে করতে আদিল জানায়, "ধীরেন স্যার ফ্লুয়িড কালেকশানের জন্য আমরা যে এক্সপার্টকে ডাকি তাঁকে না ডেকে তাঁর এক বন্ধুকে দিয়ে কালেকশান করিয়েছেন। তাঁর বন্ধু নতুন ডাক্তার আর বাচ্চাটার বয়েসও মাত্র পাঁচ মাস। কয়েকবার নিড্ল পাঞ্চ করাতে বাচ্চাটার অস্বাভাবিক জ্বরের সাথে শ্বাস কষ্টও শুরু হয়েছে।

মনে হয় বাঁচবে না। ' ম্যানেজার আদিলের কথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে নাসিমের মাথায়। কী বলে ব্যাটা! তিল তিল করে হাসপাতাল গড়া হলো শিশুদের সূচিকিৎসার মাধ্যমে জীবন দেয়ার জন্য আর এরা আজ জীবিত সুস্থ শিশুকে মেরে ফেলার জোগাড় করছে!? রাগে-ৰোভে চারপাশটা চূর্ণ-বিচূর্ণ করার ইচ্ছা জাগলেও তার জীবনে নতুন এ অনুভূতিতে সে প্রশ্রয় দেয় না। ধীর স্থির চিত্তে কর্তব্য নির্ধারণের চেষ্টা করে। পারে না।

চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে রাখে কিছুক্ষণ। এদিকে আদিল ভয়ে জামা কাপড় ভিজিয়ে ফেলে, না জানি আজ কী হয়। চার. আদিলের গ্রামের বাড়ী মীরসরাই। নাসিম সাহেবের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। এক হারা গড়ন।

মেধাবী, চৌকষ, কর্মঠ। খুবই বিশ্বস্ত। যোগ্য এ লোকটিকে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নাসিম যোগাড় করেছেন। এরকম সুযোগ্য লোকের অভাব আছে আমাদের। সমাজে মাকাল ফলের সংখ্যাই বেশী।

ভাগ্যিস, দূরসম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। আদিলের পরিবার নাকি নাসিমদের পরিবারের কাছে ঋণী। কারণ অবশ্য বলেননি কেউ। দারুন ব্যস্ত নাসিম সুন্দর শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন আদিলের দক্ষ হাতে পূরণ করে। আদিলের নিঃস্বার্থ অথচ কঠোর পরিশ্রমে আর নাসিমের দূরদৃষ্টি ও অকৃপণ নিলোর্ভ উৎসাহ উদ্দীপনায় হাসপাতালটি চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণে জায়গা করে নিয়েচে প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মাথায়।

আদিল তার মনিব নাসিম সাহেবকে খুবই শ্রদ্ধা করে, ভয়ও পায়। কারণ লোকটা খুবই ভাল। আমাদের সমাজে সচরাচর এমন লোক পাওয়া যায় না। পয়সাওয়ালা হলেও চলেন সাধাসিধে ভাবে। মদ-নারী-অর্থের পেছনে ছুটে বেড়ান না।

তার চোখে কোন বদ অভ্যাস ধরা পড়েনি নাসিমের। তার প্রতি শ্রদ্ধা দিনে দিনে ভয়ে রূপ নিচ্ছে আদিলের। আদিলও বিষয়টি খেয়াল করেছে। কিন্তু কোন কুল কিনারা খুঁজে পায়নি তার এ বিচিত্র বোধের কারণ কী। আদিলের ভয় আজ সবমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

জানে, নাসিম সাহেবের কাছে এ হাসপাতাল কী, রোগীদের মর্যাদা কী। কখন যে প্যান্ট ভিজে গেছে খেয়ালই করেনি আদিল। নাসিম সাহেব চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দেয়ার পরই তার নিজের অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয় সে। অবস্থা দেখে ভয়ের মাত্রা আরো বেড়ে যায় আদিলের। অপেক্ষায় থাকে নাসিম স্যার কী বলেন তার জন্য।

সময় যেন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েছে। পাঁচ সুভাষ বড়ুয়া পেশায় ড্রাইভার। বয়স ছত্রিশ। মঙ্গোলিয়ান চেহারা। বোচা নাক, গোলাকার অবয়ব।

মায়ের মত লম্বা হওয়ায় কিছুটা শংকর রূপ পেয়েছে। স্বাস্থ্য ভালোই বলা চলে। দু'বছর আগে সুপ্রিয়ার সাথে ঘর বেঁধেছে। সুভাষ বৌদ্ধ আর সুপ্রিয়া হিন্দু। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে।

দু'জনের পরিবার থেকেই অনেকটা বিচ্ছিন্ন, একা। প্রথম বসনত্দের ভালো লাগায় সুভাষ-সুপ্রিয়ার সাক্ষাৎ চার্চ স্কুলে। দর্শনেই প্রেম। গাঢ় থেকে প্রগাঢ়তর। বৈরি পরিবেশের কথা ভেবে এতগুলো বছর ধৈর্য্য ধরেছে।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেমেরই জয়। রক্তের সব বাঁধনকে দূরে ঠেলে হৃদয়ের কথা শুনেছে দু'জনে। বিয়ে করেছে। সুখেন তাদের একাকী যুগল জীবনে শান্তির বারতা নিয়ে এসেছে। গত পাঁচ মাসে দু'জনের জীবনে এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন।

বিগত বছরগুলোর মন খারাপ ভাবটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। গেল সপ্তাহে সুখেনের শারীরিক কিছু পরিবর্তন আবারো তাদের বিষাদের সাগরে ছুড়ে ফেলেছে। ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে গত পরশু। হাসি খুশি সুখেন গত দু'দিনে হঠাৎ করে যেন নেই হয়ে গেল।

গতকাল ডাক্তাররা সুখেনকে দেখেছে। বিকালে ইঞ্জেকশন দিয়ে কি যেন নিয়েছে ওর শরীর থেকে। বলেছেন, 'আজ পরীক্ষা করলেই বুঝা যাবে আসলে ঠিক কি হয়েছে সুখেনের"। সুপ্রিয়া অস্থির হয়ে গেছে দু'দিনে। গতরাতে সুখেনের প্রচন্ড জ্বরসহ কাঁপুনিতে ডাক্তাররা অক্সিজেন লাগিয়েছে।

সেই থেকে সুপ্রিয়ার বুকটা কেমন যেন করছে। ঠিক বুঝতে পারছে না যে। খালি ভয় হচ্ছে। সুভাষকে কিছু বলেনি। এমনিতেই বেচারার কাহিল অবস্থা।

দিনে ডিউটি, ড্রাইভিং আর রাতে হাসপাতালে বাচ্চাকে পাহারা দেয়া। এদিকে ঔষধপথ্য আর হাসপাতালের বিলের পাহাড় সুভাষকে রীতিমত পাগল করে তুলেছে। গতরাতে সুখেনের জ্বর আসার পর আজ আর ডিউটিতে যায়নি। সুপারভাইজার যদিও মানতে চায়নি কারণ গত সপ্তাহেই সুভাষ অফিস থেকে দু'মাসের অগ্রিম বেতন তুলেছে। ফোনে সুপারভাইজারকে 'আসতে পারবে না' বলেই আর কথা বাড়ায়নি।

সুভাষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাচ্চাকে এ হাসপাতাল থেকে নিয়ে যাবে। কারণটা দ্বিবিধ। একে তো বাচ্চার অবস্থা দ্রুততার সাথে খারাপের দিকে যাচ্ছে অন্যদিকে পরিজনহীন জগৎ সংসারের প্রধান উপাদান টাকাও তেমন আর নেই। গত দু'দিনে ডাক্তার ধীরেন চৌধুরী এই টেষ্ট ওই টেষ্ট, নানান রকম ঔষধপাতির বহর জুড়ে দিয়েছেন। লোকটাকে সুভাষের ঠিক পছন্দ হয়নি।

সুপ্রিয়ারও না। পাড়ার লোকদের কাছে হাসপাতালটি সম্পর্কে যা কিছু শুনেছিল বাস্তবে তার ছিটে ফোঁটাও পাচ্ছে না। দু'দিনেই ক্লিনিকের বিল এক লাফে সতের হাজারে পৌঁছেছে। সুভাষের কাছে অফিস থেকে নেয়া দু'মাসের অগ্রিমসহ সব মিলিয়ে আছে হাজার পঁচিশেক টাকা। এদিকে মাসের বাজারও করা হয়নি সুখেনের অসুস্থতায়।

এখন চিন্তা করছে পরিবেশ নোংরা হলেও মেডিকেলে নিয়ে যাবে। অল্প যে কয়টা টাকা হাতে আছে সেগুলো দিয়ে বাচ্চাটার চিকিৎসা করা যাবে। ওখানে তো সিটভাড়া আর অক্সিজেন বিলের বালাই নেই। পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিয়ে একটু অসুবিধা হবে, এই আর কি। বাচ্চাটার চিকিৎসাতো করা যাবে।

সুপ্রিয়াকে জিনিসপত্র গোছাতে বলে হাসপাতাল অফিসের দিকে পা বাড়ায় সুভাষ। ছয়. ধীরেন চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে দু'বছর আগে ইন্টার্ন শেষ করেছে। দাদাবাবুর কল্যাণে শহরের নামকরা শিশু হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসারের চাকুরীটি পেয়েছে। তেমন বেগ পেতে হয়নি। এমনিতে মেধাবী।

তার উপর বড়দি'র স্বামী এ হাসপাতালের ডিরেক্টর। এ হাসপাতাল ছাড়াও পাড়ায় প্র্যাকটিস করছে সে প্রতিদিন রাত আটটা থেকে। শিশু হাসপাতালের ডাক্তার, সে সুবাদে চেম্বারও ভাল চলছে। পাশ করার দু'বছরের মধ্যে এমন পসার সাধারণতঃ দেখা যায় না। কপালই বলতে হবে।

গত দু'বছরে কম আয় করেনি। মোটর সাইকেল ছিল ওটা বিক্রি করে আর জমানো টাকা দিয়ে গত মাসে কার কিনেছে একটা। এখন একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ, খুলশীতে একটা ফ্ল্যাট কেনা যায় কত তাড়াতাড়ি। গত ক'দিন ধরে বেশ রাত অবধি চেম্বার করছে। হঠাৎ করে রোগীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে যেন।

রাত একটায়ও চেম্বারে রোগী আসছে। নিজেকে মনে মনে খুবই ভাগ্যবান মনে হয় ধীরেনের। ফ্ল্যাটের স্বপ্নে বিভোর ধীরেন গতমাস থেকে নতুন পন্থা আবিস্কার করেছে বেশী বেশী টাকা কামানোর। সোমবারে ডায়াগনষ্টিক সেন্টার হতে একটা পেটমোটা খাম পাওয়ার পর আইডিয়াটা আরো ভাল করে কাজে লাগানোর চিন্তা করে সে। হাসপাতাল আর চেম্বারের সব রোগীকেই পাঁচ/ছয়টা টেষ্ট এর স্লিপ ধরিয়ে আগামী মাসের খামটাকে রীতিমত 'গর্ভবতী মহিলা' বলেই অনুমান করে ধীরেন।

ডায়াগস্টিক সেন্টার থেকে খামটি দেয়ার সময় মার্কেটিং ম্যানেজার বলে গেছে সম্ভব হলে ক্রিটিক্যাল কিছু টেস্টও তাদেরকে পাঠাতে, কারণ পয়সা বেশী। টেষ্ট কেস হিসাবে আজ সকালে হাসপাতালের ১০ নং বেডের বাচ্চাটাকে লাম্বার ফ্লুয়িড টেস্টের জন্য পাঠিয়েছে। যদিও বাচ্চাটার তেমন কিছু হয়নি। সিজন চেঞ্জ আর খাবার অনিয়ম থেকে সামান্য শারীরিক পরিবর্তন লক্ষ্য করতেই মা-বাবা তার চেম্বারে নিয়ে আসার পর তিনদিন আগে সে বাচ্চাটিকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দেয়। সম্ভবতঃ এক সন্তানের অশিক্ষিত জনক-জননী তাতেই তাড়াতাড়ি বাচ্চাটিকে ক্লিনিকে এনে ভর্তি করিয়েছে গতকাল সকালে।

রাতে ডিউটি রোস্টার চেঞ্জ করায় সময় ফলোআপ রিপোর্ট এ দেখেছে বাচ্চাটার প্রচন্ড জ্বর, সাথে শ্বাসকষ্ট। হঠাৎ কী এক অজানা ভীতিকর অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়েছে এর পরই। এ অনুভূতি তাকে ঘিরে রেখেছে চেম্বার করার সময়ও। তাড়াতাড়ি চেম্বার শেষ করে ঘরে ফিরেই একটা রিলাক্সেন খেয়ে ঘুম। কাল সকালেই বাচ্চাটাকে দেখতে যেতে হবে।

সাত. হঠাৎ নাসিমের তন্দ্রা ছুটে যায়। চোখ মেলে দেখে আদিল দাঁড়িয়ে আছে। ঘুমিয়ে গিয়েছিল নাকি সে! ক'মিনিট! ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখে সকাল ১০টা ৫০মিনিট। মনে মনে ভাবে, না মাত্র তিন মিনিট। আদিলের দিকে তাকিয়ে বলে, 'রোগীর গার্ডিয়ানকে পাঠান তো একটু।

আপনি বাইরে দাঁড়ান। ' : জি আচ্ছা, বলে আদিল কোনমতে বসের রুম ত্যাগ করে। কিছুক্ষণ পর সুভাষ রুমে ঢোকে। উস্কোখুস্কো চুর, রাগতঃ মূর্তি। শারীরিক-মানসিক ধকলের ছাপ স্পষ্ট।

কীভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পায়না নাসিম। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করে অভিভাবকটিকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলে। : অন'র বাড়ী কনডে? : আঁর বাড়ী দিয়েরে অ'নে ক্যান গরিবেন? কথার খেই হারিয়ে ফেলে নাসিম। বোঝে, বেচারা এখন কোন কিছুতেই স্বাভাবিক হবে না। সুভাষের দিকে টেবিলে রাখা পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।

নাসিমের ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া সুভাষের নজর এড়ায় না। সংবিৎ ফিরে পেয়ে সুভাষ নড়েচড়ে বসে। বলে, : মাফ গইজ্জুন। বাইচ্চ্যাউয়্যার মিক্ক্যা চাই মন্নান বেশী খারাফ। : না ঠিক আছে।

শুদ্ধ বাংলাতেই শুরু করে নাসিম। : এবার কন, কিয়োর লাই ডাইক্কুন। : আপনার বাচ্চার অবস্থা তো ভালো না, আপনি জানেন। আমাদেরও দোষ আছে। কিন্তু এখন দোষ-গুন বিচার না করে বাচ্চাটাকে আগে বাঁচানো দরকার নয় কি? আপনি ওকে নিয়ে যেতে চাইছেন কেন? : অঝোর ধারায় কেঁদে ফেলে সুভাষ।

আদ্যোপান্ত খুলে বলে। এই লোকটার মাঝে বোধ হয় অলৌকিক কিছু আছে, মনে মনে ভাবে সুভাষ। অল্পতেই আপন করে নিতে পারেন। সবকিছু শোনার পর নাসিম বলে, আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু বাচ্চার ঔষধের খরচগুলো দেবেন, বাসায় কিংবা অন্য কোথাও নিয়ে গেলেও তো আপনাকে তা-ই করতে হবে, তাই না? সুভাষ 'হ্যাঁ' সূচক মাথা দোলায়।

তাকে নিশ্চিন্তে বাচ্চার কাছে পাঠিয়ে নাসিম বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা তার বিশ্বস্ত সহচর আদিলকে ডেকে নেয়। চার ঘন্টার মধ্যে বাচ্চাটির জন্য 'মেডিকেল বোর্ড' গঠন করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বুঝিয়ে দেয়। আর বলে, হাসপাতালে থাকা-খাওয়াসহ সব একোমোডেশন বিনামূল্যে সরবরাহ করে বাচ্চাটিকে দ্রুত সারিয়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে। স্যারের কথায় চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আদিলের। তার মনের কথাই যেন স্যারের মুখে শুনেছে।

হাতে করে নিয়ে আসা ডাক্তার ধীমানের ফাইলটি বসের দিকে ঠেলে দেয়। অনেক দিনের বিশ্বস্ত সহযোগীটি যেন তার মনের কথাই বলতে চাইছে!- ভাবে নাসিম। ফাইলটি নিজের দিকে টেনে নিয়ে আদিলকে দ্রুত কাজ শেষ করে ফলোআপ দিতে বলে। : জি স্যার, বলে আদিল বেরিয়ে পড়ে। চোয়াল শক্ত।

হাত মুষ্টিবদ্ধ। প্রমাণ করতে হবে যে, 'মানুষই বড়'! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।