সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের দায়
ফকির ইলিয়াস
====================================
নরসিংদীর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার মূল আসামিরা গ্রেপ্তার হয়নি। কেন হয়নি এই প্রশ্ন দেশবাসীর। তিন আসামি নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে আদালতে গেলেন, বের হয়েও এলেন কী করে? নরসিংদী পৌরসভার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন হত্যাকান্ডে জড়িত সন্দেহভাজন খুনিদের একজন গ্রেপ্তারকৃত কাজী মাসুদ পারভেজ টিপ্পন। সে হত্যাকান্ডে নিজের সরাসরি জড়িত থাকার কথা পুলিশের নিকট স্বীকার করেছে। টিপ্পনসহ পাঁচজন মেয়র লোকমানকে ১ নভেম্বর নরসিংদী শহর বটতলা আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
ঐ সময় টিপ্পনের মুখে লম্বা দাড়ি ও মাথায় লম্বা চুল ছিল। খুনের ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলযোগে ঐ দাড়িওয়ালা টিপ্পন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল বলে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানান।
লোকমান হোসেন আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। তিনি একজন দক্ষ মেয়র হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাকে কেন হত্যা করা হলো? কারা তাকে হত্যা করলো?
এ নিয়ে অনেক খবর বের হচ্ছে দৈনিকগুলোতে।
প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, লোকমান হত্যা মামলার প্রধান আসামি মন্ত্রী রাজুর ভাই সালাহউদ্দিন বাচ্চু ও সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মাসুদুর রহমান মুরাদ এবং নরসিংদী পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মন্তাজ উদ্দিন ভুঁইয়া কঠোর নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে হাইকোর্টে জামিনের জন্য প্রবেশ করেন। তাদের জামিনের আবেদন হাইকোর্ট গ্রহণ করেননি। তিন এজাহারভুক্ত আসামি নিরাপদে আদালত থেকে বের হয়ে যান। হাইকোর্টে প্রবেশের সকল গেটে পোশাক পরিহিত পুলিশ সদস্য ছিল। এছাড়া বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার বেশ কিছু সদস্য হাইকোর্টে বিচার কার্যক্রম চলাকালীন অর্থাৎ সারাদিন আদালত প্রাঙ্গণে ঘুরাফেরা করে থাকেন।
এতোসব নিরাপত্তা বলয়ের মধ্য দিয়ে মেয়র লোকমান হত্যাকান্ডে এজাহারভুক্ত প্রধান আসামিসহ তিনজন কী করে আদালতে আসলেন এবং বের হলেন- এই সংবাদ নরসিংদীতে ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। মেয়র লোকমান হত্যাকান্ডে জড়িত যেই হোক গ্রেপ্তারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা রয়েছে। অপরদিকে এই হত্যাকা- নিয়ে নরসিংদী ছাড়াও সারা দেশে তোলপাড় চলছে। আসামিরা নিরাপদে বিনা বাধায় আদালতে যেতে পারেন দেখে এবং পুলিশ র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নীরবতা বিষয়ে নরসিংদী শহরজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে। মেয়র লোকমানের শোকাহত পরিবারের কাছে উক্ত বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ।
নিহত লোকমানের ছোটভাই নরসিংদী সরকারি কলেজের ভিপি ও জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শামীম নেওয়াজ বলেন, পৌর আওয়ামী লীগ সভাপতি মন্তাজ উদ্দিন ভুঁইয়া হত্যাকা-ের ঘণ্টাখানেক আগে মেয়র লোকমানকে ফোন করে দলীয় কার্যালয়ে যাওয়ার জন্য বলেছেন। হত্যাকা-ের সময় মন্তাজউদ্দিন ভুঁইয়া মেয়র লোকমানের পাশে বসা ছিলেন। জড়িত ও পরিকল্পনাকারী এবং খুনিদের সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়ে হত্যা মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে তাদের নাম দেয়া হয় বলে তিনি জানান। পরিত্যক্ত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে মোটরসাইকেলটির (কুমিল্লা-২-১১-৩১৫২) সূত্র ধরে পুলিশ চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকান্ডের রহস্য উদঘাটন করতে সফল হচ্ছে বলে জানা যায়।
দেশজুড়ে এখন চলছে ক্ষমতার গ্রুপিং-পাল্টা গ্রুপিংয়ের মহড়া।
লোকমান হোসেন সেই ঘটনার শিকার। নরসিংদীর পৌর মেয়র লোকমান হোসেন হত্যা মামলার আরো এক আসামিকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ নিয়ে তিন জনকে গ্রেপ্তার করা হলো। গেলো মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে গ্রেপ্তার আশরাফুল সরকার নরসিংদী শহর যুবলীগের সভাপতি। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, গ্রেপ্তারের পর আশরাফুলকে নরসিংদী পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
দুই.
বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা খুবই দরকার। সরকারি দলের জন্য হোক আর বিরোধী দলের জন্যই হোক। আমাদের মনে আছে, এদেশে সামরিক শাসন এসেছিল। এদেশে ওয়ান ইলেভেন এসে রাজনীতিকদের তছনছ করেছিল। তাতে আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা একটা বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছিল।
তারপর মামলার খড়গে রাজনীতিকদের কলুষিত করার চেষ্টা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা পেলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নতি বাংলাদেশে হয়নি। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যায় সুযোগ-সুবিধা প্রদান ও ক্ষমতার স্বৈরাচারী প্রয়োগের সংস্কৃতি সুস্থ গণতন্ত্র চর্চার পথে বড় বাধা হয়েই থেকে যাচ্ছে বারবার। এ কথাটি জানা থাকা সত্ত্বেও মানতেই হবে সুশাসনের বিষয়ে জনসচেতনতা বেড়েছে। আর বেড়েছে বলেই লোকমান হত্যাকা-ের মূল নায়কদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ সোচ্চার হচ্ছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা থাকার পরও শক্তিশালী গণমাধ্যম ও নাগরিক সক্রিয়তার মাধ্যমে এক ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চলছে। সংবাদপত্রগুলো সাহসী ভূমিকা নিয়ে সকল অপশক্তি, নব্য হায়েনাদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, লিখছে। বাংলাদেশে সবসময় কোনো কোনো এমপিদের একটা অন্যায় দাপট আমরা লক্ষ করি। অথচ আমাদের সুশীল সমাজ বারবার বলেন, স্থানীয় সরকারগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। দেশের সংবিধান বলছে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে এমপিরা কারো আজ্ঞাবহ হিসেবে থাকবেন না।
তাদেরকে জনগণের কাছে জবাবদিহি হতে হবে, অন্য কারো কাছে নয়। নীতিগতভাবে খবরদারিত্বের ক্ষমতা এমপি-আমলাদের নেই। অথচ নরসিংদীতে একজন মন্ত্রী এখন গোটা দেশের উৎকণ্ঠার কারণ।
মনে রাখতে হবে, বর্তমান প্রজন্ম আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে এখন জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক বেশি সমৃদ্ধ ও অধিকার সচেতন। গোটা বিশ্বের সঙ্গে তারা নিবিড় সম্পর্কজালে সংযুক্ত হয়ে নিজেদের গ্লোবাল ভিলেজের অধিবাসী করে নিয়েছে।
সুতরাং সারা বিশ্বের প্রেক্ষিতে উন্নয়ন ও সেবা প্রাপ্তির আপেক্ষিক বা তুলনামূলক বিচার বিশ্লেষণ ও তথ্য-উপাত্ত তাদের নখদর্পণে। বিশ্ব প্রেক্ষিত বিবেচনায় তাদের সকল প্রত্যাশাও প্রমিত মানের। আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় তারা জানে, টেকসই উন্নয়নের জন্য সুশাসন অপরিহার্য এবং সুশাসন বলতে স্থানীয় সুশাসনকেই বুঝায়। স্থানীয় শাসনের অধিক্ষেত্রেই তারা বসবাস করে এবং প্রয়োজনীয় সেবা প্রত্যাশা করে। কেউ গ্রামে, কেউ নগরে, কেউ মহানগরে।
এসব অধিক্ষেত্রে বিদ্যমান প্রশাসন যন্ত্রের কাছেই তারা যায় ও চায় প্রয়োজনীয় সকল নাগরিক সুবিধা। তাই কেন্দ্র থেকে স্থানীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ এবং সারা দেশে সুষম ও শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিকল্প নেই। এসব কথা জানার পরও, বর্তমান মহাজোট সরকার যেন না দেখার ভান করছে।
শক্তিশালী ও সুষম গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমেই সরকারের জনবান্ধব নীতিকৌশল ও পরিকল্পনা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং নাগরিক সুবিধাদি যথাথভাবে নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজেদের কোন্দলের আগুনে গোটা দেশকে পুড়াতে চাইছে।
গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত স্বেচ্ছাচারিতা প্রয়োগের কোনো সুযোগ নেই। আর লুটপাটের জন্য, ক্ষমতার দাপট টিকিয়ে রাখার জন্য খুন-খারাবি কি শীর্ষ নেতারা মেনে নেবেন? যারা এর মূল হোতা তাদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না? দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি ভেঙে পড়ে এর দায় সবাইকে নিতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য নিরন্তর অনুশীলন প্রয়োজন। আর এজন্য আইনের শাসন খুব জরুরি। প্রয়োজন দলবাজি, চাঁদাবাজি, নিয়োগবাজির পথ পরিহার করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা।
গণতন্ত্রের নামে লুটপাটকারীদের হাতে দেশ জিম্মি থাকতে পারে না। অতীতের কথা বাদ দিলেও গত দুই দশকের সংসদীয় গণতন্ত্রও রাজনীতিতে সহনশীলতা এবং অন্যের মত শোনার সহিষ্ণুতা প্রায় অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের নামে কখনো রাজপথে সহিংসতা ছড়ানো, বোমাবাজি কিংবা ট্রেনে বাসে আগুন দেয়া দুঃশাসনের নামান্তর। গণতন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য সুশাসন, নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে কিংবা দেশবাসীর দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই।
মনে রাখা দরকার আগামী দুবছর হতে পারে দেশের জন্য সংকটময়। তাই এই সংকট কাটাতে হলে সরকারকে হিসেবী হতে হবে। এই হিসেবে ভুল করলে এর পরিণাম শুভ হবে না।
নিউইয়র্ক,১৬ নভেম্বর ২০১১
---------------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা/ ১৯ নভেম্বর ২০১১ শনিবার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।