তৃতীয় পর্বের পর ..................
পুলপ্রিটের চূড়ায় উঠার অনুভূতি ছিল এক কথায় অসাধারণ।
ঠেলে ধাক্কিয়ে যখন পুলপ্রিটের উপরে উঠেই পড়লাম ভাবলাম কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেই, একটু নাহয় পাহাড়ের আলো বাতাস খাই, ঊর্ধ্বপানে চেয়ে নাহয় গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ভাবি "হায় জীবন এত ছোট কেনে? "
পাহাড় চূড়ায় বসে বসে একবেলা যদি সেই রকমের উদাস-ই না হতে পারলাম তাইলে কিভাবে চলে।
কিন্তু (চরম) উদাস হওয়া কপালে নাই। উদাস তো অনেক পরের ব্যাপার, আমাদের কাছে পানি নাই, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাস থেকে বাঁচার গরম কাপড় নাই, পেট ভরার খাবার নাই, এমনকি কিছু যে বর্জন করব তার ব্যবস্থাও নাই।
এত নাই এর মধ্যেও ব্যাগে খুব সামান্য রুটি আর মাংস ভাজা ছিল তাড়াতাড়ি সেটাই বের করে খেয়ে ফেললাম আর খেয়েই বুঝলাম আরও একখানা বিরাট ভুল করেছি, একে তো সাথে পানি ছিল যৎসামান্য তার উপরে খেলাম রুটি- পিপাসার প্যারামিটার এবার ধাঁই ধাঁই করে আকাশে উঠল।
আরও ব্যাপার আছে, এতক্ষন ধরে হাঁটলাম, ঘুরলাম ফিরলাম বলি প্রাকৃতিক কর্মকাণ্ড বলেও তো কিছু ব্যাপার আছে নাকি। পুলপ্রিটের পাহাড়ি পথ আবার পুরাই পাহাড়ি মানে প্রাকৃতিক কর্ম খুবই প্রাকৃতিক ভাবেই সারতে হবে। আমরা আবার এতই আধুনিক মানুষ আদিম যুগে ফিরে যেতে মন টানল না... সেই রিস্ক আর নিলাম না তাই... ফলাফল রুদ্ধশ্বাসে ফিরতি পথে গমন।
পুলপ্রিট নামক কালপ্রিট কে বিদায় জানিয়ে-
উঠতে যেমন কষ্ট হয়েছিল নামতেও ঠিক তেমন ই কষ্ট হল, এ তো আর একতরফা নামা না আবার শুরু হল উতরাই, চড়াই, উতরাই, চড়াই...এবার আমরা প্রান বাঁচানোর জন্য ছুটছি, পানি চাই, টয়লেট চাই...একটু আরামে জিরোতে চাই...গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত মাঝ রাস্তায় শুরু হল বৃষ্টি... কিভাবে শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের তলদেশে লজে ফিরে এসেছিলাম বলতে পারব না। শুধু মনে আছে শেষ দিকে আমার পা দুটো থর থর করে কাঁপছিল আর বারবার মনে হচ্ছিল এই বার ঠিক পা টা পিছলাবেই পিছলাবে।
একে তো জীবনে প্রথমবারের মত পাহাড়ে গমন তার উপর প্রথম ধাক্কাতেই ১১ খানা পাহাড় টপকিয়ে পুলপ্রিট নামক এক কালপ্রিটের চূড়ায় উঠা আমার মত সারাজীবন ভেতো বাঙালির জন্য যেন সরাসরি ভাত থেকে জাপানিজ খাবার ব্যবস্থা।
ঐ দেখা যায় লজ
পাহাড় থেকে লজের আরেকটু কাছে নামতেই ঘাসে ছাওয়া লজের ছাদ,পিছনে কোন পাহাড়ি ঢাল
লজের আঙিনা থেকে তোলা ছবি, দিগন্ত জুড়ে পাহাড় সারি
যাই হোক লজে নামতে নামতেই সূর্যি মামা এবার ভেংচি কেটে অন্য কোন আকাশে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পুরোপুরি বেড়াতে চলে গেল, ফলাফল টাপুর টুপুর বৃষ্টি থেকে এবার একেবারে বিড়াল কুকুর বৃষ্টি নামল। এর মাঝে ফিরতি বাস আর আসেনা। আমরা তাই লজের মধ্যে চুপ করে বসে অপেক্ষা করছিলাম।
অবশেষে বাস আসলে সন্ধ্যা নাগাদ হোটেলে ফিরলাম।
কিন্তু হোটেলে ফিরেই কি শান্তি আছে, মাথায় ক্যারা চেপেছে ঘুরার, তাই কোনমতে একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে, পেইন কিলার খেয়ে ব্যাথার ভারি পা নিয়ে ছুটলাম স্টাভাঙ্গার বন্দর দেখতে।
জেটিতে প্রায় পৌঁছে গেছি-
এক অলস সন্ধ্যায় স্টাভাঙ্গার বন্দরে
স্টাভাঙ্গারে স্বাগতম
জেটির আশেপাশের রাস্তাগুলতে তোলা ছবি-
ছবি-১
ছবি-২
ছবি-৩
আগেই বলেছি স্টাভাঙ্গার ভারি মনোরম শহর, ছিমছাম, গোছানো। বন্দরের চারিপাশে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়িয়ে চললাম রঙচঙে রাস্তা মানে কালারফুল স্ট্রিট দেখতে।
কালারফুল স্ট্রিটে ঢুকবার মুখে
নরওয়েজিয়ান ভাষায় এই রাস্তার উচ্চারনটা হবে খানিকটা ওভ্রে হলমেগেতে। এটা একটা মজার রাস্তা।
স্টাভাঙ্গার সিটি সেন্টারের মাঝেই পুরা একটা রাস্তার চারিপাশের বাড়িঘর সব উজ্জ্বল ঝকঝকে রং দিয়ে রঙিন। এই রাস্তাটাকে রং মাখিয়ে সং করার বুদ্ধিদাতা ছিলেন হেয়ার ড্রেসার টম কেয়রসভিক । সং বললাম বটে কিন্তু রাস্তাটি আসলে দেখতে ভারি চমৎকার। রাস্তার ধার জুড়ে খাবার আর পানীয়র দোকান, কিছু স্পেশাল চকলেটের দোকান ও রয়েছে যেখানে মজাদার প্রালিনসহ বিভিন্ন চকলেট এবং চকলেট ড্রিংক পাওয়া যায়।
মন মাতানো কালারফুল স্ট্রিট
সত্যিই কালারফুল, নয় কি?
কালারফুল স্ট্রিট থেকে আমরা কালার হয়ে ঘুরতে বের হলাম হোটেলের চারিপাশে।
পথিমধ্যে জুটে গেল কিছু বন্ধু, তাদের সাথে গালে গল্পে বেশ সময়টা কেটে গেল।
পথে পাওয়া বন্ধু
আমাদের হোটেলের ছবি
হোটেলের পাশে অবস্থিত এই জমজ দুই ভবনের কি কাজ জানিনা
হোটেলের সামনে লেক মাঝে মিষ্টি ফোয়ারাটি
দিনশেষে হোটেলে ফেরা, পরদিন সকালে বাস ছাড়বে বারগেনের উদ্দেশ্যে।
হোটেলের জানালা দিয়ে দেখা স্টাভাঙ্গার শহর-
হোটেলের জানালা দিয়ে রাতে ঘুমাতে যাবার আগে বিদায় জানালাম স্টাভাঙ্গারকে।
বিদায় স্টাভাঙ্গার
পরদিন সকালে হোটেলের ফ্রি বুফে নাস্তায় ফ্রি ফ্রি চার রকম ভাবে সরবরাহকৃত আণ্ডা সহযোগে নাস্তা করে বাসে চেপে বসলুম। ফ্রি পেলে বাঙালি নাকি আলকাতরা খায় আর এ তো জলজ্যান্ত মুরগির ডিম।
আমার আর কি দোষ !
সে যাই হোক, বাস এবার যাবে বারগেনের উদ্দেশে। আমার করা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আনন্দময়, মন মুগ্ধকর বৈচিত্র্যময় ভ্রমন ছিল বাসে করে স্টাভাঙ্গার থেকে বারগেন যাত্রা।
সে আরেক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। কখনও মেঠো পথ, কখনও বা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে বাস ছুটে চলেছে, চলতে চলতেই বাস প্রবেশ করল সমুদ্র পৃষ্ঠের ২২৩ মিটার নিচে তৈরি ৫৮৬০ মিটার লম্বা এক টানেলে। সেই টানেল আর শেষ হচ্ছিল না।
টানেল থেকে বেরিয়ে কিছুদুর যেতে না যেতেই একবার ফেরি পার হতে হল তারপর আবারও পথ চলা আবারও ফেরি পার...এইভাবে কখনও জলপথে, কখনও বা স্থল পথে কখনও পাহাড় ডান পাশে রেখে কখনও বা পাহাড় বাম পাশে রেখে, সমুদ্রের ধার ঘেঁষে আমরা ছুটে চলছিলাম বারগেনের উদ্দেশে।
সূর্যি মামা এইবার আমাদের সাথে একটা অদ্ভুত খেলা খেলল, পুরা বাস জার্নির সময়টা আকাশে মেঘে ঢাকা হলেও কিছুটা সূর্য ছিল। সূর্যের ঝলমলে আলোতে আশে পাশের রাস্তার চারিপাশ কি যে অপার্থিব সুন্দর লাগছিল বলে বোঝানোর মত না। রাস্তার দুই পাশ দেখতে দেখতে কখন যে পাঁচ ঘণ্টার জার্নি শেষে বারগেন পৌঁছে গেছি টের পায়নি।
বারগেনের গল্প আজকে আর নয়।
আজ বরং যাত্রা পথে চারিপাশের ছবি দেই।
প্রতিটি ছবি তোলা হয়েছে প্রায় ১০০ কিলোমিটার বেগে চলন্ত বাসের জানালার কাঁচের মধ্যে দিয়ে। যা দেখেছি চলন্ত বাস থেকে তোলা ছবিতে তার ছিটে ফোটাও তোলা সম্ভব হয়নি।
১)
২)
৩)
৪)
৫)
৬)
৭)
৮)
৯)
১০)
১১)
১২)
১৩)
১৪)
খুব আফসোস হচ্ছিল ছুটন্ত বাসে না থেকে একটু যদি শান্তিমত দাঁড়িয়ে বসে ছবিগুলো তুলতে পারতাম।
চলবে ...... ......
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।