৭ দিনের লম্বা ছুটি দিয়েছে অফিস। স্যারের মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে এই ছুটি। সময়টা শ্রাবণের মাসের মাঝামাঝি। সারাদিন একটানা বৃষ্টি হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় থাকেনা।
আমি ভ্রু কুঁচকে নোটিশ বোর্ডটির দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি হেনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিতে টাইপিস্ট হিসেবে গত তিন বছর ধরে কাজ করছি। হেনা স্যারের স্ত্রীর নাম। খুব সাদাসিধে আর মমতাময়ী মহিলা ছিলেন তিনি। দেড় বছর আগে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন হেনা ম্যাডাম।
খুব মনে পড়ে আমার সেই দিনগুলোর কথা। মাসে একদিন উনি অফিসের সবাইকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াতেন। হেনা ম্যাডাম মারা যাবার ৬ মাসের মাথায় স্যার আবার বিয়ে করেছেন অল্প বয়সী একটা মেয়েকে।
আমার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের অনন্তপুর। গত একবছর আমি একবারও গ্রামে যাইনি।
মিতুকে পুরোপুরি ভুলে থাকতে চেয়েছিলাম। গ্রামের কথা মনে হলেই সেই হিজল গাছ, পুকুর পাড় প্রচণ্ড মন খারাপ করে দেয় আমার। মিতুর সাথে আমার দুবছরের প্রেম ছিল। মিতু কিভাবে ভুলে গেল, কেন ভুলে গেল কিছুই জানতে পারিনি আমি। একদিন দুপুর বেলা হিজল গাছটার নিচে মিতু আমাকে বলেছিল
-আমাকে ভুলে যাও তুমি।
-কিন্তু কেন?
-আমি জানিনা। আমি কিছুর উত্তর দিতে পারবনা। প্রশ্ন করে আমাকে কষ্ট দিওনা দয়া করে।
আমি মিতুকে প্রশ্ন করে কষ্ট দিতে চাইনি। পরদিনই অভিমান করে ঢাকায় চলে এসেছিলাম।
আমি চলে আসার দুদিন পরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল মিতুর।
কয়েকদিন থেকেই খুব মনে পড়ছিল গ্রামের কথা, মিতুর কথা। এবারের ছুটিটা গ্রামেই কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলাম শেষ পর্যন্ত।
সকাল থেকেই একটানা বৃষ্টি হচ্ছে; কুকুর বিড়াল বৃষ্টিতে ভেজা টাইপ বৃষ্টি। ভিজে জুবুথুবু হয়ে সন্ধ্যার একটু আগে আগে মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে পৌঁছাই।
২০০ টাকায় এনা পরিবহণের একটা টিকেট কেটে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি আমি।
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। বাসের জানালা দিয়ে সামান্য দূরত্বেও কোন কিছুই ভালমত দেখা যাচ্ছিলনা। শম্বুক গতিতে চলছে বাসটি। বৃষ্টির শব্দ এবং বাসের শব্দ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
অতীতের দিনগুলো প্রচণ্ড মনে পড়ছিল কেন জানি। মিতু কীভাবে ভুলে গেল সব স্মৃতি? ওর ঠোঁটে, গালে, গলায়, বুকে আমার ঠোঁটের চিহ্নগুলো এত তাড়াতাড়ি কীভাবে মুছে গেল? গত দুই বছরে একবারও খোঁজ নিলেনা আমি কেমন আছি! কীভাবে সম্ভব করে তুললে ব্যাপারটা মিতু?
প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সংবিৎ ফিরে আসে আমার। হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায় বাসটির মধ্যে। বাসটি ছিটকে পড়ে রাস্তার পাশের খালে। মুহূর্তেই লাল হয়ে যায় খালের সমস্ত পানি।
সমস্ত শক্তি দিয়ে জানালা দিয়ে কোন রকমে বের হয়ে আসি আমি। মুহূর্তেই অসংখ্য লাশ ভাসতে থাকে খালের পানিতে।
হঠাৎ করে আমার শরীরটা হালকা হালকা মনে হতে থাকে। কেমন যেন একটা সুখ সুখ অনুভূতি। চোখের সামনে এতগুলো মৃত্যু একটুও প্রভাব ফেলছেনি আমার মাঝে।
উল্টো ভাল লাগছিল আমার।
অন্য একটা গাড়ি ধরে ময়মনসিংহ শহরে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত প্রায় ১০টা বেজে যায়। একে তো বর্ষাকাল তার উপর মোটামুটি রাত হয়েছে; ভাগ্য প্রসন্ন ছিল বলে ময়মনসিংহ টু ফুলবাড়িয়ার শেষ বাসটা পেয়ে যাই। ময়মনসিংহ থেকে ফুলবাড়িয়া, ফুলবাড়িয়া থেকে শুশুতি বাজার পৌঁছতে রাত প্রায় একটা বেজে যায়। প্রচণ্ড বৃষ্টি উপেক্ষা করে শুশুতি বাজার থেকে হেঁটেই অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই আমি।
নিকষ কালো অন্ধকার চারদিকে, সাথে ঝিমঝিম বৃষ্টি। জমাট বাঁধা অন্ধকার ভেদ করে হাঁটতে খুব ভয় করছিল আমার। কেমন যেন অস্বাভাবিক নির্জন চারদিক। নরকেও এমন অন্ধকার আছে কিনা কে জানে। দূরে কোথায় যেন একটা কুকুর কুঁউঁউঁউঁ কুঁউঁউঁউঁ............ করে কাঁদছে।
আমাদের গ্রামের পুবদিকে রাস্তার ধারে একটা নতুন কবর দেখে ধক করে ওঠে বুকের ভিতরে আমার। কে মরল হঠাৎ? কেমন যেন একধরণের আকর্ষণ অনুভব করছিলাম কবরটার প্রতি। ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে হাঁটতে থাকি আমি।
কবরটার পাশে পাশা পাশি তিনটা কলা গাছ ছিল। কলা গাছগুলোর মাঝে হঠাৎ কি যেন নড়ে উঠল।
স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা ছায়ামূর্তি আমার দিকে আসছে। মুহূর্তেই প্রচণ্ড এক অজানা আতংক গ্রাস করল আমাকে।
মূর্তিটা কাছে আসতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই আমি। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা। মিতু আমার সামনে দাঁড়িয়ে।
একেবারে পাথরের মত দাঁড়িয়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মিতু আমাকে। আমার বুকের সাথে মিতুর বুক, ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। কেমন জানি হিমশীতল মিতুর ঠোঁটগুলো। কেমন জানি একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম আমি।
ও আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলছিল- তুমি এখন আমার খুব কাছে। আমি তোমার সাথে থাকব এখন থেকে। অপেক্ষা কর আমি আসছি। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৌড় দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় মিতু।
কাদের চাচার চায়ের দোকান তখনও খোলা ছিল।
অজ পাড়াগাঁ হলেও কাদের চাচার চায়ের দোকান প্রায় সারা রাতই খোলা থাকে।
আমাকে দেখে কাদের চাচা বলে- মঈন না?
আমি বললাম- হ্যাঁ, কেমন আছেন কাদের চাচা?
-ভাল। কিন্তু তুমি এতদিন পর? তাও আবার এত রাতে?
-রাস্তায় গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছিল। তাই আসতে একটু দেরি হল। কাদের চাচা আমার আর মিতুর সম্পর্কের কথাটা জানত।
আমি কাদের চাচাকে বললাম- মিতু কেমন আছে চাচা? ওর কি কিছু হয়েছে? কিছুক্ষণ আগে ওর সাথে আমার দেখা হয়েছিল। ওকে কেমন জানি অস্বাভাবিক মনে হল আমার।
হঠাৎ করে কেন জানি চুপ মেরে গেল চাচা। অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চাচা বলল- বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়েছ সম্ভবত। কিসব আবোলতাবোল বকছ? তুমি কিছুই জাননা?
-না।
-মিতু আজ ৬ মাস হল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। যাও বাসায় গিয়ে ঘুমাও মাথা ঠিক হয়ে যাবে।
মুহূর্তেই আতংকে নীল হয়ে যায় আমার সমস্ত শরীর। মিতু মরে গেছে তাহলে কে আমার সাথে দেখা করল তখন? আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে হাঁটছি। ধুম ধুম শব্দে হার্টবিট হচ্ছিল।
সমস্ত পৃথিবী কেমন জানি ঝাপসা মনে হতে থাকে আমার কাছে। কানের ভিতর নানা ধরণের শব্দ বাজছিল। এ্যাম্বুলেন্সের শব্দের মত তীক্ষ্ণ একটা শব্দ বেড়েই চলছিল কানের মধ্যে। ওই শব্দটা আমার সমস্ত অনুভূতি গ্রাস করে নিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল যেন আমি হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছি, চলে যাচ্ছি পৃথিবীর বাইরে অনেক অনেক দূরে কোথাও।
ভোর ঠিক ৫ টার সময় একটা এ্যাম্বুলেন্স আসে অনন্তপুর গ্রামে। মঈন নামের একটা ছেলের লাশ ছিল ওটাতে। গত রাতে ময়মনসিংহ ও ত্রিশালের মাঝামাঝি কোন এক যায়গায় মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় মঈন সহ প্রায় ৩০ জন যাত্রী নিহত হয়।
মুহূর্তেই সারা গ্রামের সবাই এসে ঘিরে ধরে এম্বুলেন্সটিকে। মঈনের লাশ গাড়ি থেকে নামানোর পর কান্নার রোল পড়ে যায় সারা গ্রামে।
শুধু কাদের নামে একজন মুদি দোকানী প্রচণ্ড আতংক আর অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে মঈনের লাশটির দিকে।
This Was Just Meant To Be
You Are Coming Back To Me
'Cause, This Is Pure Love
'Cause, This Is Pure Love......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।