ডান হাতে কাগজপত্র রাখার কালো ব্যাগ। বাঁ হাতে কাঁধে ফেলা কোটের কলার ধরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন এ কে এম এনামুল হক। ঘামে ভিজে জবজবে। ক্লান্তিতে অবসন্ন। ঢাকা জজ আদালতের আইনজীবী তিনি।
বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাঁর সঙ্গে দেখা হলো কাকরাইল মোড়ে।
‘হাঁটা ছাড়া গতি নাই’—তাঁর প্রথম কথা। বাসা মহাখালী। রোজ রায়সাহেব বাজার মোড় থেকে মিরপুর-সদরঘাট রুটের বাসে গুলিস্তান এসে আজমেরী, স্কাইলাইন বা প্রভাতী সার্ভিসের বাসে করে মহাখালী আসেন। গতকাল রায়সাহেব বাজার থেকে বাবুবাজার, নয়াবাজার, নবাবপুর রোড—সব স্থবির।
ফুটপাতেও মানুষে ঠাসাঠাসি। তাঁর ভাষায়, ‘পিঁপড়ারও চলা মুশকিল’। অগত্যা হেঁটেই রওনা দিয়েছিলেন গুলিস্তানের উদ্দেশে।
গুলিস্তানে এসে দেখেন, সেখানকার অবস্থা আরও ভয়ানক। কোনো দিকেই কোনো গাড়ি যাচ্ছে না।
মাথার ওপরে চাঁদি ফাটানো কটকটে রোদ। দুঃসহ গরমে জীবন অতিষ্ঠ। মহাখালী পর্যন্ত রিকশায় যাওয়ারও উপায় নেই। কাজেই পায়ের ওপর ভরসা করেই গুলিস্তান থেকে আবার চলতে শুরু করেন, যদি জাতীয় প্রেসক্লাব বা কাকরাইলের ওদিকে কোনো বাহন মেলে, সেই আশায়। কিন্তু যতই এগিয়েছেন, কোনো হেরফের চোখে পড়েনি।
পুরো শহরটাই যেন অচল হয়ে আছে।
এ কঠিন দুর্ভোগের কারণ সম্পর্কে এনামুল হক কিছুই জানতেন না। পরে লোকমুখে শুনেছেন, শাহবাগে পথ অবরোধ করেছেন বিসিএস পরীক্ষার্থীরা। বিসিএস পরীক্ষার ফলে কী যেন সমস্যা হয়েছে তাই নিয়ে। বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ‘এটা কোনো কথা হলো! যার যখন ইচ্ছা পথ আটকে দিয়ে লাখ লাখ মানুষকে এমন অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেবে! আর কর্তৃপক্ষই বা কী করছে? মনে হয় কারও কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
দেখার কেউ নেই। ’
ওই আইনজীবীর ক্ষোভ, ‘ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হতেই পারে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তো তাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি দ্রুত সমাধান করতে পারত। দিনভর শহরের কেন্দ্রীয় এলাকায় পথ অবরোধ হয়ে থাকল, অথচ দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নির্বিকার রইলেন। এটি দুঃখজনক।
’
এনামুল হকের মতো লাখ লাখ মানুষ বাসার বাইরে গিয়ে গতকাল সকাল ১০টার পর থেকেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়ে। স্কুল-কলেজ ছুটির পর শিশু-কিশোরদের অমানবিক দুর্ভোগ ছিল চোখে পড়ার মতো। রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সগুলো সাইরেন বাজিয়েও হাসপাতালে পৌঁছেছে কচ্ছপের গতিতে।
রাজধানীতে যানজট নতুন বিষয় নয়। পথে নেমে ভোগান্তি নগরবাসীর নিয়তির লিখন।
তবে গতকাল বুধবার তা যেন সীমা ছাড়িয়ে যায়। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীরা শাহবাগ এলাকায় অবস্থান নেন। তাঁরা এ এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেন। শহরের গুরুত্বপূর্ণ এ এলাকায় যান চলাচল বন্ধ থাকায় তীব্র যানজটে মহানগর অচল হয়ে পড়ে। শান্তিনগর মোড় থেকে মৌচাক হয়ে রামপুরা পর্যন্ত দুর্বিষহ যানজটের সৃষ্টি হয়।
এর প্রভাব পড়ে গুলশান, বনানী, মহাখালীতেও। ওদিকে মিরপুর রোডে যানবাহন চলাচল স্থবির হয়ে পড়ায় পুরো মিরপুর এলাকা স্থবির হয়ে পড়ে। শাহবাগকেন্দ্রিক এ জটের সঙ্গে গতকাল যুক্ত হয় রথযাত্রা উৎসবের র্যালি। সব মিলিয়ে গতকাল দুর্ভোগের শহর হয়ে ওঠে ঢাকা।
পুলিশ উত্তরে রূপসী বাংলা হোটেল মোড়, পূর্বে মৎস্য ভবন, দক্ষিণে হাইকোর্ট ও দোয়েল চত্বর এবং পশ্চিমে কাঁটাবন মোড়ে বাধা দিয়ে যানবাহন ঘুরিয়ে দেয়।
বিকল্প পথগুলো তুলনামূলক সরু এবং তাতে ছোট-বড় নানা ধরনের অতিরিক্ত যান প্রবেশ করায় প্রায় পুরো শহর গতিরুদ্ধ হয়ে পড়ে। রিকশাও চলাচল করতে পারেনি। অনেকেই বাধ্য হয়েছে প্রখর রোদে হেঁটে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে। ফলে সময় মেনে গন্তব্যে পৌঁছার মতো সৌভাগ্যবানের সংখ্যা গতকাল ছিল না বললেই চলে।
একে তো ফুটপাতে হরেক রকমের পণ্যের পসরা, তার ওপর মানুষের ঠাসাঠাসি।
এতে হাঁটাচলাও ছিল কষ্টকর। বিশেষ করে স্কুল-কলেজে যাওয়া এবং ছুটির পর বাড়ি ফিরতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাদের অভিভাবকদের নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে।
পান্থপথে বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের সামনে আটকে ছিলেন নয়াপল্টনের সাবিনা হক। ছেলে আনন আশরাফ পড়ে ধানমন্ডির একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। স্কুল ছুটি হয়েছে তিনটায়।
কচ্ছপের মতো একটু একটু করে সাড়ে চারটায় পান্থপথে এসে গাড়ি একেবারে অনড়। পাঁচটায় ছেলে কোচিংয়ে যায়। নির্ঘাত ‘মিস করবে’। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, সবাই বড় বড় বক্তৃতা দেয়, উন্নয়নের গল্প শোনায়। রাজধানীর যানজটের মতো জ্বলন্ত সমস্যা কারও চোখে পড়ে না।
রাস্তায় বের হলে নিরাপত্তা নেই। যখন-তখন গাড়ি ভেঙে দেয়, আগুন দেয়। কারও কিছু হয় না। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে কারও কি কোনো ভাবনা আছে?’
পথচারীদের সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে, কেন এমন দুর্বিষহ যানজটে শহর অচল হলো, অনেকেই তা জানতেন না। শাহবাগের ওদিকে কিছু একটা হয়েছে—পরস্পর এমনই শুনেছেন কেউ কেউ।
কিন্তু যা-ই ঘটুক, রাজধানীর মতো একটি ব্যস্ত শহরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন চলাচল স্থবির হয়ে থাকবে, তা কেউ মানতে পারেননি।
একটি গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবাস চালান জহুরুল ইসলাম। রূপসী বাংলা হোটেলের মোড়ে তিনি আটকে ছিলেন বেলা তিনটার দিকে। কাঁঠালবাগান থেকে রওনা দিয়েছেন একটার দিকে। প্রধান সড়কে উঠতে পারেননি।
সেন্ট্রাল রোড-ভূতের গলি-হাতিরপুল-পরিবাগ হয়ে রূপসী বাংলা হোটেল মোড়ে আসতে লেগেছে পাক্কা দুই ঘণ্টা। যাবেন মালিবাগ। কখন যেতে পারবেন, তা জানেন না। বললেন, ‘শাহবাগের ওই দিকে মনে হয় কিছু একটা হইতাছে। কন, এমুন হইলে কি চলাফেরা করা যায়?’
না, আসলেই যায় না।
সে কথা মর্মে মর্মে টের পেয়েছেন ভুক্তভোগী নগরবাসী। কিন্তু যাঁরা এর প্রতিকার করতে পারেন, তাঁরাই তো ছিলেন নির্বিকার।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে দিনভর শাহবাগ মোড় বন্ধ ছিল। নগরের গুরুত্বপূর্ণ চৌরাস্তা বন্ধ থাকায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হয়। এ কারণে যানজট ছড়িয়ে পড়ে সারা শহরে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।